পাপিয়া-সুমনের উত্থানের পেছনে দ্বন্দ্ব, সংঘাত, খুনোখুনি

শামীমা নূর পাপিয়া।
শামীমা নূর পাপিয়া।

খুন, ধর্ষণ, ডাকাতির মামলা মাথায় নিয়েও নরসিংদীতে সরকারি দলের নেতা, জনপ্রতিনিধি হওয়ার উদাহরণ আগেই তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক বিবাদে খুনোখুনিও হয় বিস্তর। এর মধ্য দিয়ে পক্ষ পাল্টে নরসিংদীর দলাদলি আর খুনোখুনির রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা পেতে সময় লাগেনি মফিজুর রহমান চৌধুরী ওরফে মতি সুমন এবং তাঁর স্ত্রী শামীমা নূর ওরফে পাপিয়ার। বিবদমান দুই পক্ষের হয়েই কাজ করেছেন তাঁরা। নিজেদের পেশিশক্তির প্রয়োজনে নেতারাও সুমন-পাপিয়াকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে গেছেন।

জেলা আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো জানায়, দলের বিবদমান দুটি পক্ষের একটির নেতৃত্ব দেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সদর আসনের সাংসদ নজরুল ইসলাম। অন্য পক্ষে আছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আবদুল মতিন ভূঁইয়া এবং নরসিংদী শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পৌরসভার মেয়র কামরুজ্জামান।

সাংসদ নজরুল ইসলাম ও আবদুল মতিন ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা না থাকলেও কামরুজ্জামানের বিরুদ্ধে খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, দুর্নীতি, মাদক ব্যবসা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, ভূমিদস্যুতা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি–সম্পর্কিত অন্তত ১২টি মামলা রয়েছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। এসব মামলা ও অভিযোগের ফিরিস্তি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে একটি গোপনীয় প্রতিবেদন পাঠায় জেলা প্রশাসন।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৯২ সালে ডাকাতির মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন কামরুজ্জামান, ১৬৪ ধারায় বিচারকের কাছে জবানবন্দিও দেন। ১৯৯৭ সালে শহরের একটি হাসপাতাল নির্মাণের সময় প্রকৌশলীকে অপহরণ করে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবির অভিযোগ ওঠে। ১৯৯৮ সালে এক কলেজছাত্রীকে ধর্ষণের পর পুড়িয়ে হত্যা মামলারও আসামি কামরুজ্জামান। ২০০১ সালে পাপিয়ার স্বামী মতি সুমনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যাত্রা প্যান্ডেলের মধ্যে মানিক কমিশনারকে হত্যা করার, সেই মামলারও প্রধান আসামি মেয়র কামরুজ্জামান। এক হিন্দু ব্যবসায়ীর জমি দখল করে ভাইয়ের নামে ধর্মীয় স্থাপনা তৈরি, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেন প্রকল্পে ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ তিন গুণ অর্থ আদায়ের লোভে কয়েক জায়গায় রাতারাতি বহুতল ভবন নির্মাণ, শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে চাঁদাবাজি ইত্যাদি অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। জেলার সড়ক ও জনপথ, এলজিইডি, জনস্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের টেন্ডার কামরুজ্জামান নিয়ন্ত্রণ করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

তবে মেয়র কামরুজ্জামান তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপি আমলে কিছু মামলা হয়েছিল, যা থেকে আমি খালাস পেয়েছি। আমি বর্তমানে অনেক উন্নয়নকাজ করছি, সেটা আওয়ামী লীগের অনেকেই পছন্দ করছে না। অনেকেই আমার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে ২৫-২৬টি রিট করেছে।’ মেয়র বলেন, নরসিংদী শহরে কেউ বলতে পারবে না, কারও কাছ থেকে আমি ১০টি টাকা নিয়েছি।’

জেলার রাজনীতিতে খুনোখুনির সংস্কৃতি অনেক পুরোনো। স্বাধীনতার পর নরসিংদীতে দুজন সাংসদ, পৌরসভার একজন মেয়র, এক ডজনের বেশি ইউপি চেয়ারম্যান ও জনপ্রতিনিধিসহ বহু রাজনৈতিক কর্মী খুন হয়েছেন। এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য পরিবার যাঁদের দিকে আঙুল তুলছেন, তাঁদের অনেকেই রাজনীতিতে বহাল তবিয়তে আছেন।

২০১১ সালের ১ নভেম্বর সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন পৌরসভার তৎকালীন মেয়র লোকমান হোসেন। লোকমান হত্যার বিচার না হলেও তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁর ভাই কামরুজ্জামান নানা অপরাধের অভিযোগ মাথায় নিয়েই পৌর মেয়র হয়েছেন। লোকমানের স্ত্রী তামান্না নুসরাত ওরফে বুবলী সংরক্ষিত নারী আসনে সাংসদ হয়েছেন। যদিও সম্প্রতি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় নিজে অংশ না নিয়ে অন্যদের দিয়ে পরীক্ষা দেওয়ানোর অভিযোগ ওঠে। পরে তিনি দল থেকে বহিষ্কৃত হন।

>

নরসিংদীর আছে দলাদলি আর খুনোখুনির রাজনীতির লম্বা ইতিহাস। অপরাধের অভিযোগ মাথায় নিয়েও এখানে প্রতিষ্ঠা পাওয়া যায়।

আধিপত্য বিস্তার এবং দলীয় কোন্দলে ২০১০ সালের ১৫ মার্চ নরসিংদী সরকারি কলেজের ছাত্র সংসদ কার্যালয়ের ভেতরে তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক (জিএস) বিল্লালকে হত্যা করা হয়। ২০১২ সালে আলোকবালী ইউনিয়ন পরিষদের ছয়বারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক সরকার খুন হন। ২০১৮ সালে খুন হন যুবলীগ নেতা মাহমুদুল হাসান, রায়পুরা উপজেলার বাঁশগাড়ি  ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজুল হক।

নরসিংদীর স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীরা বলছেন, জেলার রাজনীতিতে এ রকম খুনোখুনির ইতিহাস থাকায় নেতারা সব সময়ই নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে সতর্ক থাকেন। তাই জেলার রাজনীতিতে পাপিয়া-সুমনের মতো অনুসারীদের বেশ কদর রয়েছে। সুমন একসময় প্রয়াত মেয়র লোকমানের দেহরক্ষী ছিলেন। লোকমান নিহত হওয়ার পরে কামরুজ্জামানের সঙ্গে চলাফেরা শুরু করেন সুমন। ২০১২ সালে পাপিয়ার গুলিবিদ্ধ হওয়াকে কেন্দ্র করে কামরুজ্জামানের সঙ্গ ছাড়েন এই দম্পতি। এরপর ঢাকায় এসে যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতার পৃষ্ঠপোষকতায় ২০১৪ সালে জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক হন পাপিয়া। সে সময় জেলায় তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা দিতেন যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও শিবপুরের সাংসদ সিরাজুল ইসলাম মোল্লা, রায়পুরার সাংসদ রাজি উদ্দিন আহমেদ, সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাংসদ রহিমা বেগম এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আসাদুজ্জামান। ২০১৬ সালে আসাদুজ্জামান জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদ হারান। আরও কয়েকজনের সমর্থন হারিয়ে মাঝের দুই বছর পাপিয়া ও সুমন রাজনীতিতে একটু নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে এই দম্পতি পক্ষ বদল করেন।

স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীরা জানান, নরসিংদী সদর আসনের টানা তিনবারের সাংসদ নজরুল ইসলাম আওয়ামী লীগের গত আমলে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। ওই সময় তাঁর প্রধান দুই কর্মী ছিলেন আবদুল মতিন ভূঁইয়া ও কামরুজ্জামান। কিন্তু গত সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে কামরুজ্জামান দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন। এর মধ্য দিয়ে নজরুল ও কামরুজ্জামান দুটি পক্ষে বিভক্ত হয়ে যান। দুটি পক্ষই নিজেদের শক্তি ও কর্মী বাড়াতে দলটির সাবেক ও বিতাড়িত কর্মীদের কাছে টানতে শুরু করে। তখন কামরুজ্জামানকে ছেড়ে নজরুল ইসলামের কর্মী হয়ে নরসিংদীতে নিয়মিত আসতে থাকেন পাপিয়া-সুমন, যোগ দিতে থাকেন স্থানীয় সাংসদের সব কর্মসূচিতে। তবে সাংসদ নজরুল ইসলাম ও পৌর মেয়র কামরুজ্জামান দুজনেরই দাবি, তাঁরা কখনোই পাপিয়া ও সুমনকে তাঁদের দলে ভিড়তে দেননি।

নরসিংদীর সূত্রগুলো বলছে, এখন জেলা আওয়ামী লীগে এমনই বিভেদ যে বিভিন্ন জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় কোনো দিবসের সভা-সমাবেশ বা অনুষ্ঠানে এক পক্ষের কেউ উপস্থিত থাকলে অন্য পক্ষের কেউ থাকেন না। সর্বশেষ গত ৮ ফেব্রুয়ারি শহরের মুসলেহ উদ্দিন ভূঁইয়া স্টেডিয়ামে আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় উপস্থিত ছিলেন নরসিংদী–৪ আসনে সাংসদ ও শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন। তাঁর উপস্থিতিতেই জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক—এ দুই পক্ষের বাগ্‌বিতণ্ডায় পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত মন্ত্রী সেদিনের ওই সভা স্থগিত করে দিতে বাধ্য হন।

জানতে চাইলে মন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন প্রথম আলোকে বলেন, ‘জেলা আওয়ামী লীগের এক নেতার বহিষ্কারাদেশকে কেন্দ্র করে সভায় জেলার শীর্ষ নেতাদের এই আচরণ সবাইকে ব্যথিত করেছে। আমরা তদন্ত করে শৃঙ্খলা ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে বলেছি।’ তিনি বলেন, আসলে দলটিতে সুবিধাবাদীরা ঢুকেছে। অনেকের হাতে হঠাৎ টাকাপয়সা চলে এসেছে। রাজনীতির চেয়ে স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়েই ব্যস্ত বেশি তাঁরা।’