আমবাগানের নিচে ১২০০ বছর আগের বৌদ্ধবিহার

জায়গাটিতে একসময় ছিল আমবাগান। ১৯৮৮ সালে এক ঝড়ে বাগানের বেশির ভাগ গাছ ভেঙে পড়ে। যশোরের কেশবপুর উপজেলার ডালিঝাড়া গ্রামের ওই বাগানে তখন কচু ও কলাগাছ লাগানোর উদ্যোগ নেন বাগানমালিক। চাষের জন্য মাটি প্রস্তুত করতে গিয়ে একটু গভীরেই শক্ত ইটে বাধা পাওয়া যায়। বিষয়টি স্থানীয় মানুষের চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। কিন্তু এলাকার বাইরে এ ঘটনা তখন খুব একটা জানাজানি হয়নি।

ওই ঘটনার প্রায় ৩০ বছর পর গত নভেম্বরে বাগানটির মালিক রিজিয়া সুলতানা ও তাঁর স্বামী মোস্তফা মোড়ল সিদ্ধান্ত নিলেন সেখানে আবারও আমের চারা লাগাবেন। এবার জমি আরও বেশি খুঁড়তে গিয়ে বিশাল লাল ইটের স্তূপ পাওয়া গেল। খবরটি প্রচার হওয়ার পর গত ডিসেম্বর মাসে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা কার্যালয়ের উপপরিচালক আফরোজা খান এবং সহকারী পরিচালক এ কে এম সাইফুর রহমান এসে জানালেন ওই জমিটি তাঁরা একটু খুঁড়ে দেখতে চান।

জমির নিচে পুরোনো ইটের স্তূপ থাকতে পারে, এটা আগে থেকেই জানার কারণে অনুমতি দিলেন রিজিয়া ও মোস্তফা দম্পতি। এরপর চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে শুরু হয় খননকাজ, চার দিনের মাথায় বেরিয়ে এল লাল ইটের তৈরি বিশাল স্থাপনার চিহ্ন। তিন মাস ধরে খননকাজের পর বেরিয়ে এল চমকপ্রদ সব তথ্য। ওই ইটের স্তূপ আসলে মধ্যযুগের এক বৌদ্ধমন্দির কমপ্লেক্সের একাংশ। ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ বছর আগের ওই বৌদ্ধ স্থাপনাটি শুধু বাংলাদেশের জন্য এক অনন্য আবিষ্কার নয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উপকূলীয় এলাকাতেও এত বিস্তৃত ও অনন্য বৈশিষ্ট্যের বৌদ্ধ স্থাপনা দেখা যায়নি।

প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যশোরের কেশবপুর উপজেলার ওই বিহারের ধ্বংসাবশেষে এমন কিছু ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য পাওয়া গেছে, যা বাংলাদেশ এবং ভারতের বিহার, ওডিশা ও পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য বৌদ্ধ স্থাপনা থেকে আলাদা। অধিদপ্তরের গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা এখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অংশে এমন বৈশিষ্ট্যের বৌদ্ধ স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ রয়েছে কি না, তা জানার চেষ্টা করছেন।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর খুলনা ও বরিশাল বিভাগীয় অঞ্চল কার্যালয়ের দল কেশবপুরের ওই বৌদ্ধবিহার আবিষ্কার করেছে। এ স্থাপনা আনুমানিক ১ হাজার ২০০ বছর আগের।

যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার ঢালিঝাড়া গ্রামে পাওয়া গেছে ১ হাজার ২০০ বছর আগের এ বৌদ্ধবিহার। খননকাজে ব্যস্ত প্রত্নতাত্ত্বিক ও গবেষকেরা। গত শুক্রবার বিকেলে।  ছবি: সাদ্দাম হোসেন
যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার ঢালিঝাড়া গ্রামে পাওয়া গেছে ১ হাজার ২০০ বছর আগের এ বৌদ্ধবিহার। খননকাজে ব্যস্ত প্রত্নতাত্ত্বিক ও গবেষকেরা। গত শুক্রবার বিকেলে। ছবি: সাদ্দাম হোসেন

স্থাপনাটি বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মানববসতির বিস্তার ও পরিবর্তন এবং ইতিহাসের ক্ষেত্রে একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। খননকাজে যুক্ত ছিলেন প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক উর্মিলা হাসনাত, মো. রিপন মিয়া, মো. জাহান্দার আলী ও মো. আবদুস সামাদ। খননকাজে বগুড়ার মহাস্থানগড় থেকে আসা দক্ষ শ্রমিকেরা অংশ নেন। মার্চ মাসজুড়ে খননকাজ চলবে। এরপর বর্ষার কারণে কয়েক মাস বন্ধ থাকবে খননকাজ।

খননকাজের বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মো. মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, কেশবপুরের স্থাপনাটি একটি ছোট আকারের মন্দিরবিশিষ্ট বৌদ্ধবিহার। এখন পর্যন্ত কাঠামোটির উন্মোচন করা অংশের আকার ও গঠন দেখে মনে হচ্ছে এটি দশম শতকের পরবর্তী সময়ের। খননকাজ পুরোপুরি শেষ হলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বসতির ইতিহাসের অনেক নতুন নতুন তথ্য উঠে আসবে।

অনন্য এই বিহারের গুরুত্ব বেড়ে যায় আঞ্চলিক পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায়। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাংশ একই ধরনের ভূমিরূপ দিয়ে গঠিত। সপ্তম শতকের পর থেকে এখানে বসতি গড়ে উঠেছিল। বসতি তৈরির ক্ষেত্রে এ ধরনের ধর্মীয় স্থাপনা কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছিল বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

খননে পাওয়া একটি নিদর্শন। ছবি: প্রথম আলো
খননে পাওয়া একটি নিদর্শন। ছবি: প্রথম আলো

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের করা স্কেচ থেকে দেখা যায়, বৌদ্ধবিহারটি আয়তাকার। পূর্ব দিকে দুটি মন্দির, দক্ষিণ বাহুতে ৮টি ভিক্ষু কক্ষ, পশ্চিম বাহুতে ৬টি ভিক্ষু কক্ষ এবং মাঝখানে একটি বড় কক্ষ রয়েছে। গঠনশৈলী বিবেচনায় বড় কক্ষটিই বিহারের প্রধান প্রবেশদ্বার ছিল বলে ধারণা করা হয়। বৌদ্ধবিহারটির পূর্ব দিকে দুটি বৌদ্ধমন্দির উন্মোচিত হয়েছে।

কেশবপুরের এই বিহারের প্রত্নতাত্ত্বিক খনন এবং পরবর্তী ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. হান্নান মিয়া বলেন, অনন্য বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বৌদ্ধ স্থাপনাটি মুজিব বর্ষের অন্যতম অর্জন। প্রাচীন এ নিদর্শনের বিস্তৃত খননের পাশাপাশি এই বিহারকে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ঘোষণার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

স্বাধীন সেন ।
স্বাধীন সেন ।

আলোচ্য স্থাপনাটিকে তিনটি মন্দিরবিশিষ্ট বৌদ্ধবিহার বলে শনাক্ত করতে চাই। বিহারটির স্থাপত্যিক পরিকল্পনায় অন্যান্য বিহারের চেয়ে ভিন্নতা রয়েছে। বর্তমান বিহার, ওডিশা এবং পশ্চিম বাংলায় আর বাংলাদেশে অদ্যাবধি যেসব বৌদ্ধবিহার বা মহাবিহার আবিষ্কৃত হয়েছে, সেসব বিহারের সঙ্গে এই ভূমি পরিকল্পনার সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য রয়েছে।

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও ভারতের পশ্চিম বাংলার দক্ষিণাংশের ভূমিরূপ একই ধরনের। নিয়মিত গতি বদল হয়ে এমন নদী ও সমুদ্রের জোয়ার-ভাটার কারণে এই অঞ্চলের ভূমিরূপের বয়স তুলনামূলকভাবে নবীন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এই অঞ্চলকে সব সময় প্রভাবিত করে আসছে। গাঙ্গেয় বদ্বীপের এই ভূভাগে পশ্চিম বাংলায় প্রত্নতাত্ত্বিক ও ভূপ্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা বেশি হয়েছে। ঐতিহাসিক যুগ থেকেই এই ভূভাগে মানববসতির আলামত খুঁজে পাওয়া গেছে। বাংলাদেশসংলগ্ন ভূভাগে কয়েকটি আদি মধ্যযুগীয় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বাদ দিলে মূলত সুলতানি ও মোগল আমলের স্থাপত্যিক নিদর্শনই বেশি পাওয়া গেছে। গত কয়েক বছরের নানামুখী গবেষণায় বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের সুন্দরবনসহ সক্রিয় বদ্বীপ অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের ও প্রাক্-মধ্যযুগীয় বসতির চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। এই স্থাপনা তার নতুন এক সংযোজন।

এটি তিনটি মন্দির বিশিষ্ট বৌদ্ধবিহার
স্বাধীন সেন, অধ্যাপক

অরুণ নাগ।
অরুণ নাগ।

সম্প্রতি বাংলাদেশের খুলনা আঞ্চলিক প্রত্ন অধিকর্তা দপ্তর থেকে ডালিঝাড়া ঢিবিতে যে খননকাজ চালানো হয়েছে, তার আলোকচিত্র, ভূমি-নকশা প্রভৃতি দেখে আমার দৃঢ় ধারণা, এটি একটি বৌদ্ধবিহার, যার আনুমানিক সময়কাল খ্রিষ্টীয় নবম-দশম শতক। দুটি
কারণে এই আবিষ্কার আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। দক্ষিণবঙ্গে ভরত ভায়নার পর এটি দ্বিতীয় বৌদ্ধবিহার আবিষ্কৃত হলো। এ স্থাপত্যটির কয়েকটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা এর আগে বাংলাদেশের কোথাও দেখা যায়নি। আমি মনে করি, পুরো স্থাপত্যটি প্রকাশিত হলে বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাসে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন ঘটবে।

বৌদ্ধবিহারটি আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের মানববসতি নিয়েও আরও গবেষণার সুযোগ তৈরি
হলো। সুন্দরবন–সংলগ্ন ওই অঞ্চলের মানুষের সংস্কৃতি, ধর্ম ও কৃষিকাজের বিস্তার নিয়েও আমরা হয়তো ভবিষ্যতে আরও নতুন নতুন তথ্য পাব। ওই অঞ্চলের ইতিহাস সম্পর্কে হয়তো আমাদের এত দিনকার ধারণা বদলে যেতে পারে। আশা করি, গবেষকদলটি এ বিহারটি নিয়ে আরও বিস্তারিত গবেষণা করবেন।

প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন
অরুণ নাগ, ভারতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক