করোনা হাসপাতালে সমস্যা জনবল ও ব্যবস্থাপনায়

কোভিড-১৯
কোভিড-১৯
>নানা সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে হাসপাতালগুলোকে সেবা দিতে হচ্ছে। চিকিৎসা নিয়ে রোগীদেরও অভিযোগ রয়েছে।

করোনা রোগীরা বলছেন, হাসপাতালে সেবা ঠিকমতো হচ্ছে না। চিকিৎসকেরা বলছেন, রোগীদের সব অভিযোগ ঠিক নয়। নানা সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে সেবা দিতে হচ্ছে। রোগী ও চিকিৎসক উভয়ই বলছেন, ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি আছে। এমন সমস্যা কাটিয়ে ব্যবস্থাপনা দ্রুত জোরদার করার কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞরা।

কোভিড–১৯–এর জন্য নির্ধারিত হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগী, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন এমন ব্যক্তি, কোভিড–১৯–এ মারা যাওয়া একজনের ছেলে, কর্মরত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার এ চিত্র পাওয়া গেছে।

রাজধানীর কুর্মিটোলা, মুগদা ও কুয়েত–বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের কয়েকজন চিকিৎসক বলেছেন, চিকিৎসকসহ জনবলের স্বল্পতা আছে। কম জনবল দিয়ে এ ধরনের রোগের চিকিৎসা কঠিন। চিকিৎসকস্বল্পতার কারণে কুর্মিটোলা হাসপাতালে বিকল্প চিকিৎসার (ইউনানি, আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথি) চিকিৎসক কোভিড–১৯ চিকিৎসায় যুক্ত হয়েছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, কোভিড–১৯ রোগীর জন্য কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ৫০০ শয্যা ও কুয়েত–বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে ২০০ শয্যা প্রস্তুত আছে। ৫০০ শয্যার মুগদা জেনারেল হাসপাতাল করোনা চিকিৎসা শুরু করেছে। কিন্তু বাস্তবে হাসপাতালগুলো সব শয্যা ব্যবহার করতে পারছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।

মিরপুরের একজন রোগীর ১৯ এপ্রিল কুর্মিটোলা হাসপাতালে ভর্তি করার প্রাথমিক প্রস্তুতি শেষ হয়েছিল। রাতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রোগীর আত্মীয়দের জানায়, হাসপাতালে ভর্তি করার মতো শয্যা নেই।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ওই দিন ওই হাসপাতালে ৩০০ জনের কম রোগী ভর্তি ছিল (মোট শয্যা ৫০০)। বাস্তবে ওই হাসপাতালে গতকাল পর্যন্ত কোনো দিনই ৩০০–এর বেশি রোগী ভর্তি করা হয়নি। একই তথ্য পাওয়া গেছে কুয়েত–বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল সম্পর্কে। ২০০ রোগী এই হাসপাতালে কোনো দিন ছিল না।

কেন শয্যা কম
২০ এপ্রিল থেকে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে করোনা রোগীর চিকিৎসা শুরু হয়েছে। কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে একটি কমিটি করেছে। কমিটির সদস্যসচিব মাহমুদুর রহমান বলেন, করোনা রোগীদের দুটি পাশাপাশি শয্যার দূরত্ব বেশি রাখার কথা বলেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সে অনুযায়ী হাসপাতালে সর্বোচ্চ ২৮০ রোগী ভর্তি করা সম্ভব হবে। একই কারণে কুর্মিটোলা হাসপাতালে শয্যার সংখ্যা কমে আসছে।

এ বিষয়ে কুর্মিটোলা হাসপাতালের পরিচালকের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। এরপর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল) আমিনুল হাসান মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করতে বলেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. হাবিবুর রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদর্শ চিকিৎসাব্যবস্থার কথা চিন্তা করে এখন শয্যা কমানো হচ্ছে। দুটি শয্যার মাঝের দূরত্ব বেশি রাখা হচ্ছে। তাই কোভিড–১৯ রোগীর শয্যা কমেছে।’ কিন্তু রোগী বাড়লে কী করবেন—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তখন হয়তো সব শয্যাই করোনার কাজে লাগাতে হবে।

রোগী ও চিকিৎসকের অভিজ্ঞতা
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন কর্মী সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরেছেন। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ১০ এপ্রিল রাজধানীর একটি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ১৫ দিন হাসপাতালে ছিলেন। দিনে একবার বা দুই দিনে একবার চিকিৎসকের দেখা পেয়েছেন। খাবারের কোনো সমস্যা ছিল না।

একই হাসপাতাল থেকে তিন দিন আগে খিলগাঁওয়ের এক বাসিন্দা সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন। তিনি ১০ দিন হাসপাতালে ছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘১০ দিনে ডাক্তারের দেখা পেয়েছি পাঁচ থেকে ছয় দিন।’ হাসপাতালের ভেতরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালের ভেতরে কী হচ্ছে তা প্রশাসন কিছু জানে না।’

২ এপ্রিল এক চিকিৎসক তাঁর বৃদ্ধ মাকে ঢাকার একটি বড় বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করান। হাসপাতালে তাঁকে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়। তাঁর কোভিড–১৯ শনাক্ত হওয়ার তথ্য জানার পর ওই হাসপাতাল আর রোগীকে রাখেনি। ১৪ এপ্রিল ছেলেরা মাকে নিয়ে যান উত্তরার কুয়েত–বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে। এরপর মায়ের অবস্থার কিছু উন্নতি হতে থাকে। কিন্তু তাঁর পিঠে ঘা হয়ে (বেড শোর) যায়। পিঠের সমস্যার চিকিৎসা পাননি তিনি।

তিনজন রোগীর পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, ওয়ার্ডে চিকিৎসক আসেন কম। যখন আসেন, রোগীর ফাইল আনেন না। ওয়ার্ডের অনেক দূরে থাকেন চিকিৎসক ও নার্স, ডাকলেও সব সময় আসেন না। ভালো করে বুঝিয়ে ওষুধ খাওয়ার কথা বলেন না।

তবে চিকিৎসকেরা বলছেন অন্য কথা। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের একজন নারী চিকিৎসক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘একজন রোগী অভিযোগ করে বলেছেন, তাঁকে একটা ইনজেকশনও দেওয়া হয়নি। ইনজেকশন দিতেই হবে, এটা তাঁকে কে বলেছে। এ রকম নানা অভিযোগ তোলা হচ্ছে।’

চিকিৎসকেরা বলেছেন, এটা মারাত্মক সংক্রামক রোগ, রোগীর কাছে যাওয়া যে বিপজ্জনক, অনেক রোগী তা বুঝতে চান না। পিপিই (ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী) পরা থাকে বলে অনেক সময় রোগীরা চিকিৎসক ও নার্সের পার্থক্য করতে পারেন না। চিকিৎসকেরা বলেছেন, ওয়ার্ডে রোগীর ফাইল আনলে সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে।

তবে দুজন চিকিৎসক বলেছেন, ব্যবস্থাপনায় সমস্যা আছে। পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় এ সমস্যা হচ্ছে। আর পিপিইর সমস্যা তো আছেই।

বেশি চিকিৎসক দরকার
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, চিকিৎসকেরা টানা ১০ দিন কাজ করবেন। তারপর ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকবেন। স্বাস্থ্য পরীক্ষায় রোগ ধরা না পড়লে পরের ছয় দিন পরিবারের সঙ্গে কাটিয়ে কাজে যোগ দেবেন। এই হিসাবে প্রতিটি হাসপাতালে দ্বিগুণের বেশি চিকিৎসকসহ সব ধরনের স্বাস্থ্যকর্মী দরকার। বাস্তবে তা নেই।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কুর্মিটোলা হাসপাতালে চিকিৎসকসহ সব ধরনের পদ আছে ৭৮৭টি। এর মধ্যে চিকিৎসকসহ নানা ধরনের পদ খালি আছে ২১৭টি। করোনা চিকিৎসা শুরু হওয়ার পর কিছু চিকিৎসককে পদায়ন করা হয়েছে। কিন্তু সবাই এখনো কাজে যোগ দেননি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

মুগদা হাসপাতালের করোনা কমিটির সদস্যসচিব মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা চিকিৎসকসহ সব ধরনের জনবল বাড়ানোর কথা বলেছি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বাড়াবে বলে জানিয়েছে।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, অন্য হাসপাতাল থেকে চিকিৎসক এনে কোভিড–১৯ হাসপাতালে পদায়ন করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

এমন সমস্যার দুটো কারণ রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রথমত চিকিৎসকদের ঠিকমতো প্রশিক্ষণ হয়নি। দ্বিতীয়ত তাঁরা মানসম্পন্ন সুরক্ষাসামগ্রী পাননি। একজন নারী চিকিৎসক গতকালও অভিযোগ করেছেন, ‘দেড় হাজার টাকা দিয়ে পিপিই কিনেছি। সেটা ভেতরে পরি। ওপরে হাসপাতালের দেওয়া পিপিই। এই গরমে দুটো পিপিই পরে কীভাবে কাজ করি, সে শুধু আমরাই জানি।’

অন্য সমস্যাটি হচ্ছে সরকার বলেছে ৫০ বছর বা তার বেশি বয়সী চিকিৎসকেরা করোনা রোগীদের চিকিৎসায় যুক্ত হবেন না। সে কারণে চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছেন মূলত ৫০ বছরের কম বয়সী চিকিৎসকেরা। এতে বিশেষায়িত সেবার ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।

সময় ও সম্পদ কাজে লাগল না
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জনস্বাস্থ্যবিদ বলেছেন, সংক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য সাধারণ ছুটি ও লকডাউনের (অবরুদ্ধ করা) সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারল না স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। লকডাউন সংক্রমণের গতি হ্রাস করে। সেই সুযোগে প্রস্তুতি নিতে হয়। ২৬ মার্চ থেকে দেশে সাধারণ ছুটি শুরু হয়েছে। অনেক জেলা লকডাউন করা হয়েছে। কিন্তু হাসপাতাল প্রস্তুতির কাজ এখনো শেষ করতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

অন্যদিকে সম্পদ ঠিকমতো ব্যবহৃত হচ্ছে না, এমন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। কুর্মিটোলা হাসপাতালে বর্তমানে ২৭টি ভেন্টিলেটর আছে। কিন্তু ১০টির বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে না। কারণ, ব্যবহার করার মতো কারিগরিভাবে দক্ষ জনবলের ঘাটতি আছে।

জনবল সমস্যা সমাধানে সরকার দুই হাজার চিকিৎসক ও ছয় হাজার নার্স নিয়োগ দেবে বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত সচিব হাবিবুর রহমান। কবে তাঁদের নিয়োগ হবে, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘যত দ্রুত সম্ভব।’

সার্বিক বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তারা বলেন, সব ঠিকঠাক চলছে। বাস্তবে অনেক কিছুই ঠিক নেই। মূল সমস্যা পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনায়। জরুরি ভিত্তিতে জনবল সমস্যার সমাধান করা দরকার। পড়ে থাকা ভেন্টিলেটর অন্য হাসপাতালে পাঠাতে হবে, যেখানে চালানোর লোক আছে।’