আম্পানে খেত-ঘের শেষ, নিঃস্ব বহু মানুষ

সন্ধ্যার পরপরই শুরু হবে জোয়ার। ভাটার এই সময়ের মধ্যে বাঁধের যতটুকু ঠিক করা যায়। দিনের শেষ সময়টাতে বাঁধ মেরামতে কাজ করছেন স্থানীয় লোকজন। গতকাল বিকেলে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনী এলাকায়।  ছবি: সাইফুল ইসলাম
সন্ধ্যার পরপরই শুরু হবে জোয়ার। ভাটার এই সময়ের মধ্যে বাঁধের যতটুকু ঠিক করা যায়। দিনের শেষ সময়টাতে বাঁধ মেরামতে কাজ করছেন স্থানীয় লোকজন। গতকাল বিকেলে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালিনী এলাকায়। ছবি: সাইফুল ইসলাম

‘ঘরের পোতাডাও (ভিটা) পানিতে ধুইয়া লইয়া গ্যাছে। চালের টিন, বেড়া কিছুই নাই। আমার ঘরডা কোনহানে আছেলে, হেইয়াই চেনা যায় না।’ ঘূর্ণিঝড় আম্পান আঘাত হানার আগে বুধবার রাতে স্ত্রী ও তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে একটি আবাসিক হোটেলে আশ্রয় নিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছেন পটুয়াখালীর কুয়াকাটা এলাকার মৎস্যজীবী আমির পাহলান (৫৫)। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় থেমে যাওয়ার পর ফিরে এসে নিজের ভিটাটির চিহ্নমাত্র খুঁজে পাননি।

 কুয়াকাটা বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের ঢালে এ রকম আরও ৭০ জন মৎস্যজীবীর ঘর ঘূর্ণিঝড়ে একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। রাতে কিছু শুকনো খাবার পেয়েছিলেন, পরদিন খিচুড়ি খাইয়েছেন স্থানীয় এক কাউন্সিলর। এরপর কী করে চলবেন, তা জানেন না তাঁরা। তার ওপর ২০ মে থেকে ৬৫ দিনের জন্য সাগরে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সরকার। সব হারিয়ে চোখে আঁধার দেখছেন মানুষগুলো।

ঘূর্ণিঝড় আম্পানে এ রকম ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়। করোনার কারণে এমনিতেই জীবিকার সংকট চলছে। তার ওপর আম্পানের আঘাতে সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন বহু মানুষ। সরকারের হিসাবে আম্পানে ২৬টি জেলায় ক্ষতি হয়েছে। এসব জেলায় বসতবাড়ি থেকে শুরু করে মাছের ঘের, ফসলের খেত, ফলের বাগানের ব্যাপক ক্ষতি করে গেছে আম্পান। জলোচ্ছ্বাসের পানিতে এখনো ডুবে আছে বিস্তীর্ণ এলাকা।

সাতক্ষীরার শ্যামনগরের গাবুরা জেলেখালী এলাকার আজিজ শেখের চিংড়িঘের ভেসে গেছে। তিনি বলেন, তাঁর ২০০ বিঘার চিংড়িঘের করতে ব্যাংক ও মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে চার কোটি টাকা খরচ করেছেন। আম্পানের জলোচ্ছ্বাসে এক দিনেই সব শেষ। সাতক্ষীরা সদরের লাবসা গ্রামের মোনায়েম হোসেন জানান, তাঁর ২০ বিঘার আমবাগানের সব আম পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। এ মৌসুমে বাগানে বিনিয়োগ তিন লাখ টাকা। আশা করেছিলেন আট লাখে বাগান বেচবেন। এখন উল্টো দেনাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।

সাতক্ষীরা কৃষি বিভাগের উপপরিচালক নূরুল ইসলাম জানান, আম, সবজি ও পান মিলিয়ে আম্পানে কৃষকের ১৩৭ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। এসব বিষয় মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে কীভাবে তাঁদের ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়া যায় এ জন্য। জেলার মৎস্য কর্মকর্তা মশিয়ার রহমান জানান, চিংড়ি, সাদা মাছ, চিংড়ির পোনা ও চিংড়িঘেরের অবকাঠামো মিলিয়ে ক্ষতি হয়েছে ১৭৬ কোটি ৩০ লাখ টাকার।

ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসে প্রাথমিক হিসাবে বরিশাল বিভাগের ৬ জেলায় ১৯ হাজার ২৪টি মাছের খামার, ঘের ও পুকুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব পুকুর ও ঘেরের মাছসহ অন্যান্য অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ২৫ কোটি ৫৩ লাখ ১৪ হাজার টাকা। বরিশাল বিভাগীয় মৎস্য কার্যালয় এই হিসাব করেছে। তবে মাঠপর্যায়ের মৎস্য খামারিদের হিসাবে ক্ষয়ক্ষতি সরকারি হিসাবের চার-পাঁচ গুণ বেশি। খামারিরা বলেছেন, সরকারি হিসাবে ক্ষয়ক্ষতির বাস্তব চিত্র আসেনি।

আম্পানের জলোচ্ছ্বাসে বরগুনায় রবি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এতে ৩ হাজার ৪৫ জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছে জেলা কৃষি অফিস। কৃষকেরা জানিয়েছেন, বাতাস ও পানিতে তাঁদের মরিচ, করলা, মুগ ডাল ও চিনাবাদামের খেত সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। বিপুল পরিমাণে ক্ষতির শিকার হয়েছেন চাষিরা।

যশোরের পথেঘাটে তাণ্ডবের চিহ্ন রেখে গেছে আম্পান। এই ঘূর্ণিঝড়ে জেলায় প্রাণ হারিয়েছেন ১২ জন। ঘূর্ণিঝড়টি ঘরবাড়ি, ফসলের খেত, মাছের ঘের, ফলের বাগানের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। গাছ ও ডাল ভেঙে অসংখ্য জায়গায় বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে গেছে, খুঁটি ভেঙে গেছে, ট্রান্সফরমার ও মিটার নষ্ট হয়েছে। যশোর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১–এর সহকারী মহাব্যবস্থাপক সাঈদ হোসেন বলেন, গাছ ও ডাল ভেঙে অসংখ্য জায়গায় বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে, খুঁটি ভেঙে খুবই খারাপ অবস্থা। অন্য পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি থেকে লোকজন এনে দিনরাত কাজ করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত ২৫ শতাংশ এলাকায় সংযোগ দেওয়া সম্ভব হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় আম্পানে চুয়াডাঙ্গার চার উপজেলায় ১ লাখ ৮৫ হাজার ৯৫০ জনকে দুর্গত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ সময় ৩৩ হাজার ৪০০টি বাড়িঘর আংশিক এবং ১ হাজার ৩০৫টি বাড়িঘর সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে। জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার বলেন, খাতভিত্তিক ক্ষয়ক্ষতির হিসাব দিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

পিরোজপুরে অতি উচ্চতার জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে ৬ হাজার ৭৫৪টি পুকুর ও ঘেরের মাছ। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৫ হাজার ৫৭৫ জন মাছচাষি।