দক্ষিণাঞ্চলকে আগলে রেখেছে টেংরাগিরি বন

বঙ্গোপসাগর তীরে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল টেংরাগিরি। ছবি: প্রথম আলো
বঙ্গোপসাগর তীরে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল টেংরাগিরি। ছবি: প্রথম আলো


টেংরাগিরি বনের কারণে এবারও ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তাণ্ডব থেকে রক্ষা পেল বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো। সুন্দরবনের পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের সময় গতিরোধক (উইন্ড ব্রেকার) হিসেবে কাজ করেছে। এ কারণেই ঝড়ের তাণ্ডব তুলনামূলক কম দেখা গেছে।

বরগুনার তালতলী ও পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার অংশে বঙ্গোপসাগর তীরে এই বনাঞ্চল অবস্থিত। ‘ওয়েদার আন্ডারগ্রাউন্ড’ নামের একটি ওয়েবসাইটে বিশ্বের ৩৬টি ভয়ংকর মৌসুমী ঘূর্ণিঝড়ের তালিকা রয়েছে। এই তালিকায় থাকা ২৬টি ঘূর্ণিঝড়ই বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট। এ ছাড়া, ২০০৭ সালের পর দেশে আঘাত হানে বড় নয়টি ঘূর্ণিঝড়। পরিবেশ আইনবিদ সমিতি বেলার বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী লিংকন বায়েন বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে বঙ্গোপসাগরে ঘন ঘন লঘুচাপ, গভীর নিম্নচাপ ও ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হচ্ছে। টেংরাগিরি এসব ঝড় থেকে দক্ষিণের জেলাগুলোকে সুরক্ষা দিচ্ছে।

ঘূর্ণিঝড় আম্পান সম্পর্কে আবহাওয়া বিভাগের তথ্য বলছে, বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়টির কেন্দ্রের সর্বশেষ আয়তন ছিল ৮৫ কিলোমিটার। ব্যাসার্ধ ছিল ১৯০ কিলোমিটার। প্রথমে এটা ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বুধবার বিকেল সাড়ে ৪ টার দিকে ঘণ্টায় ১৫৫ থেকে ১৬৫ কিলোমিটার গতিবেগে আঘাত হানে। এরপর সন্ধ্যা সোয়া ৬ টার দিকে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা উপকূলে আঘাত হানার সময় ঝড়টির গতিবেগ কমে দাঁড়ায় ঘণ্টায় ১৪৮ থেকে ১৫১ কিলোমিটার। এরপর ঝড়টি দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে আঘাত হানে। তাতে দেখা যায়, বরগুনা ও পটুয়াখালীতে আঘাত হানার সময় ঝড়ের গতিবেগ ছিল ৯৩ থেকে ১১০ কিলোমিটার। বরিশালে পৌঁছাতে পৌঁছাতে গতি কমে ৮৩ কিলোমিটারে নেমে আসে।

পরিবেশবিদেরা বলছেন, বিশ্বের সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় বন সুন্দরবন প্রথমে ঝড়টির বড় অংশের গতি মন্থর করে দেয়। এরপর দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে আঘাত হানার আগে গতি অর্ধেকে নামিয়ে আনে টেংরাগিরি বনাঞ্চল।

বঙ্গোপসাগর তীরে সুন্দরবনের পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল টেংরাগিরি। ছবি: প্রথম আলো
বঙ্গোপসাগর তীরে সুন্দরবনের পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্বাসমূলীয় বনাঞ্চল টেংরাগিরি। ছবি: প্রথম আলো

পরিবেশবিদেরা বলছেন, গত বছরের নভেম্বরে আঘাত হানা আরেক ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’ ১৩০ থেকে ১৪০ কিলোমিটার শক্তি নিয়ে উপকূলের দিকে ধেয়ে আসে। একই সঙ্গে এর প্রভাবে ৭ থেকে ৮ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কা ছিল। কিন্তু প্রবল শক্তির এই ঝড়টি প্রথমেই সুন্দরবনে এসে বাধা পায়। প্রথমে ভারতীয় অংশের সুন্দরবনের সাগরদ্বীপে ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত করে। এরপর এটি বাংলাদেশের সুন্দরবনের খুলনা অংশে প্রবেশ করে। দুই দেশের সুন্দরবনের গাছপালায় বাধা পেয়ে ‘বুলবুলের’ বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় ২০ কিলোমিটার কমে যায়। এরপর দক্ষিণাঞ্চলের শ্বাসমূলীয় এই বনাঞ্চলের দফায় দফায় বাধা পেয়ে ঝড়টি আরও দুর্বল হয়।

২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডর এবং ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলা থেকেও দক্ষিণাঞ্চলকে একইভাবে টেংরাগিরি রক্ষা করছে বলেও জানান পরিবেশবিদেরা।

টেংরাগিরি বনের ভেতরের পরিবেশ। ছবি: প্রথম আলো
টেংরাগিরি বনের ভেতরের পরিবেশ। ছবি: প্রথম আলো

বন বিভাগের হিসাবে, বরগুনার তালতলী থেকে টেংরাগিরি পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সৈকত পর্যন্ত বিস্তৃত। বড় নিশানবাড়িয়া ও সখিনা দুটি বিট নিয়ে এই বনের আয়তন ১০ হাজার ৬৪৭ একর। টেংরাগিরিতে লবণাক্ত ও মিষ্টি মাটির মিশ্রণের কারণে প্রচুর জাম, ধুন্দুল, কেওড়া, সুন্দরী, বাইন, করমচা, বলই কেওয়া, তাল, বনকাঁঠাল, রেইনট্রি ও গরানগাছ আছে।

বনের সখিনা বিটের বিট কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান শুক্রবার বিকেলে বলেন, ঝড় জলোচ্ছ্বাসের ক্ষেত্রে সুন্দরবনের পরে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোকে যুগ যুগ ধরে সুরক্ষা দিচ্ছে টেংরাগিরি বন। এবারের ঝড়ে বনেরও তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বনায়ন বিভাগের প্রধান আলমগীর কবির প্রথম আলোকে বলেন, শ্বাসমূলীয় বন মাটির ক্ষয়রোধ, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা এবং ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সময় উপকূলের মানুষকে সুরক্ষার পাশাপাশি কার্বন সংরক্ষণ করে বায়ু পরিশোধনে কাজ করে। নিকট অতীতে দেখা গেছে, সিডর, আইলাসহ প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়ে সুন্দরবন প্রথমে বুক পেতে ঝড়ের গতি মন্থর করেছে। টেংরাগিরি তেমন নিরাপত্তা দিচ্ছে। দুর্যোগ মোকাবিলায় এ ধরনের বন সংরক্ষণের পাশাপাশি পরিধি বাড়ানো জরুরি।