প্রাচীন বিক্রমপুরের নতুন ইতিহাস

মুন্সিগঞ্জের টঙ্গীবাড়ি উপজেলার নাটেশ্বরে খননকাজে আবিষ্কৃত বৌদ্ধধর্মীয় স্তূপ। ছবিটি গতকাল তোলা l প্রথম আলো
মুন্সিগঞ্জের টঙ্গীবাড়ি উপজেলার নাটেশ্বরে খননকাজে আবিষ্কৃত বৌদ্ধধর্মীয় স্তূপ। ছবিটি গতকাল তোলা l প্রথম আলো

মুন্সিগঞ্জের টঙ্গীবাড়ী উপজেলার নাটেশ্বর ও সদরের রঘুরামপুরে চলমান খননে বৌদ্ধবিহার, মন্দির, স্তূপ, বিশেষ ধরনের সড়কসহ অসাধারণ নানা প্রত্ননিদর্শন মিলছে। এসব নিদর্শন প্রায় ১৩০০ বছরের পুরোনো বলে খননসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন। এর ফলে উন্মোচিত হচ্ছে প্রাচীন বিক্রমপুরের নতুন ইতিহাস।
মুন্সিগঞ্জের অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য অন্বেষণ গবেষণা ও চীনের হুয়ান প্রদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক ইনস্টিটিউট এই খননের কাজ করছে।
সংশ্লিষ্ট গবেষকেরা মনে করেন, খননের মধ্য দিয়ে নাটেশ্বর ও রঘুরামপুরে এই পর্যন্ত বৌদ্ধ ধর্মের যেসব প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া গেছে তাতে এ অঞ্চলটি বিশ্ব বৌদ্ধদের তীর্থকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় সরেজমিনে নাটেশ্বরে খননকাজ পরিদর্শন করে দেখা যায়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মুস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে তরুণ গবেষক দল ও চীনা গবেষকেরা খননকাজ করছেন। খননকাজের পাশেই নতুন পাওয়া মৃৎপাত্র সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, উদ্ধার করা লাল ও কালো রঙের মৃৎপাত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘সঞ্চয় আধার’। যে পাত্রে তাম্রমুদ্রা রেখে সঞ্চয় করা হয়। এ ছাড়া রয়েছে রান্নার হাঁড়ি, গামলা, পানির পাত্র, প্রদীপ প্রভৃতি। নাটেশ্বরের খননকাজ হওয়ার পর থেকে এই পর্যন্ত পাঁচটি বৌদ্ধস্তূপ আবিষ্কৃত হয়। বৌদ্ধ পূজনীয় স্থান হলো স্তূপ। এর মধ্যে খননকাজের পশ্চিম দিকে সদ্য নতুন দুটি স্তূপসহ চারটি স্তূপ একটির সঙ্গে আরেকটির পারস্পরিক যোগসূত্র রয়েছে।
খননকাজের তত্ত্বাবধানকারী সুফি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, চন্দ্রবর্মন আমলের বসতি ছিল প্রাচীন বিক্রমপুর। তখন এটি ছিল রাজধানী। এই পর্যন্ত খননকাজে বৌদ্ধ ধর্মের স্তূপসহ যে প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া গেছে তাতে এ অঞ্চল শুধু বাংলাদেশের নয়, সারা বিশ্বের মানুষের জন্য পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠবে।
গবেষণাকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা যায়, খননকাজের স্থানে পাওয়া ২৬টি কাঠ কয়লার ‘কার্বন-১৪’ পরীক্ষার (যে পরীক্ষার মাধ্যমে প্রত্নস্থাপনার সময়কাল নির্ধারণ করা হয়) জন্য আমেরিকার বেটা ল্যাবরেটরিতে পাঠানো হয়। কার্বন পরীক্ষায় নাটেশ্বরে প্রত্নস্থানে মানব বসতির দুটি সময়কাল নির্ধারণ করা হয়। প্রথম পর্যায় হচ্ছে ৭৮০-৯৫০ খ্রিষ্টাব্দ এবং দ্বিতীয় পর্যায় হচ্ছে ৯৫০-১২২৩ খ্রিষ্টাব্দ।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নাটেশ্বরের প্রত্ন নিদর্শন পরিদর্শন করেন। এ সময় অগ্রসর বিক্রমপুরের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নূহ-উল-আলম লেনিনের সভাপতিত্বে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওবায়দুল কাদের বলেন, এখানে না এলে বোঝা যেত না কত বড় একটি কাজ হচ্ছে। এখানকার নিদর্শন সারা বিশ্বের বৌদ্ধদের আকৃষ্ট করবে।
সভায় অন্যান্যের মধ্যে স্থানীয় সাংসদ সাগুফতা ইয়াসমিনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চীনা দূতাবাসের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
খননকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ২০১০ সালে প্রথম রঘুরামপুরে খননকাজ শুরু করা হয়। সেখানে অতীশ দীপঙ্করের সময়ের একটি বৌদ্ধবিহারের অংশবিশেষ ও একটি প্রাচীন নৌকা পাওয়া যায়। ২০১২ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে টঙ্গীবাড়ী উপজেলার নাটেশ্বরসহ মোট নয়টি স্থানে খনন করে প্রাচীন মানব বসতির চিহ্ন আবিষ্কৃত হয়। ২০১৪ সাল থেকে এই খননকাজের সঙ্গে চীনের হুয়ান প্রাদেশিক প্রত্নতাত্ত্বিক ইনস্টিটিউটের গবেষণা প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়।