রাজনৈতিক ঐকমত্যে ফিরল সংসদীয় সরকারব্যবস্থা

প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন হলো সংবিধান। ১৯৭২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করা হয়। গত ৫০ বছরে এ সংবিধান ১৭ বার সংশোধন করা হয়েছে। সংবিধান সংশোধন শুধু ‘তাত্ত্বিক’ বিষয় নয়, সব সময় এর একটি প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য থাকে। সংবিধান সংশোধনের প্রক্রিয়াটি পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয়, এর সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের সংকট, যেকোনোভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা, সামরিক শাসন, সরকারগুলোর কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা—এ সবকিছুই সংবিধান সংশোধন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে। সংবিধান সংশোধন নিয়ে আট পর্বের এই লেখা ধারাবাহিকভাবে প্রতি রোববার প্রকাশিত হচ্ছে। আজ ষষ্ঠ পর্ব

তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৯০ সালের মাঝামাঝি আবারও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। এ অবস্থায় বিরোধী দলগুলো ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। সে সময় তিনটি রাজনৈতিক জোট এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছিল। এসব জোটের মধ্যে ছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ৮–দলীয় জোট, বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৭–দলীয় জোট এবং বামপন্থীদের ৫–দলীয় জোট।

ছাত্র ও পেশাজীবী সংগঠন এবং নাগরিকদের অংশগ্রহণে ১৯৯০ সালের শেষ দিকে আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। তখন থেকেই ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি নিয়ে বিরোধী জোটগুলোর মধ্যে আলোচনা চলছিল। ওই বছরের ১৯ নভেম্বর তিনটি রাজনৈতিক জোট যৌথভাবে একটি রূপরেখা ঘোষণা করে। এতে একটি অস্থায়ী বা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং তার অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলা হয়।

আরও পড়ুন

তিন জোটের এই রূপরেখা আন্দোলনকে আরও বেগবান করে। ২৭ নভেম্বর জরুরি অবস্থা জারি করে এরশাদ সরকার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ ঘোষণা করে। রাজধানী ঢাকাসহ চারটি শহরে কারফিউ জারি করা হয়। কিন্তু জরুরি অবস্থা ও কারফিউ উপেক্ষা করে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ চলতে থাকে।

এরশাদ তখন আবার নির্বাচনী ‘টোপ’ দেন। ৩ ডিসেম্বর তিনি বলেন, একই দিন রাষ্ট্রপতি ও সংসদ নির্বাচন হবে এবং মনোনয়ন দাখিলের ১৫ দিন আগে তিনি পদত্যাগ করবেন। বিরোধী দলগুলো এরশাদের এই ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে এবং তাঁর পদত্যাগের দাবিতে অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি দেয়। ৪ ডিসেম্বর সারা দেশে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। বিরোধীদের দাবির প্রতি নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ একাত্মতা প্রকাশ করায় দেশ তখন কার্যত অচল হয়ে যায়; এরশাদের প্রতি সেনাবাহিনীর সমর্থনও সরে যায়। এ অবস্থায় তিনি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন।

৬ ডিসেম্বর উপরাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমদ পদত্যাগ করেন। রাষ্ট্রপতি এরশাদ তিন জোটের মনোনীত প্রার্থী সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদকে উপরাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগ দেন। এরপর তিনি পদত্যাগ করেন। ৭ ডিসেম্বর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন এবং উপদেষ্টাদের নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেন। লক্ষণীয়, সংবিধানে তখন ‘অস্থায়ী’ বা ‘তত্ত্বাবধায়ক’ সরকার বলে কিছু ছিল না। কিন্তু রাজনৈতিক ঐকমত্যের কারণে সব দল ও দেশের মানুষ এর প্রয়োজন অনুভব করেছিল এবং এটা মেনে নিয়েছিল।

আরও পড়ুন

এ বিষয়ে মওদুদ আহমদ তাঁর বাংলাদেশে গণতন্ত্র: ১৯৯১ থেকে ২০০৬ বইয়ে উল্লেখ করেন, ‘রাজনীতি যখন রাজপথে নেমে আসে, তখন সংবিধানের শাব্দিক অর্থ ও সৌন্দর্য তাদের গুরুত্ব হারিয়ে জনগণের দাবির আজ্ঞানুবর্তী হয়ে পড়ে। এভাবে সংবিধানবহির্ভূতভাবে একটি কেয়ারটেকার সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বৈধতার বিষয়ে বিরোধী দলের কাছে প্রশ্ন উত্থাপন করা হলে তার জবাবে বিরোধী পক্ষ থেকে বলা হয়, ঘটনাক্রমেই একদিন এসব তাত্ত্বিক সমস্যাগুলোর সমাধানও তারা করবে। যেহেতু জনগণ হলো সকল ক্ষমতার উৎস, সেহেতু নয়া জাতীয় সংসদই এসব প্রশ্নের সমাধান ঘটাবে।…’

রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ এবং তাঁর উপদেষ্টাদের নিয়ে গঠিত অস্থায়ী সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম সুষ্ঠু এই নির্বাচনে ৩০০টি আসনের মধ্যে বিএনপি ১৪০টি, আওয়ামী লীগ ৮৮টি, জাতীয় পার্টি ৩৫টি এবং জামায়াতে ইসলামী ১৮টি আসন পায়। জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনে বিএনপি সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ২০ মার্চ খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী করে সরকার গঠন করা হয়। ২১ মার্চ শেখ হাসিনা বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচিত হন। ৫ এপ্রিল সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে।

আরও পড়ুন

একাদশ সংশোধনী: অস্থায়ী সরকারের কাজের বৈধতা

১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট পঞ্চম জাতীয় সংসদে সংবিধানের একাদশ সংশোধনী গৃহীত হয়। ১০ আগস্ট তা রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায়। আগেই বলা হয়েছে, একটি বিশেষ রাজনৈতিক বাস্তবতায় তিন জোটের মনোনীত ব্যক্তি হিসেবে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ প্রথমে উপরাষ্ট্রপতি এবং পরে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন। বিচারপতি পদ থেকে পদত্যাগ না করেই এসব দায়িত্ব পালন করবেন এবং পরবর্তী সময়ে স্বীয় পদে ফেরত যাবেন—এ রকম শর্তেই তিনি দায়িত্ব নিয়েছিলেন।

কিন্তু তখন সংবিধানের বিধান ছিল, রাষ্ট্রের কোনো লাভজনক পদে থেকে কোনো ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি বা উপরাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না। ফলে বিচারপতি পদে থেকে উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে সাহাবুদ্দীনের নিয়োগ, তাঁর ক্ষমতার প্রয়োগ এবং প্রধান বিচারপতি হিসেবে তাঁর আগের পদে ফেরার বৈধতা দিতে সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন দেখা দেয়।

এ বৈধতার জন্য একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে চতুর্থ তফসিলে অনুচ্ছেদ নম্বর ২১(১) যুক্ত করে বলা হয়, ‘...১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর তারিখে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি কর্তৃক উপরাষ্ট্রপতি হিসাবে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ ও শপথ প্রদান এবং তাহার নিকট পদত্যাগ প্রদান এবং…নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হইয়া কার্যভার গ্রহণ করা পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে (যাহাই পরে হউক) উক্ত উপরাষ্ট্রপতি কর্তৃক অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসাবে প্রয়োগকৃত সকল ক্ষমতা, প্রণীত সকল আইন ও অধ্যাদেশ এবং প্রদত্ত, কৃত ও গৃহীত অথবা প্রদত্ত, কৃত ও গৃহীত বলিয়া বিবেচিত সকল আদেশ, সকল কাজকর্ম এবং সকল ব্যবস্থা এতদ্বারা অনুমোদিত ও সমর্থিত হইল এবং আইনানুযায়ী যথার্থভাবে প্রণীত, প্রদত্ত, কৃত ও গৃহীত হইয়াছে বলিয়া ঘোষিত হইল।’

আরও পড়ুন

চতুর্থ তফসিলে ২১(২) নম্বর অনুচ্ছেদে আরও বলা হয়, এ সংশোধনী প্রবর্তনের পর এবং সংবিধান অনুযায়ী নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়ে কার্যভার গ্রহণের পর উক্ত উপরাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির কার্যভার ও দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারবেন।

বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর থেকে ১৯৯১ সালের ৯ অক্টোবর পর্যন্ত অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর তিনি প্রধান বিচারপতি পদে ফেরত যান। সুতরাং এটা স্পষ্ট, সাংবিধানিক শূন্যতা পূরণের জন্য একাদশ সংশোধনী ছিল অপরিহার্য।

তবে প্রধান বিচারপতির পদ বহাল রেখে ‘অস্থায়ী’ রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেশের প্রধান নির্বাহী পদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা পরিচালনা করার পর সাহাবুদ্দীন আহমদের আবার বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ পদে ফেরত যাওয়ার সিদ্ধান্তটি নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁদের মতে, এটা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার মৌলিক ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কিন্তু রাজনৈতিক ঐকমত্য থাকায় বিষয়টি নিয়ে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য হয়নি।

আরও পড়ুন

দ্বাদশ সংশোধনী: ৭০ অনুচ্ছেদ আরও কঠোর

তিন জোটের রূপরেখায় সংসদীয় সরকারপদ্ধতির বিষয়ে যৌথ ঘোষণা দেওয়া হলেও বিএনপি তার দলীয় গঠনতন্ত্রে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারপদ্ধতির কথা বলেছিল। ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে বিএনপি যখন সরকার গঠন করে, সংবিধান অনুযায়ী তখনো দেশে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা বহাল ছিল। বিএনপি প্রথম দিকে এ ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে ছিল।

মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর বিএনপি: সময়–অসময় বইয়ে লিখেছেন, ‘কিছুদিনের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, বিএনপি রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা অব্যাহত রাখতে চাচ্ছে। বেগম জিয়া দেশের প্রেসিডেন্ট হতেই বেশি আগ্রহী ছিলেন। তাই সংবিধান সংশোধনের ব্যাপারে বিএনপির কোনো আশু উদ্যোগ দেখা যায়নি।…’

পরবর্তী সময়ে বিএনপির দলীয় অবস্থান পরিবর্তন হয় এবং তাঁরা সংসদীয় সরকারপদ্ধতি ফিরিয়ে আনতে সম্মত হয়। এ বিষয়ে মওদুদ আহমদ তাঁর বাংলাদেশে গণতন্ত্র: ১৯৯১ থেকে ২০০৬ বইয়ে লিখেছেন, ‘শেষ পর্যন্ত তিন মাস ধরে চিন্তাভাবনার পর বিএনপি নেতারা তাঁদের অবস্থান পরিবর্তন করে মন্ত্রিপরিষদ–শাসিত সরকার প্রবর্তনের পক্ষে সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। তাঁরা অনুধাবন করতে পারেন যে মন্ত্রিপরিষদ–শাসিত সরকারব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের রাষ্ট্রপতির সমান সমানই ক্ষমতার অধিকারী হতে পারেন। এতে আরেকটি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ঝামেলাও এড়ানো সম্ভব হবে। এতে শুধু সংবিধানে এমন আরেকটি সংশোধনীর প্রয়োজন হবে যে প্রধানমন্ত্রী হবেন রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং রাষ্ট্রপতি হবেন রাষ্ট্রের আলংকারিক প্রধান মাত্র।…’

১৯৯১ সালের ১৬ আগস্ট পঞ্চম জাতীয় সংসদে দ্বাদশ সংশোধনী গৃহীত হয়। সরকারি দল বিএনপি এবং প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের ঐকমত্যের ভিত্তিতেই বিলটি পাস হয়েছিল। যেহেতু দ্বাদশ সংশোধনীর বিলটিতে সংবিধানের ৪৮, ৫৬ ও ১৪২ অনুচ্ছেদের বিধানাবলি সংশোধনের প্রস্তাব ছিল, তাই নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি বিলটিকে গণভোটে পেশ করেন।

সরকারপদ্ধতি পরিবর্তনের প্রশ্নে ১৯৯১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দেশে গণভোট হয়। নির্বাচন কমিশনের দেওয়া হিসাব অনুসারে, প্রায় ৩৫ শতাংশ মানুষ ভোট দেন এবং প্রদত্ত ভোটের ৮৪ শতাংশের বেশি বিলটির পক্ষে পড়ে। ১৯৯১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর গণভোটের ফল গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। সংবিধান অনুযায়ী, ওই দিনই বিলটিতে রাষ্ট্রপতি সম্মতি দিয়েছেন বলে ধরে নেওয়া হয়। দ্বাদশ সংশোধনী বিলটি আইনে পরিণত হওয়ায় প্রায় ১৭ বছর পর দেশ আবার সংসদীয় সরকারব্যবস্থায় ফেরত যায়।

’৭২–এর সংবিধানে যেভাবে সংসদীয় সরকারপদ্ধতি ছিল, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সেই বিধানাবলি পুনঃস্থাপিত হয়। রাষ্ট্রপতিকে রাষ্ট্রের নামমাত্র প্রধান করা হয়, সব নির্বাহী ক্ষমতা দেওয়া হয় প্রধানমন্ত্রীকে এবং প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রিসভা যৌথভাবে জাতীয় সংসদের কাছে দায়ী থাকবে—এই বিধানগুলো ফিরিয়ে আনা হয়।

’৭২–এর মূল সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতি মাত্র একটি কাজ স্বাধীনভাবে করতে পারতেন। সেটা হচ্ছে সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থনে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা। দ্বাদশ সংশোধনীতে সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বলা হয়, রাষ্ট্রপতি স্বাধীনভাবে দুটি কাজ করতে পারবেন। এর একটি হলো প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ; আরেকটি হলো প্রধান বিচারপতি নিয়োগ। দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এ পরিবর্তনকে অনেকে ইতিবাচক হিসেবে দেখেন। যদিও প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি কতটা স্বাধীন ভূমিকা পালন করেন, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

আমাদের সংবিধানের একটি বহুল আলোচিত বিষয় হলো ৭০ অনুচ্ছেদ। ’৭২–এর মূল সংবিধানেই ‘দলত্যাগবিরোধী’ এই বিধান ছিল। এতে বলা হয়েছিল, নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হিসেবে মনোনীত হয়ে কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে দুটি কারণে সংসদ সদস্য পদ হারাবেন। কারণ দুটি হলো—(১) যদি দল থেকে পদত্যাগ করেন অথবা (২) যদি সংসদে দলের বিপক্ষে ভোট দেন।

চতুর্থ সংশোধনীতে ৭০ অনুচ্ছেদে একটি ব্যাখ্যা যুক্ত করে বলা হয়েছিল, যদি কোনো সংসদ সদস্য, যে দল তাঁকে নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করেছে, সেই দলের নির্দেশ অমান্য করে—(১) সংসদে উপস্থিত থেকে ভোটদানে বিরত থাকেন অথবা (২) সংসদের কোনো বৈঠকে অনুপস্থিত থাকেন, তাহলে তিনি দলের বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন বলে গণ্য হবে।

দ্বাদশ সংশোধনীতে ‘দলত্যাগবিরোধী’ বিধানটি আরও কঠোর করা হয়। এতে উল্লেখিত চারটির মধ্যে যেকোনো একটি কারণেই রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত কোনো সংসদ সদস্য তাঁর পদ হারাবেন—এমনটি বলা হয়েছিল। এই বিধানের ফলে ‘সাংবিধানিক দলীয় একনায়কত্ব’ (কনস্টিটিউশনাল পার্টি ডিক্টেটরশিপ) কায়েম হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন। যদিও পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৭০ অনুচ্ছেদ আগের অবস্থায় (৭২–এর সংবিধানে বর্ণিত) ফিরে গেছে, তবু এটি নিয়ে এখনো অনেক প্রশ্ন রয়েছে।

তথ্যসূত্র

১.   মওদুদ আহমদ, বাংলাদেশে গণতন্ত্র: ১৯৯১ থেকে ২০০৬, ইউপিএল

২.   মহিউদ্দিন আহমদ, বিএনপি: সময়–অসময়, প্রথমা

৩.   মো. আব্দুল হালিম, সংবিধান, সাংবিধানিক আইন ও রাজনীতি: বাংলাদেশ প্রসঙ্গ, বীকন পাবলিকেশন্স