মা-বাবার জন্মসনদ না থাকলে সন্তানের সঙ্গে অনলাইনে সেতুবন্ধ হবে না

রাজধানীর মেরুল বাড্ডার বাসিন্দা মোসা. মোবাশ্বেরা আক্তার (৩৭) স্বামী ও দুই ছেলের জন্মনিবন্ধনের আবেদন ফরম জমা দেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। গত মঙ্গলবার কারওয়ান বাজারে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৫-এ তাঁর সঙ্গে দেখা হয়। এখন তো সন্তানের জন্মনিবন্ধন করতে মা-বাবার জন্মসনদের বাধ্যবাধকতা নেই। তাহলে তিনি কেন জন্মসনদ করছেন, জানতে চাইলে মোবাশ্বেরা প্রথম আলোকে বলেন, ছেলেরা মাদ্রাসায় পড়ে। মাদ্রাসা থেকে বলা হয়েছে, মা-বাবার জন্মসনদ পরে লাগবে। তাই একসঙ্গে জন্মনিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছেন তাঁরা।

জন্মসনদ পরে কী কাজে লাগবে, তা জানাতে পারেননি মোবাশ্বেরা। তবে এর উত্তর কিছুটা পাওয়া গেছে অঞ্চল ৫-এর সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এস এম ওয়াসিমুল ইসলামের কাছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অনলাইনে মা-বাবার তথ্যের সঙ্গে সন্তানের সব তথ্য যুক্ত করার জন্য ম্যাপিং করতে হয়। ম্যাপিং করতে হলে মা-বাবার জন্মনিবন্ধন নম্বর থাকতে হয়। এর সুবিধা হচ্ছে, প্রয়োজন হলে একসঙ্গে মা-বাবা ও সন্তানের তথ্য সংশোধন করা যায়।

এর মানে হচ্ছে, যে শিশুদের মা-বাবার জন্মসনদ নেই, অনলাইনে সেই শিশুদের মা-বাবার সঙ্গে ই-বন্ডিং অর্থাৎ ইলেকট্রনিক সেতুবন্ধ রচিত হবে না। ফলে সন্তানের জন্মসনদ করতে গিয়ে নিজেদের জন্মসনদ লাগছে না বলে মা-বাবার স্বস্তি পাওয়ার বিষয়টি আদতে কতটা ‘স্বস্তিদায়ক’ হলো, সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

৩ অক্টোবর অঞ্চল-৫-এ লামিয়া আক্তার হুমায়রা নামে ছয় বছরের এক শিশুর জন্মনিবন্ধনের আবেদন জমা হয়। শিশুটির বাবা মোফাজ্জল হোসেন রুবেল এবং মা শারমিন আক্তার ছালমার জন্মনিবন্ধন না থাকায় ফরমের নির্ধারিত ঘর ফাঁকা রাখা হয়। ওই দিন অঞ্চল-৫-এ মোট ৪৯৯টি জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনসংক্রান্ত আবেদন জমা পড়ে।

এর মধ্যে ম্যাপিং ছিল ৬টি, সংশোধন ২৬টি এবং মৃত্যুনিবন্ধন সনদের আবেদন ৩টি। বাকিগুলো জন্মনিবন্ধনের জন্য আবেদন। বছরের এই প্রান্তে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির কারণে আবেদন বেশি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কার্যালয়ের কর্মকর্তারা। অন্য সময় দিনে গড়ে ২০০টির মতো আবেদন জমা হয়।

মা-বাবার জন্মসনদের প্রয়োজনীয়তা থেকেই গেল

২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে নতুন নিয়ম করা হয়েছিল, ২০০১ সালের পর জন্ম নেওয়া ব্যক্তিদের জন্মনিবন্ধন করতে হলে মা-বাবার জন্মনিবন্ধন সনদ অবশ্যই প্রয়োজন হবে। ওই সময় জন্মনিবন্ধন করতে গিয়ে নানা ভোগান্তি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন অভিভাবকেরা। বিতর্কের মুখে গত ২৭ জুলাই সন্তানের জন্মনিবন্ধন করার ক্ষেত্রে মা-বাবার জন্মনিবন্ধনের বাধ্যবাধকতা তুলে দেয় সরকার। এটা এখন ঐচ্ছিক।

শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রাক্‌-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি এবং শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ইউনিক আইডি বা একক পরিচিতি নম্বর তৈরি করছে। কাজটির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগের ‘রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন’। ইউনিক আইডি তৈরিতে মা-বাবার জন্মসনদ থাকা বাধ্যতামূলক নয়। তবে ম্যাপিং বা ই-বন্ডিং করতে হলে মা-বাবার জন্মসনদ ঠিকই প্রয়োজন হচ্ছে।

এ বিষয়ে উপরেজিস্ট্রার জেনারেল মির্জা তারিক হিকমত প্রথম আলোকে বলেন, শুদ্ধ তথ্যভান্ডার তৈরির জন্য সন্তানের সঙ্গে মা-বাবার জন্মনিবন্ধন হওয়া প্রয়োজন। ম্যাপিং হলে অনলাইনে একটি ফ্যামিলি ট্রি বা পারিবারিক তথ্যকাঠামো তৈরি হবে। এতে একটি পরিবারের নির্ভুল তথ্যভান্ডার তৈরি হবে। জাতীয় পর্যায়ের জন্য যা খুব জরুরি। এতে দেশের জনসংখ্যা কত, ১৮-এর নিচের বয়সী জনগোষ্ঠী কত ইত্যাদির যথাযথ তথ্য থাকবে। সে অনুযায়ী পরিকল্পনা নিতে পারবে সরকার। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় সঠিক ব্যক্তিদের আনা যাবে। এ ছাড়া কেউ বিদেশে অভিবাসন করতে চাইলে ই-বন্ডিং লাগবে। সন্তান কাগজপত্র পাঠালে মা-বাবার তথ্য ই-বন্ডিং করে নিতে হয়।

রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের ওয়েবসাইটে প্রায়ই ‘জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন’ বিভাগে বলা আছে, ‘জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধনের শুদ্ধ ডেটাবেজের জন্য “ফ্যামিলি ট্রি” আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত একটি উত্তম চর্চা। বাংলাদেশ এটি গ্রহণ করেছে। এই পদ্ধতিতে সন্তানের জন্মনিবন্ধনের সঙ্গে পিতা-মাতার জন্মনিবন্ধন নম্বর যুক্ত করে একটি পারিবারিক কাঠামো তৈরি করা হয়, যাতে পিতা-মাতার সন্তানের সংখ্যা এবং তাদের ক্রমিক নম্বর জানা যায়। এর মাধ্যমে উত্তরাধিকার নিশ্চিত হয় এবং অনৈতিকভাবে বয়স বা অন্যান্য তথ্য পরিবর্তনের প্রবণতা রোধ করা সম্ভব হয়। এই পদ্ধতি বাংলাদেশে ভবিষ্যতে “পপুলেশন রেজিস্টার” প্রণয়নে সহায়ক হবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিককে বিষয়টি ভালোভাবে বুঝিয়ে এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করে নিবন্ধন করিয়ে নিতে হবে।’

মা-বাবার জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে কেন ই-বন্ডিং করা যাবে না জানতে চাইলে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কর্মকর্তারা জানান, একজন ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে তাঁর সন্তানের তথ্য অনলাইনে যুক্ত থাকে না। ১৮ বছর বয়সের বেশির ভাগ মানুষ বিবাহিত নন। ফলে ই-বন্ডিং করতে হলে জন্মনিবন্ধনের মাধ্যমেই হতে হবে।

পথশিশু ও মা-বাবার সঙ্গে বিচ্ছেদ শিশুর ই-বন্ডিং হবে না

মা-বাবার জন্মসনদ যখন বাধ্যতামূলক ছিল, তখন পথশিশু যারা মা-বাবার কোনো একজন বা দুজনের কাছ থেকেই বিচ্ছিন্ন এবং বিবাহবিচ্ছেদ পরিবারের সন্তান যাদের কেউ কেউ মা বা বাবার সঙ্গে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন, তাদের জন্য মা-বাবার জন্মসনদ পাওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছিল।

মা-বাবার জন্মসনদ যখন বাধ্যতামূলক ছিল, তখন বিবাহবিচ্ছেদ হওয়া মা-বাবার সন্তান ও পথশিশুদের ক্ষেত্রে মা-বাবার জন্মসনদ পাওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। এ শিশুদের জন্মনিবন্ধনের আবেদন ফরম পূরণের সময় মা-বাবার নামের জায়গায় ‘অজ্ঞাত’ লিখতে হতো। এটাকে শিশুদের জন্য ‘অসম্মানজনক’ উল্লেখ করে বিভিন্ন মহল থেকে আপত্তি ওঠে। সরকার মা-বাবার জন্মসনদের বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে বিষয়টিও বিবেচনায় রাখে। তবে ম্যাপিং বা ই-বন্ডিংয়ের সুবিধা পাবে না এই শিশুরা। অর্থাৎ সরকারের ই-বন্ডিং পরিকল্পনা হয়েছে পথশিশু, মা-বাবার সঙ্গে বিচ্ছেদ শিশুদের বাদ দিয়েই।

আরও পড়ুন

এ বিষয়ে উপরেজিস্ট্রার জেনারেল মির্জা তারিক হিকমত বলেন, পদ্ধতিগুলো ডিজিটাল করার পর ধাপে ধাপে বেশ কিছু সমস্যা চিহ্নিত হচ্ছে। সেগুলোর সমাধানও হচ্ছে। তবে পথশিশু ও বিবাহবিচ্ছেদ পরিবারের শিশুদের ই-বন্ডিংয়ের আপাতত সুযোগ নেই। এটা নিয়ে কী করা যায়, তা আলোচনা করে সমাধানের উপায় খুঁজে বের করা হবে।

কেউ জন্মনিবন্ধনে মা-বাবার নাম বা তথ্য সংশোধন করতে চাইলে আঞ্চলিক কার্যালয়গুলো থেকে বলা হয়, মা-বাবার তথ্য সংশোধন করতে হলে আগে মা-বাবার জন্মনিবন্ধন করতে হবে। এরপর সন্তানের সঙ্গে মা-বাবার জন্মসনদের ম্যাপিং করতে হবে।

এ বিষয়ে উপরেজিস্ট্রার জেনারেল বলেন, ‘এটা ভুল কথা। ম্যাপিং না থাকলেও মা-বাবার নাম-তথ্য সংশোধন করা যায়। তবে ম্যাপিং করা থাকলে সুবিধা হচ্ছে, এক আবেদনের মাধ্যমেই যা যা সংশোধন করা দরকার, তা করা যায়।’ তিনি বলেন, যিনি যে কার্যালয় থেকে জন্মনিবন্ধন করেছেন, তিনি সে কার্যালয়ে গিয়ে যেকোনো সময় ম্যাপিং করিয়ে নিতে পারেন। সন্তানের জন্মনিবন্ধন যদি আগে হয়ে থাকে, তাহলে মা-বাবা পরে জন্মনিবন্ধন করেও ম্যাপিং করে নিতে পারবেন।

আরও পড়ুন

সবাইকে জন্মনিবন্ধনের আওতায় আনার লক্ষ্য

জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আইন ২০০৪ (২০১৩ সালে সংশোধিত) এবং জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন বিধিমালা ২০১৮-এর মাধ্যমে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন করা হয়। কাজটিকে আরও গতিশীল করার লক্ষ্যে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন নির্দেশিকা ২০২১ প্রণয়ন করা হয়। বিধিমালা অনুসারে, জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে জন্মনিবন্ধন এবং মৃত্যুর ৪৫ দিনের মধ্যে মৃত্যুনিবন্ধন করতে হবে।

আইন কার্যকরের পর এ পর্যন্ত মোট জন্মনিবন্ধন হয়েছে ২১ কোটি ১১ লাখের মতো। আর মৃত্যুনিবন্ধন হয়েছে ২৫ লাখের বেশি। এ বছরের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ৯ মাসে জন্মনিবন্ধন হয়েছে ১ কোটি ৮৯ লাখের বেশি, যা গত বছরের তুলনায় ৪০ হাজার বেশি। গত ৯ মাসে জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে জন্মনিবন্ধন হয়েছে ৪ লাখ ৮০ হাজারের বেশি, যা গত বছরের তুলনায় সোয়া ২ লাখ বেশি। এ সময় জন্মের ৪৬ দিন থেকে এক বছর বয়স পর্যন্ত জন্মনিবন্ধন হয়েছে ৬ লাখ ৩২ হাজারের বেশি শিশুর।

২০১৫ সালে জাতিসংঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিকের (ইউএনএসকেপ) সঙ্গে সরকারের সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত জন্মের এক বছরের মধ্যে শতভাগ জন্মনিবন্ধন হতে হবে। আর মৃত্যুনিবন্ধন হতে হবে ৫০ শতাংশ।

আরও পড়ুন

রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. রাশেদুল হাসান বলেন, শতভাগ লোককে জন্মনিবন্ধনের আওতায় আনার লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলছে। ১৮ বছর বয়সের পর একজন জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পান। এর কম বয়সী শিশুদের জন্য ১০ সংখ্যার ইউনিক আইডি করা হচ্ছে। ওই শিশুদের বয়স ১৮ বছর হলে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির জন্য বায়োমেট্রিক নেওয়া হবে। এরপর তাঁর ইউনিক আইডির নম্বরই হবে এনআইডি নম্বর।

গত দেড় বছরে ৩৪ লাখ ইউনিক আইডি তৈরি হয়েছে। দেড় মাস আগে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদেরও ইউনিক আইডি তৈরি শুরু হয়েছে। একটি শিশু টিকা নেওয়া থেকে শুরু করে তার শিক্ষার প্রতিটি পর্যায়ের তথ্য থাকবে ইউনিক আইডিতে। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে ইউনিক আইডির তথ্যগুলো অনলাইনে যুক্ত হবে।

অর্থাৎ জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একটি নম্বরের মাধ্যমে সব জায়গায় পরিচিত হবেন একজন ব্যক্তি। সব মিলিয়ে অনলাইনভিত্তিক একটি শুদ্ধ তথ্যভান্ডার গড়ে উঠবে। একটি পরিবারের জন্য এই তথ্যভান্ডার ব্যবহারের সুবিধা বাড়াবে ই-বন্ডিং।