টোকিওতে মনজুরুল হকের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই নিয়ে আলোচনা, ছিলেন বিদেশি সাংবাদিকেরা
‘এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’—সেই কবে এই অসাধারণ কবিতা লিখেছিলেন কবি হেলাল হাফিজ। আজও অক্ষয়–শাণিত এই বাণী। কিন্তু প্রতিবাদ, লড়াই, আন্দোলনে যোগ দেওয়ার সুযোগ তরুণেরা পেলেও যুদ্ধযাত্রার দেখা মেলা বিরল। আর সেই যুদ্ধ যদি হয় বহিঃশত্রুর দীর্ঘ শোষণ-নিপীড়ন আর ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যার বিপরীতে, এমন সুযোগ হয়তো একবারই আসে তরুণ প্রজন্মের জীবনে। যাঁরা সময়ের সেই ডাকে সাড়া দিতে পারেন, তাঁদের ত্যাগ, সংগ্রাম, উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতা অনন্য।
দীর্ঘ পাঁচ দশক আগে এই জনপদে এ রকম গাঢ় কৃষ্ণপ্রহর ফুঁড়ে রচিত হয়েছিল বীরত্বের এক নয়া ইতিহাস। এর কেন্দ্রে যাঁরা ছিলেন তাঁরা আর কেউ নন, এ দেশেরই মুক্তিকামী সাধারণ জনতা। যাঁদের নিরন্তর লড়াই ও অকুণ্ঠ সমর্থনে বিজয়ের সূর্যালোক ছুঁয়েছিল বিপর্যস্ত বাংলার মুখ। এসব যোদ্ধার সিংহভাগই ছিলেন টগবগে তরুণ, সময়ের প্রয়োজনে যাঁরা যুক্ত হয়েছিলেন দেশমাতৃকার লড়াইয়ে, সার্থক করেছিলেন কবির ভাষ্য। তবে সময়ের পরিক্রমায় কমে আসছে তাঁদের সংখ্যা। যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের জবানিতে মুক্তিযুদ্ধের বয়ান তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে এই ইতিহাস মুছে ফেলা, বিকৃত করা বা খণ্ডিতকরণের চেষ্টা বরাবরই জারি আছে বাংলাদেশে।
আশার দিক হচ্ছে, শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মতো অনেকেই লিপিবদ্ধ করে গেছেন সেই গৌরবগাথা, সমৃদ্ধ করেছেন আমাদের লড়াকু ইতিহাসের আখ্যান। তবে ১৯৭১ সালের নির্বিচার গণহত্যা ও এর বিপরীতে মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধের যে ব্যাপ্তি ও গুরুত্ব, ইংরেজি ভাষ্যে তার বিবরণ খুব একটা বেশি নয়। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক চর্চার আলোকে সৃষ্ট ধোঁয়াশা এবং নতুন বিশ্ব বাস্তবতায় চলমান অস্থিরতা ও যুদ্ধ-সংঘাতের পটভূমিতে ইতিহাসের এই অন্যতম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বিবরণ বিশ্ববাসীর কাছে হাজির করা তাই প্রাসঙ্গিক ও জরুরি এক উদ্যোগ। বিশেষ করে, উত্তর প্রজন্ম যেন সঠিক ইতিহাসের আলোকে বর্তমানকে অনুধাবন করে ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা পায়, এদিক থেকে এর গুরুত্ব অপরিসীম। জাপান প্রবাসী লেখক ও একাত্তরের গেরিলা যোদ্ধা মনজুরুল হক চলতি বছরের শুরুতে তাঁর সর্বসাম্প্রতিক গ্রন্থ ‘আ টাইম টু ড্রিম অ্যান্ড আ টাইম অব ডিসপেয়ার’-এ সেই গুরুত্বপূর্ণ কাজটিই করেছেন।
এটি অবশ্য লেখকের ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে কসমস বুকস প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর ঘটনাপ্রবাহ বা পটভূমিনির্ভর বই ‘আ স্টোরি অব মাই টাইম’–এর ধারাবাহিকতায় লেখা দ্বিতীয় গ্রন্থ। পূর্বেকার বইটিতে মূলত তিনটি সমান্তরাল ধারায় বিবৃত হয় ইতিহাসের বয়ান। এতে তাঁর নিজের বেড়ে ওঠার পাশাপাশি ১৯৫০-৬০–এর দশকে মফস্সলের আবহ থেকে ঢাকার একটি পরিপূর্ণ শহর হয়ে ওঠার গল্প এবং সেই সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের ক্রমে চূড়ান্ত এক পরিণতির দিকে আগোনোর চিত্র অপ্রথাগত আদলে তুলে ধরেন লেখক। আর সেই বইয়ে তাঁর কলম থেমে যায় ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চে।
এ বিষয়ে লেখকের ভাষ্য হচ্ছে, যেহেতু এর পর থেকে মুক্তিযুদ্ধের শুরু এবং এটি নিয়ে বাংলায় অনেকেই ইতিমধ্যে লিখেছেন, তাই সেই উপাখ্যান এড়িয়ে বরং কীভাবে আমরা জাতি হিসেবে এ রকম ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে উপনীত হলাম, তার পটভূমি রচনাকারী ঘটনাবলি উপস্থাপনের মাঝেই তিনি নিজেকে সীমিত রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বইটির পাঠক ও তৎকালীন অনেক সতীর্থ-সহযোদ্ধার ক্রমাগত অনুরোধে লেখক শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে তাঁর স্বচক্ষে অবলোকন করা নানা ঘটনাবলি এবং মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন সাবলীল ইংরেজিতে ‘আ টাইম টু ড্রিম অ্যান্ড আ টাইম অব ডিসপেয়ার’ নামের নতুন এ রচনায়।
এখানে উল্লেখযোগ্য, কসমস ফাউন্ডেশনের সহায়তায় দুটি বইই প্রকাশ করেছে কসমস বুক। কিছুটা ভিন্ন আদলে প্রকাশিত এই প্রকাশনা দুটির অন্যতম একটি সংযোজন হচ্ছে কাহিনির নিরিখে দুই শিল্পীর অঙ্কিত মৌলিক ছবি। প্রথম বইয়ে কাজটি করেছিলেন তরুণ শিল্পী বিশ্বজিৎ গোস্বামী। আর নতুন বইটিতে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাক্রমের উল্লেখ থাকা মোট ১৪টি অধ্যায়ের প্রতিটির শুরুতেই যুক্ত হয়েছে সংশ্লিষ্ট বিষয়বস্তুনির্ভর শিল্পী সৌরভ চৌধুরীর শিল্পকর্ম। গত জানুয়ারি মাসে ঢাকায় কসমস গ্যালারিতে এর প্রকাশনা অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছিল শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতাঙ্গনের অনেক গুণী ব্যক্তির উপস্থিতিতে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৮ জুলাই টোকিওতে বিদেশি সাংবাদিকদের বিখ্যাত ক্লাব এফসিসিজেতে (ফরেন করেসপনডেন্ট ক্লাব অব জাপান) অনুষ্ঠিত হয়ে গেল গুরুত্বপূর্ণ এ রচনার পরিচিতিমূলক আরেকটি উল্লেখযোগ্য আয়োজন।
সেদিন গ্রীষ্মের পড়ন্ত বিকেলে টোকিওর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত অভিজাত মারুনুচি ভবনে থাকা ক্লাবের মিলনায়তন ক্রমে ভরে উঠছিল জাপানে কর্মরত বিদেশি সাংবাদিক, জাপানি শিক্ষাবিদ ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের একাংশের পদচারণে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানে আসা মার্কিন সাংবাদিকদের হাতে গড়ে ওঠা এই ক্লাব জাপানের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, যেখানে জাপানসহ সারা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের আগমন একটি নিয়মিত ঘটনা। সে রকম একটি স্থানে বর্ষীয়ান মার্কিন সাংবাদিক ব্র্যাডলি মার্টিনের সঞ্চালনায় আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় এ আয়োজন। অনুষ্ঠানের শুরুতেই লেখক মনজুরুল হকের নানামুখী কর্মজীবনের ওপর আলোকপাত করেন সঞ্চালক। তাঁর ভাষ্যে জানা যায়, মনজুরুল হক একাধারে লেখক, সাংবাদিক ও শিক্ষক। মস্কো বিশ্ববিদ্যালয় ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পাশাপাশি প্রযোজক হিসেবে কাজ করেছেন বিবিসি লন্ডনে। এরপর ১৯৯৪ সাল থাকে শুরু হয় তাঁর জাপান জীবন। জাপানের নাগরিক সম্প্রচারকেন্দ্র এনএইচকের বাংলা সার্ভিসে কাজ করার পাশাপাশি টোকিওর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে শিক্ষকতা করছেন। অন্যদিকে প্রথম আলোর জাপান প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করার সুবাদে তিনি এফসিসিজের নির্বাচিত সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন ২০০৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত। তাঁর এই বর্ণিল কর্মযজ্ঞের সঙ্গে তাল মিলিয়ে লেখক হিসেবেও তিনি কম বৈচিত্র্যপূর্ণ নন। ইতিহাস, শিল্পকলা, সংস্কৃতি, কবিতার অনুবাদ ও আত্মজীবনীসহ তাঁর ১২টির মতো বই প্রকাশিত হওয়ার কথা উল্লেখ করেন সঞ্চালক মার্টিন, যার সর্বশেষ উদাহরণ ‘আ টাইম টু ড্রিম অ্যান্ড আ টাইম অব ডিসপেয়ার’ নামের গ্রন্থটি।
এরপর সঞ্চালকের অনুরোধে বইটি রচনার কারণ ও পটভূমি উল্লেখ করতে গিয়ে লেখক মনজুরুল হক বলেন, জীবনের দীর্ঘ কর্মমুখর পথ পাড়ি দিয়ে এক সন্ধিক্ষণে এসে ইতিহাসের প্রতি দায় তিনি অনুভব করেছেন। বিশেষ করে, বিস্মৃতি ও বিভ্রমের এই কালে, স্বচক্ষে দেখা ঐতিহাসিক ঘটনাগুলো তুলে ধরার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গৌরবময় ও সংগ্রামী কালের দিকে নতুন প্রজন্মের নির্মোহ দৃষ্টিপাতের উদ্রেক ঘটানোই ছিল তাঁর লক্ষ্য। অন্যদিকে বিদেশি পাঠকের জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক রচনার স্বল্পতা থাকায় নিজের দীর্ঘ প্রবাসজীবনে ইংরেজিতে এ ইতিহাস লেখার অপরিহার্যতা অনুভব করেছেন তিনি বরাবর। এটি এই বিষয়ক তাঁর দ্বিতীয় বই এমন উল্লেখ করে মনজুরুল হক এ–ও বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি রচনাকারী পঞ্চাশ–ষাট দশকের ঢাকার চিত্র তুলে ধরা প্রথম বইটি ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চের ঘটনায় শেষ হওয়ায়, দ্বিতীয় এই গ্রন্থে ২৫ মার্চ কালরাতে ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার চাক্ষুষ বর্ণনা থেকে শুরু করে ১৭ ডিসেম্বর একজন গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে মুক্ত ঢাকায় পুনঃপ্রবেশ পর্যন্ত নানা গুরুত্বপূর্ণ আখ্যান বিশদভাবে তুলে ধরেছেন তিনি। সঞ্চালকের বিশেষ অনুরোধে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার টান টান উত্তেজনাকর বিপৎসংকুল এক যাত্রা এবং সীমান্তের ওপারে মুখোমুখি হওয়া অপ্রত্যাশিত ঘটনাবলির বর্ণনাও দেন তিনি, যার বিস্তৃত উল্লেখ বইটিতে রয়েছে। এর পাশাপাশি, একাত্তরের ২৬ মার্চ কারফিউ শিথিল হওয়ার সুযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে মৃত অবস্থায় দুই স্কুলবন্ধুর সন্ধান পাওয়া, সন্ত্রস্ত শহরজুড়ে নানা ধ্বংসযজ্ঞ, নিরাপত্তার খোঁজে ঢাকা ছেড়ে বারবার গ্রামমুখী হওয়া, আগরতলায় যুদ্ধের প্রশিক্ষণ, গেরিলা হিসেবে পুনর্বার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পদার্পণ করে জনতার অভূতপূর্ব সমর্থনপ্রাপ্তি এবং পরিশেষে, হানাদারমুক্ত রাজধানীতে ফিরে আসার বিস্তারিত বর্ণনাও নিপুণ লেখনীতে উঠে এসেছে এই বইয়ে।
লেখক-সঞ্চালকের প্রারম্ভিক আলাপ পর্ব শেষে শুরু হয় উপস্থিত সাংবাদিক ও অতিথিদের অংশগ্রহণে বেশ জমজমাট এক প্রশ্নোত্তর পর্ব। ব্রিটিশ সাংবাদিক অ্যান্থনি রাওলি প্রথম জানতে চান ‘হোপ’ এবং ‘ডিসপেয়ার’ অর্থাৎ আশা ও বিপন্নতার যে উল্লেখ বইয়ের নামে রয়েছে, এটি কি স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে লেখকের বর্তমান সময়ের অনুভূতি? এর উত্তরে লেখক মনজুরুল হক বলেন, লেখার মূল প্রতিপাদ্য ১৯৭১ সাল হওয়ায় বইয়ের নাম জুড়ে বর্তমান নয়; বরং সে সময়ে তার মনে স্বদেশকে ঘিরে দেখা দেওয়া আশা আর বিপন্নতার এই দুই বিপ্রতীপ বোধই প্রতিফলিত হয়েছে। গান্ধীবাদী ভারতীয় শিক্ষক ও গবেষক বিবেক পিন্টো জানতে চান, একাত্তরের সংঘাত অহিংসভাবে সমাধানের কোনো সুযোগ ছিল কি না? প্রত্যুত্তরে নৃশংস সহিংসতা যে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীই বাঙালির ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল, সেটি স্মরণ করিয়ে দিয়ে লেখক বলেন, বাঙালির প্রতিরোধ ছিল সেই নির্মমতার বিপরীতে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা এবং স্বাধীনতা অর্জনের লড়াই। জর্ডানীয় সাংবাদিক খালদুন আজহারি মুক্তিযুদ্ধের এই গণহত্যার কথা উল্লেখ করে আজকের দিনের রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের সমস্যার দিকে আলোকপাত করেন। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশি আইনের ছাত্রী পারমিতা ভট্টাচার্য একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি কেন এখনো অর্জন করা গেল না, সেই বিষয়ে জানতে চাইলে, লেখক বলেন, এ ক্ষেত্রে অনেকটাই এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘের মতো প্রতিষ্ঠান থেকে এখনো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না মিললেও অন্যান্য অনেকেই সেটি দিতে শুরু করেছে।
প্রসঙ্গ পাল্টে প্রবীণ জার্মান সাংবাদিক ক্রিস্তফ নাইটহার্ড মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশের প্রতি সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার সঙ্গে পরবর্তী সময় লেখকের মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কোনো সম্পর্ক রয়েছে কি না জানতে চাইলে মনজুরুল হক বলেন, শুরুর দিকে অন্য কোনো দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি এবং সেই সুবাদে স্কলারশিপের সুযোগ না থাকায় তিনি মুক্তিযুদ্ধোত্তরকালে মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েছিলেন। যুদ্ধে হেরে যাওয়া ব্যক্তিরা পরবর্তী সময় বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিয়েছিল কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে লেখক আটকে পড়া পাকিস্তানিদের যে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, তার উল্লেখ করেন। ব্রিটিশ সাংবাদিক জোয়ান অ্যান্ডারসন জানতে চান মুক্তিযুদ্ধে নারীদের ভূমিকা কী ছিল? প্রত্যুত্তরে চিকিৎসাসহ সাংস্কৃতিক লড়াইয়ে অংশগ্রহণের পাশাপাশি সরাসরি যুদ্ধেও নারীদের সীমিত পরিসরে অংশগ্রহণের তথ্য জানান মনজুরুল হক। অনুষ্ঠানে উপস্থিত টোকিও ইউনিভার্সিটি অব ফরেন স্টাডিজের ‘বেঙ্গল স্টাডিজ’ বিভাগের প্রধান তারিক শেখ একটু ভিন্ন প্রসঙ্গের অবতারণা ঘটিয়ে তাঁর নিজস্ব গবেষণার নিরিখে জানতে চান, মুক্তিযুদ্ধে সংগীতের ভূমিকা কী ছিল? লেখক মনজুরুল হক তখন চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘মুক্তির গান’-এর প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘বিশ্বের অন্যান্য যেকোনো লড়াই-সংগ্রামের মতোই বাংলাদেশেও শিল্পীরা গান, কবিতাসহ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধে।’ এ প্রসঙ্গে তিনি প্রশিক্ষণ শিবিরে একবার অপারেশনে যাওয়ার আগে সারা রাত তাঁর সতীর্থদের গণসংগীত গাওয়ার কথা তুলে ধরেন, এর এক দিন পর কুমিল্লার বেতিয়ারায় শত্রুবাহিনীর অ্যামবুশে যাঁদের মধ্যে অনেকেই প্রাণ হারিয়েছিলেন। বইয়ে বিবৃত হয়েছে এ ঘটনা।
শ্রীলঙ্কার সাংবাদিক শুভেন্দ্রিনি কাকুচি জানতে চেয়েছিলেন, নতুন প্রজন্মের জন্য লেখকের বার্তা কী? তার জবাবে লেখক বলেন, পূর্বপ্রজন্মের ত্যাগ ও লড়াইয়ের ইতিহাস যেন তারা বিস্মৃত না হয়। এটিকে ধারণ ও ছড়িয়ে দেওয়া তাদের কর্তব্য। অন্যদিকে স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে কোন পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে, এমন পরামর্শ চাওয়ার বিপরীতে লেখক বলেন, এই আত্মজীবনী লিখতে গিয়ে স্মৃতির সীমাবদ্ধতার কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁকে কল্পনারও শরণাপন্ন হতে হয়েছে সীমিত পরিসরে। এ রকম পরিস্থিতিতে লেখককে অবশ্য সতর্ক থাকতে হবে এর বিস্তার যেন সত্যের ছায়াকে মাড়িয়ে না যায়। অর্থাৎ স্মৃতি যেখানে অস্পষ্ট সেখানে কল্পনার মিশেল বাস্তবতার নিরিখেই হতে হবে। তিনিও তা–ই করেছেন এবং এই আত্মজীবনীকে তিনি সেই অর্থে অনেকটা সেমি-ফিকশনাল রচনা বলে অভিহিত করেন।
প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে চলা এই অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন জাপানের বিশিষ্ট রবীন্দ্রগবেষক অধ্যাপক কিওকো নিওয়া ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক গবেষক অধ্যাপক মাসাআকি ওহাশিসহ দেশি-বিদেশি আরও অনেক সাংবাদিক ও দর্শক। আলোচনা শেষে অনেককেই অনুষ্ঠানস্থলে থাকা বই কিনে তাতে লেখকের স্বাক্ষর নিতে দেখা গেছে। এর পাশাপাশি উপস্থিত সুধীজনের নানা মন্তব্য ও প্রশ্নোত্তরে সেদিন জাপানের এই বিখ্যাত ক্লাবে অনুরণিত হচ্ছিল যেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেরই জয়গান। অনুষ্ঠান কক্ষের দেয়ালে সেদিন আরও যুক্ত হয়েছিল বইয়ে প্রকাশিত মূল ছবিগুলোর একাংশ। অতিথিরা আলোচনার ফাঁকে সেদিকে নজর দিতেও ভোলেননি আর স্মরণ করেছেন সেই সব নিপীড়িত জনতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের, যাঁরা প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য নিজেদের সর্বস্ব ত্যাগ করেছিলেন। সময়ের পরিক্রমায় উত্তর প্রজন্ম নিশ্চয়ই সব বিভ্রান্তি ভুলে মুক্তিযুদ্ধের যে মূল লক্ষ্য, একটি শোষণমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পথেই হাঁটবে, সেই প্রত্যাশাই ফুটে উঠেছে দেশ থেকে হাজার মাইল দূরের এই অনুষ্ঠানস্থলে। অন্যদিকে টোকিও নিজেই তো গত শতাব্দীর মধ্যভাগে প্রত্যক্ষ করেছিল যুদ্ধের নিদারুণ বিভীষিকা। মনজুরুল হকের ‘আ টাইম টু ড্রিম অ্যান্ড আ টাইম অব ডিসপেয়ার’-কে নিয়ে এফসিসিজের এ আয়োজন যেন সেদিক থেকে দেখলে যুদ্ধের ভয়াবহতাকে অনুধাবনের মাধ্যমে শান্তির পথ অনুসরণের সময়োপযোগী বৈশ্বিক আহ্বানই তুলে ধরে পুনর্বার।