ব্রেস্ট ক্লিনিক
আপনি নারী বা পুরুষ হোন, স্তনের সমস্যায় অবহেলা নয়
রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ব্রেস্ট ক্লিনিকে নারী ও পুরুষের স্তনের বিভিন্ন সমস্যার চিকিৎসা হচ্ছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, স্তনের সমস্যাকে অবহেলা করা যাবে না। আবার অযথা ভয় পেলেও চলবে না। লজ্জা-ভয়কে দূরে ঠেলে চিকিৎসকের কাছে আসতে হবে।
‘ভালো আছেন, ভয়ের কিছু নেই’ চিকিৎসকের মুখ থেকে এ আশ্বাসবাণী শুনে মেয়েটির মুখের হাসি চওড়া হলো। তবু কপালে কিছুটা চিন্তার ভাঁজ। আবার জানতে চাইলেন, ‘অস্ত্রোপচার বা অন্য কিছু করতে হবে না তো?’ চিকিৎসক আবার অভয় দিয়ে বললেন, ‘আপাতত কিছুই লাগবে না।’
রাজধানীর শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ব্রেস্ট ক্লিনিকে গিয়ে চোখে পড়ে এমন ঘটনা। সম্প্রতি এ ক্লিনিকে আসা একজনকে এভাবেই অভয় দেন চিকিৎসক শরমিন আক্তার।
তবে স্তনের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আসা নারী ও পুরুষদের সবাইকে যে তিনি এই অভয়বাণী শোনাতে পারছেন, তা নয়। কাউকে কাউকে পরামর্শ দিচ্ছেন ব্যক্তিগত ব্যস্ততা কমলে অস্ত্রোপচার সেরে ফেলতে।
প্রতি মঙ্গলবার এই ক্লিনিকে বহির্বিভাগে রোগী দেখা হয়। ২০ থেকে ২৫ জন রোগী আসেন স্তনের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে। চিকিৎসকেরা বলছেন, এ ধরনের সমস্যা নারী, পুরুষ বা ভিন্ন লিঙ্গের যে কারও হতে পারে। তবে ক্লিনিকে এখন পর্যন্ত কোনো হিজড়া বা ভিন্ন লিঙ্গের কেউ সেবা নিতে আসেননি।
ব্রেস্ট ক্লিনিকে আসা একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁদের কেউ কেউ এসেছেন ঢাকার পার্শ্ববর্তী একাধিক জেলা থেকে। মা, মেয়ে বা ছেলেকে নিয়ে এসেছেন। কেউ এসেছেন পরিচিত কোনো নারীর সঙ্গে। শিক্ষার্থীরা এসেছেন কোনো বান্ধবীর সঙ্গে।
এখানে সেবা নিতে আসা ব্যক্তিদের স্তনের সমস্যা ও পরামর্শ নিয়ে তৈরি লিফলেট দেওয়া হয়। এতে রয়েছে নিজে নিজে স্তন পরীক্ষার উপায়। এ ছাড়া ম্যাস্টালজিয়া বা স্তনের ব্যথা ও স্তন ক্যানসার সচেতনতা এবং স্তনের নানা নিরীহ সমস্যা নিয়ে নানা তথ্য ও পরামর্শ রয়েছে।
গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ক্লিনিকটি আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে। শুরু থেকে ২১ জুন পর্যন্ত সেবা নিতে আসা মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭৪৬। এর মধ্যে স্তন ক্যানসার নিয়ে এসেছেন ৩৯ জন। ক্লিনিকটিতে নারীরা সমস্যা নিয়ে এলে নারী চিকিৎসক পরীক্ষা করে দেখেন। আর ছেলেদের জন্য আছেন ছেলে চিকিৎসক।
ব্রেস্ট ক্লিনিকের সহকারী অধ্যাপক শরমিন আক্তার বললেন, দেশের কয়েকটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ব্রেস্ট ক্লিনিক চালু হয়েছে। তবে এখানে ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্ট তথা স্তনের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য সিলিকন ব্যবহার করে সুগঠিত করা, স্তনের আকার অস্বাভাবিক বড় হয়ে গেলে ছোট করা, কোনো কারণে পুড়ে গেলে স্তন পুনর্গঠন করার সেবা পাওয়া যায়। একই সঙ্গে স্তন ক্যানসার হলে স্তন না কেটে অস্ত্রোপচার করা, স্তনের চাকা, স্তন ক্যানসারসহ পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসার জন্য কেন্দ্রটি সক্ষমতা অর্জন করেছে বলে তিনি জানান। এতে স্তনের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। অস্ত্রোপচারসহ নানা চিকিৎসায় খরচ নেই বললেই চলে।
ক্লিনিকে কর্মকর্তারা বলেন, ক্লিনিকে যাঁরা আসছেন, তাঁদের বড় একটি অংশ আসছেন স্তনে চাকা বা ব্যথা নিয়ে। তাঁরা আসছেন এতে ভয়ের কিছু আছে কি না, তা জানার জন্য। তবে অনেকে স্তন ক্যানসার নিয়ে একেবারে শেষ পর্যায়ে আসছেন। তখন ওই রোগীকে আর বাঁচানো সম্ভব হয় না।
ক্লিনিকে এসেছেন ২৪ বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে এক মা। মা বলছিলেন, ছেলে ছোটবেলা থেকেই স্বাস্থ্যবান। তবে ইদানীং ছেলের স্তন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশ বড় হয়ে গেছে। ছেলে এ নিয়ে লজ্জায় থাকে। ছেলেটিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে চিকিৎসকেরা জানালেন, তাঁর যে সমস্যা, তাতে অস্ত্রোপচার লাগবে।
এই ব্রেস্ট ক্লিনিক থেকে পাওয়া তথ্য বলছে, ক্লিনিক চালুর শুরু থেকে ২১ জুন পর্যন্ত স্তনের আকার বড় হয়ে যাওয়া সমস্যা নিয়ে মোট ছয় পুরুষ সেবা নিতে এসেছেন।
ক্লিনিকেই কথা হলো এক মায়ের সঙ্গে। সঙ্গে ছিল শিশুসন্তান। এই মা জানালেন, তিনি বুঝতে পারছেন, তাঁর স্তনের আকার স্বাভাবিকের চেয়ে বড় হয়ে গেছে। ব্যথাও হয়। কাজ করতে সমস্যা হয়। স্বামীই তাঁকে এ ক্লিনিকে নিয়ে এসেছেন।
স্তনের সমস্যা নিয়ে মেয়েদের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে, তার প্রমাণও পাওয়া গেল। একজন উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষার্থী নিজেই সমস্যার কথা জানাতে ক্লিনিকে এসেছেন। বললেন, বাসায় সবাই যাঁর যাঁর কাজে ব্যস্ত, তাই তিনি একাই এসেছেন। তবে বাসায় মা–বাবা তার সমস্যাটির কথা জানেন।
তবে ভিন্ন কিছু সমস্যাও আছে। পড়াশোনা শেষ করে চাকরির অপেক্ষায় থাকা এক যুবক বারবার চিকিৎসককে বলছিলেন, তাঁর স্তনের আকার বড় হয়ে গেছে। অন্যরা গরমে টি-শার্ট ছাড়া থাকতে পারলেও তিনি পারেন না। চাকরির পরীক্ষার জন্যও মনোযোগ দিতে পারছেন না। তাই অস্ত্রোপচার করে স্তনের আকার ছোট করতে চান। চিকিৎসক তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন, সমস্যাটি শারীরিক নয় মানসিক। কারণ, পরীক্ষায় কিছু ধরা পড়েনি। তিনি তাঁকে মনোচিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বলেন।
এই ক্লিনিকে অস্ত্রোপচার করিয়ে এখন ভালো আছেন, এমন এক তরুণীর সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হয় প্রথম আলোর এই প্রতিবেদকের। স্তনের আকার বড় হয়ে যাচ্ছিল ওই তরুণীর। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা নিলেও কোনো লাভ হয়নি। এরপর ঢাকার বাইরের এক চিকিৎসক অস্ত্রোপচার করে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব বলে জানান। তবে দুই লাখ টাকা লাগবে বলে জানিয়েছিলেন। পরিবারের আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় তা ছিল অসম্ভব।
মুঠোফোনে এই প্রতিবেদককে তরুণী জানালেন, এই ক্লিনিক থেকে চিকিৎসা নেওয়ার পর তিনি এখন ভালো আছেন। অন্য নারীদের মতো তিনিও স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন।
চিকিৎসা নেওয়ার বিষয়ে এই তরুণী আরও জানান, বন্ধুর মাধ্যমে ফেসবুকে এক নারীর সঙ্গে যোগাযোগ হয়। তিনি স্তন ক্যানসারসহ স্তনের সমস্যায় আক্রান্ত নারীদের চিকিৎসা সহায়তা দেওয়াসহ বিভিন্নভাবে পাশে দাঁড়ান। (তরুণীর পরিচয় যাতে কোনোভাবেই প্রকাশ না পায়, তাই তাঁকে সাহায্য করা নারীরও পরিচয় প্রকাশ করা হলো না)। তারপর এই ক্লিনিকে তাঁর অস্ত্রোপচার হয়।
এই তরুণী বললেন, ‘অস্ত্রোপচারের পর প্রথম যেদিন নিজেকে আয়নায় দেখি, নিজেই বিশ্বাস করতে পারিনি যে সত্যিই এটা আমি। শুধু মনে হচ্ছিল, এ হয়তো আমি নই। কী যে খুশি লেগেছে, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না।’
তবে ওই তরুণীর একটাই আফসোস, লজ্জায় তিনি দীর্ঘদিন তাঁর জটিল সমস্যাটির কথা কাউকে বলতে পারেননি। লজ্জা না পেয়ে শুরুতেই সমস্যার কথা জানাতে পারলে এবং সঠিক চিকিৎসা নিলে তিনি হয়তো আরও অনেক আগেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারতেন। তাঁর মতো এ সমস্যায় ভোগা কেউ যাতে লজ্জা না পান, সেই আহ্বান জানান এই তরুণী।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ব্রেস্ট ক্লিনিকের অধ্যাপক রায়হানা আওয়াল বলেন, বংশগত, হরমোনের সমস্যায় বা অজানা কারণেও কোনো কোনো ব্যক্তির স্তনের আকার বড় হয়ে যেতে পারে। এ ধরনের সমস্যা হলে দেখতে খারাপ দেখায়। পাশাপাশি দৈনন্দিন কাজকর্ম করাও সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। তবে লজ্জায় অনেকেই বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চান না।
এই চিকিৎসকের পরামর্শ, স্তনের আকার অস্বাভাবিক বড় হয়ে গেলে অস্ত্রোপচারের কোনো বিকল্প নেই। তাই লজ্জা না পেয়ে রোগীকে চিকিৎসকদের কাছে আসতেই হবে।