ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান থেকে পরীমনির গ্রেপ্তার, যে তিন প্রশ্নের উত্তর মেলে না

  • ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হয় ২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর

  • ১৪ জন গ্রেপ্তার, মামলা ৫৫

  • চাঁদাবাজি, প্রতারণার অভিযোগ ওঠে

  • মামলা অবৈধ অস্ত্র এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে

  • পৃষ্ঠপোষক কারা জানা যায়নি

ইসমাইল হোসেন সম্রাট, মো. সাহেদ, সাবরিনা চৌধুরী, শামীমা নূর পাপিয়া, মডেল ফারিয়া মাহাবুব পিয়াসা, পরীমনি

যুবলীগের খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার এবং চারটি ক্যাসিনো সিলগালা করে ঠিক দুই বছর আগে আলোচিত অভিযান পর্বের সূচনা করেছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অভিযানের শুরুতে এই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি–টেন্ডারবাজি, প্রতারণার অভিযোগ করেন তাঁরা। চাঁদার টাকা কারা কারা পেল, কে কে প্রতারণার শিকার হলেন, অভিযুক্তদের পৃষ্ঠপোষক কে—এই তিন প্রশ্নের উত্তর আর পাওয়া যায়নি। মোটাদাগে মামলা হয়েছে অস্ত্র ও মাদক রাখার দায়ে।

২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) যুবলীগের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী (সম্রাট)সহ ১৪ জন গ্রেপ্তার হন। তাঁদের বিরুদ্ধে র‌্যাব, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলার সংখ্যা ৫৫।

এরপর গত দুই বছরে আলোচিত অভিযানে গ্রেপ্তার হন নরসিংদীর যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক শামীমা নূর পাপিয়া, কাউন্সিলর ইরফান সেলিম, মডেল ফারিয়া মাহাবুব পিয়াসা, মরিয়ম আক্তার মৌ ও শামসুন্নাহার স্মৃতি ওরফে পরীমনি।

কুমিল্লা থেকে ২০১৯ সালের অক্টোবরে সম্রাট ও তাঁর সহযোগী আরমানকে গ্রেপ্তারের পর র‌্যাব রমনা থানায় অস্ত্র ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করে। সম্রাটের অফিস থেকে বন্য প্রাণী অস্ট্রেলিয়ান ক্যাঙারুর দুটি চামড়া উদ্ধার হওয়ায় বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে সম্রাটকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন আদালত।

রমনা থানার মামলায় র‌্যাব লিখেছে, ‘...তিনি ক্যাসিনো সম্রাট নামে পরিচিত। ঢাকা মহানগরীর মতিঝিল, আরামবাগ, ফকিরাপুল, পল্টনসহ ১০টি ক্লাবের অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসায় তাঁর সংশ্লিষ্টতা আছে। ক্যাসিনো ব্যবসার পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করেন।’

ওই এজাহারে আরও বলা হয়, বিরুদ্ধ মত পোষণকারী কিংবা কেউ চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে সম্রাট বাহিনী তাঁদের ওপর ইলেকট্রিক শক মেশিন ও লাঠি দিয়ে শারীরিক নির্যাতন চালাতেন। তাঁর রয়েছে বিশাল ক্যাডার বাহিনী। অবৈধ উপার্জন করে তিনি এই ক্যাডার বাহিনী পালতেন। বিভিন্ন থানায় তাঁর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। কয়েকটি মামলায় তিনি জেলহাজতে ছিলেন। সম্রাটের অন্যতম সহযোগী কাউন্সিলর মমিনুল হক সাঈদ ও খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। খালেদ মাহমুদ কয়েক দিন আগে বিপুল অর্থ, অস্ত্র, মাদকসহ র‌্যাবের হাতে আটক হন।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈনের কাছে প্রশ্ন ছিল চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, নির্যাতনের অভিযোগ সম্পর্কে কী জেনেছেন তাঁরা। জবাবে তিনি বলেন, অভিযান চালানোর সময় মদ, মাদক , অস্ত্র ও অস্ট্রেলীয় ক্যাঙারুর চামড়া পাওয়া গেছে। সে কারণেই ওই সব মামলা করা হয়েছে। অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় অভিযোগপত্রও দেওয়া হয়েছে।

চাঁদাবাজি–টেন্ডারবাজি, ইলেকট্রিক শক ও লাঠি দিয়ে নির্যাতনের কোনো প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল কি না, সে সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে তিনি কিছু বলতে পারেননি।


আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামে চাঁদা চাওয়ায় সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃত্ব ইসমাইল চৌধুরীসহ যুবলীগের একাধিক নেতার ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন বলে সে সময় খবর বেরিয়েছিল। আর কোনো কোনো সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সম্রাট চাঁদা চাইতেন, চাঁদার টাকা কাকে কাকে দিতেন, এ নিয়ে কিছু জানা যায়নি।

পৃষ্ঠপোষক কে?

মামলার এজাহার ও রিমান্ড আবেদনে সুস্পষ্টভাবে পৃষ্ঠপোষকতাকারীদের প্রসঙ্গ আছে তারেকুজ্জামান রাজীবের মামলায়। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ‘অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র নিজ হেফাজতে রেখে ভূমিদস্যু, চাঁদাবাজি, অবৈধ দখলদারত্বসহ মহানগরী এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে মোহাম্মদপুর এলাকার অপরাধ জগতের সুলতান হিসেবে আবির্ভূত হন।’ আসামি, তাঁর সহযোগীদের অপরাধের কর্মকাণ্ড নিয়ে বিশদভাবে জানা ও অপরাধের পৃষ্ঠপোষকতাকারীদের শনাক্ত করতে ১০ দিন রিমান্ড প্রয়োজন।

তারেকুজ্জামানের পরিবারের অভিযোগ, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে আসিফ আহমেদকে জিতিয়ে আনতে মোহাম্মদপুরে অভিযান হয়। আসিফ আহমেদ সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ ও শীর্ষ সন্ত্রাসী তোফায়েল আহমেদ জোসেফের ভাইপো। মোহাম্মদপুরের অভিযানে একই ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর তারেকুজ্জামান রাজীব ও আরেক কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান ওরফে মিজান ওরফে পাগলা মিজান গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধেও মাদক ও অবৈধ অস্ত্রের মামলা আছে। পরিবারের অভিযোগ, দুজনকেই একই ধরনের মদ, অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। হয়রানি করাই ছিল গ্রেপ্তারের উদ্দেশ্য।
রিমান্ডের পর র‌্যাব ছয় মাসের মধ্যে অভিযোগপত্রও জমা দেয়। কিন্তু গ্রেপ্তারকৃতদের পৃষ্ঠপোষক কে, তা নিয়ে কিছুই জানা যায়নি। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অভিযান কি না, সে সম্পর্কেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।

নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক শামীমা নূর পাপিয়া, করোনাভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষায় জালিয়াতি, প্রতারণা ও অনিয়মের অভিযোগে গ্রেপ্তার রিজেন্ট হাসপাতাল ও রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ, পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার জেকেজির সাবরিনা আরিফ চৌধুরীর বেলাতেও পৃষ্ঠপোষকদের নাম জানা যায়নি।

গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর পাপিয়া গ্রেপ্তার হলে দমন কমিশন (দুদক) বলেছিল, তারা হোটেলে শামীমা নূর পাপিয়ার সঙ্গে কারা দেখা করতে আসত, তাঁর নামে ভাড়া নেওয়া কক্ষগুলোতে কারা অবস্থান করত, তা অনুসন্ধান করে দেখবে।

শুক্রবার রাতে দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা আরিফ সাদেক প্রথম আলোকে বলেন, অনুসন্ধান করে কী পাওয়া গেছে, সে সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে তিনি বলতে পারবেন না। তিনি নতুন এসেছেন। একই জবাব দিয়েছেন কমিশনার জহুরুল হক।

অন্যদিকে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, প্রত্যেকের বিরুদ্ধেই সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল। তার ভিত্তিতেই অভিযান। পৃষ্ঠপোষকতার ব্যাপারে তদন্ত কর্মকর্তা বলতে পারবেন। কেউ কেউ পৃষ্ঠপোষকের কথা বলেন না। যেমন ইভ্যালির রাসেল প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, যা কিছু করেছেন, তিনি নিজেই করেছেন।

প্রতারণা/ ব্ল্যাকমেলিংয়ের শিকার কারা?

সম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে তিনজন নারী গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে মডেল ফারিয়া মাহাবুব পিয়াসা ও মরিয়ম আক্তার মৌয়ের বিরুদ্ধে পুলিশ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করেছে।

গত আগস্টে এই দুজনকে গ্রেপ্তারের পর গোয়েন্দা বিভাগের যুগ্ম কমিশনার হারুন অর রশিদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘আটক দুই মডেল হচ্ছেন রাতের রানি। তাঁরা দিনের বেলায় ঘুমান এবং রাতে এসব কর্মকাণ্ড করেন। উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের পার্টির নামে বাসায় ডেকে আনতেন তাঁরা। বাসায় এলে তাঁরা তাঁদের সঙ্গে আপত্তিকর ছবি-ভিডিও ধারণ করে রাখতেন। পরে তাঁরা সেসব ভিডিও ও ছবি ভুক্তভোগীদের পরিবারকে পাঠাবেন বলে ব্ল্যাকমেল করে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিতেন।’

মামলার এজাহারে পুলিশ লিখেছে, ‘কতিপয় মাদক ব্যবসায়ী’ মাদকদ্রব্য কেনাবেচার জন্য নিজেদের হেফাজতে নিয়ে মোহাম্মদপুরের বাসার নিচতলায় অবস্থান করছেন—গোপন সূত্রে পুলিশ এই খবর পেয়েই রাত ১১টা ৫৫ মিনিটের দিকে অভিযান চালায়।

মরিয়মের স্বামী এ কিউ এম ফয়সাল আহম্মেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, এসব অভিযোগ মিথ্যা। নৈশকালীন কোনো পার্টির আয়োজন সে রাতে ছিল না। পরিবারের লোকজনকে তাঁরা দাওয়াত করেছিলেন বাসায়। তাঁদের মধ্যে তিন ও পাঁচ বছরের দুটি শিশুও ছিল। বাইরে থেকে মদ এনে বাসার ডাইনিং টেবিলে রেখে পুলিশ ছবি তোলে। এরপর তাঁর স্ত্রী মরিয়ম আক্তারকে ধরে নিয়ে যায়।
ফারিয়া মাহাবুব পিয়াসাও তাঁকে আটক করে নিয়ে যাওয়ার সময় একটি ডিজাইন হাউসের মালিকের কথা তোলেন।
এই দুজন কাকে প্রতারণা করলেন, সে জবাব শুক্রবার রাত পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

পরীমনির বাসায় অভিযান ও তাঁকে গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে র‌্যাব বলেছে, পিয়াসার দুই বন্ধু জিসান ও মিশু বলেছিলেন, পরীর বাসায় মিনিবার আছে। তথ্য নিয়ে অভিযান করেছেন। মামলাও তাই মাদকের।

বোটক্লাবের পরিচালকের বিরুদ্ধে মামলার পরই আলোচনায় আসেন পরী। সে থেকেই তিনি অবশ্য আলোচনায় আছেন।