জীবন সুন্দর হয় সদিচ্ছায়
>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে সবার জীবনের বাস্তবতা। আমরা এখানে শুনছি পাঠকের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার কথা। তাঁরা লিখছেন পরিবারের আনন্দ-বেদনাভরা গল্প। শোনাচ্ছেন এ সময়ের কোনো মানবিক সাফল্যের কাহিনি। প্রথম আলো মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছে পাঠকের গল্প। দেশ বা প্রবাস থেকে আপনিও লিখুন আপনার অভিজ্ঞতার কথা। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: dp@prothomalo. com

আমরা জানি অভ্যাস মানুষের দাস। কিন্তু অনেকটা সময় পর মানুষই সেই অভ্যাসের দাস হয়ে যায়। মানুষ যখন কোনো কিছুতে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তখন সেই অভ্যাস থেকে হুট করে চাইলেই বেরিয়ে আসতে পারে না। অভ্যাসে পরিবর্তন আনতে চাইলে সদিচ্ছা থাকতে হবে। এ জন্য তাকে ধীরে ধীরে নতুন অভ্যাসের চর্চা করতে হবে। তাকে মনে রাখতে হবে, এই অভ্যাস শুধু আমাকে একা ভালো রাখবে না, দেশের সবাইকে ভালো রাখতে সাহায্য করবে।
মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে আমরা সবাই ঘরবন্দী জীবনযাপনে অভ্যস্ত হচ্ছি। আগে আমরা সবাই একরকম জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলাম, যা বর্তমান সময়ের সম্পূর্ণ উল্টো। তবে বেঁচে থাকার জন্য, নিজের জন্য, দেশের জন্য কষ্ট করে হলেও অতি দ্রুত আমাদের নতুন অভ্যাসে অভ্যস্ত হতে হচ্ছে। সদিচ্ছার কারণে সহজেই অভ্যস্ত হতে পারছি।
এ অভ্যাসের সঙ্গে অভ্যস্ত হতে গিয়ে আমরা প্রতি মুহূর্তে নিত্যনতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছি। করোনার সময়টিতে আমার অভিজ্ঞতা আমাকে নতুনভাবে পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আশ্বাস দিচ্ছে। উচ্চশিক্ষার তাগিদে আমাকে ঢাকায় থাকতে হয়। মা-বাবার আদরের সন্তান হওয়ায় তাঁদের ছাড়া ঢাকায় গত পাঁচটি বছর কাটিয়েছি খুবই কষ্টে। এর মধ্যে যখনই ছুটি পেয়েছি, বাড়ি চলে এসেছি। কিন্তু গত পাঁচটি বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর এবারই প্রথম তাঁদের কাছে বেশি সময় থাকতে পারছি, যা আমার জন্য সত্যিই বড় ভালো লাগার একটি বিষয়। শহরে থাকতে থাকতে মনটা কেমন যেন বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছিল। মা-বাবাকে দেখার জন্য মনটা মাঝেমধ্যেই কেঁদে উঠত। কিন্তু আমাদের গ্রাম থেকে শহর দূরে হওয়ায় ও বিশ্ববিদ্যালয় খোলা থাকায় মন চাইলেই তাঁদের কাছে আসতে পারতাম না। এখন তাঁদের স্নেহ, আদর, যত্ন, ভালোবাসা পেয়ে আমি যেন পুনরুজ্জীবন লাভ করছি। বছরের অন্যান্য সময় ব্যস্ততার কারণে একসঙ্গে পুরোটা সময় তাঁদের সঙ্গে কাটানো সম্ভব ছিল না। তাঁদের জন্য সামান্য কিছু করতে পারলে অন্তরে প্রশান্তি অনুভব করি। মায়ের সঙ্গে রান্নার কাজে সাহায্য করার ফাঁকে ফাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অভিজ্ঞতার গল্প করে সময়টাকে উপভোগ্য করে তুলছি।
বাবা হচ্ছেন আমার জীবনের আদর্শ। জরুরি প্রয়োজনে বাবা বাইরে থেকে এলে ওনার চশমা, মোবাইল বিশেষ করে জুতা পরিষ্কার করতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। এভাবে তাঁদের কাজে সহযোগিতা করে আমি মহামূল্যবান ব্যস্ত সময় পার করছি। এবং এই সময়টা সুন্দরভাবে পার করতে পারছি শুধু সদিচ্ছা আছে বলেই। বাবার জন্য সর্বদা নিবেদিত আমার প্রাণ । তাঁর জন্যই নিজেকে এক প্রকার প্রাণবন্ত রেখেছি। তার কখনো কোনো প্রয়োজন হলে পাশে থাকব তাই।
পরিবারের জন্য আমি যে ত্যাগ করতে প্রস্তুত, তেমনটি দেশের জন্য করতে চাই। করোনাকালীন ছুটিতে বাবার পাশে থাকতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে হচ্ছে। তাঁদের ছাড়া জীবনের অভিজ্ঞতা হয় একরকম অপূর্ণতার। আর তাঁরা পাশে থাকলে সব অভিজ্ঞতায় আসে পূর্ণতা। আমি যেন আবার পাঁচ বছর আগের জীবনের সঙ্গে আরও কিছুটা নতুন করে অভ্যস্ত হচ্ছি, যা আমার জন্য এক স্বতন্ত্র অভিজ্ঞতা। এই সংকটকালীন মুহূর্তে আসুন আমরা আতঙ্ককে দূরে সরিয়ে রাখি। চলমান পরিস্থিতি মেনে নিয়ে যতটুকু পারা যায় পরিবার-পরিজনদের নিয়ে সুখে থাকাটাই একজন প্রকৃত বুদ্ধিমানের কাজ বলে আমি মনে করি।
দুশ্চিন্তা হয় দেশ নিয়ে, দেশের খেটে খাওয়া মানুষদের নিয়ে। ইতিমধ্যে সরকার তাঁদের জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু সেই সাহায্য পেয়ে না-পেয়ে, কেউ খেয়ে না-খেয়ে দিন পার করছে। কেউবা তা আত্মসাৎ করার নেশায় মগ্ন। জাতির বিবেক কবে জাগ্রত হবে? আবার কবে দেশ সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে তার আপন গতিতে চলবে? মনে এই প্রশ্নগুলোই ঘুরপাক খাচ্ছে। আমি বলব, মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটিয়ে সদিচ্ছার মনোভাব জাগিয়ে তুলুন, তাহলে জীবন হবে সুন্দর। দূরীভূত হবে অন্ধকার। দুর্যোগের এই মধ্যবর্তী সময়ে নিচের লাইনটি মনে আশার আলো জ্বালায় —
‘রাতের সব তারাই আছে
দিনের আলোর গভীরে’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।
শিগগিরই দেশের এই দুর্দিন ঘুচে সুদিন আসবে, পৃথিবী আবার আলোকিত হবে, সেই প্রত্যাশাই করছি মহান প্রভুর নিকট।
লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।