ভুল জেনেও ধোঁয়া দিয়ে কেন মশা মারার চেষ্টা

ধোঁয়া দিয়ে চলছে মশা মারার কাজ
ফাইল ছবি

যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র, ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও অন্য কর্মকর্তারা শিখে এসেছেন ধোঁয়া দিয়ে মশা মারার পদ্ধতি ভুল। তবে এখনো ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ধোঁয়া দিয়ে মশা মারার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সিটি করপোরেশনের কর্মীরা। কেনা ওষুধ শেষ করতে ও নগরবাসীকে বোঝাতে আরও কিছুদিন এভাবে মশা মারা চলবে, বলছে কর্তৃপক্ষ।

ঢাকা উত্তর সিটির নীতিনির্ধারক ও পরামর্শকেরা বলছেন, হঠাৎ এই পদ্ধতি বাদ দিলে প্রশ্ন আসতে পারে। তাই ধোঁয়া দেওয়া যে কার্যকরী নয়, এ নিয়ে প্রথমে নগরবাসীকে সচেতন করতে হবে। পর্যায়ক্রমে ধোঁয়ার প্রয়োগ কমিয়ে একপর্যায়ে বন্ধ করে দেওয়া হবে বলছেন তাঁরা।

আরও পড়ুন
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম
ফাইল ছবি

ধোঁয়া দিয়ে মশা মারার চেষ্টা এখনো কেন

দেশে মশা মারার পদ্ধতিগুলোর মধ্যে অন্যতম ধোঁয়া দেওয়া। এটি ফগিং হিসেবে পরিচিত। পূর্ণাঙ্গ বা উড়ন্ত মশা মারতে ধোঁয়ার মাধ্যমে ওষুধ প্রয়োগের প্রচলন রয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটিও এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে। সংস্থাটি মেলাথিওন নামের ওষুধ ৫৭ ইসি মাত্রায় আমদানির পর ৫ শতাংশ হারে জ্বালানি তেল ডিজেলের সঙ্গে মেশায়। ফগার যন্ত্রে এটি ধোঁয়া হিসেবে প্রয়োগ করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামি শহর পরিদর্শনে গিয়ে গত ২১ জানুয়ারি ঢাকায় মশা নিধনের পদ্ধতিতে ভুল রয়েছে বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন মেয়র আতিকুল ইসলাম। মেয়র বলেছিলেন, ‘আমরা এত দিন ভুল পদ্ধতি ব্যবহার করেছি। তাতে মশা তো ধ্বংস হয়নি। বরং অর্থের অপচয় হয়েছে।’

বিবৃতিতে মেয়র এ-ও বলেছিলেন, ফগিংয়ে (পরিপক্ব মশা নিধনে ধোঁয়া ছিটানো) অর্থ অপচয় না করে লার্ভিসাইডিংয়ে (লার্ভা নিধনে ওষুধ ছিটানো) মনোযোগী হতে হবে।দেশে ফিরে সম্প্রতি মেয়র মিয়ামির মশকনিধন কার্যক্রমের অভিজ্ঞতা এবং ঢাকা উত্তর সিটির জন্য পরিকল্পনা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন। এর আগে ওই দিন সকালে ঢাকা উত্তর সিটির স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তা ও মশকনিধনের পরামর্শকদের নিয়ে একটি সভা করেন।

আরও পড়ুন
মশা থেকে বাঁচতে মশারির ভেতরে থাকতে হয় অনেককে
ফাইল ছবি

সভায় মশকনিধন কার্যক্রমকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর বিষয়ে আলোচনা হয়। এই লক্ষ্যে গত ৩০ জানুয়ারি থেকে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে (১৪ ফেব্রুয়ারি) প্রয়োজনীয় কর্মপরিকল্পনা বা স্ট্যান্ডার্ড অপারেশন প্রসিডিউর (এসওপি) প্রণয়নের সিদ্ধান্ত হয়।

মেয়র আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মিয়ামির বিশেষজ্ঞরা তাঁকে ফগিংয়ের ফল একেবারে শূন্য বলে জানিয়েছেন। তবে ওই পদ্ধতি এখনই বাদ না দিয়ে ফগিং না করার বিষয়ে লোকজনকে সচেতন করতে চান তিনি।

যত দিন ফগিং চলবে, তত দিন টাকা তো গচ্চা যাবেই, এ বিষয়ে জানতে চাইলে মেয়র বলেন, ধীরে ধীরে ফগিংয়ের পরিমাণ কমিয়ে আনা হবে। যেমন সপ্তাহে প্রতিদিনের বদলে এক দিন বা দুই দিন করা হবে। আর লার্ভিসাইডিংয়ে পুরোপুরি সক্ষমতা এলে ফগিং একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হবে।

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

দীর্ঘদিন ধরে মশা নিধন কার্যক্রমে ঢাকা উত্তর সিটিকে পরামর্শ দেন মশাবিশেষজ্ঞ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার। গত নভেম্বরে তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা উত্তর সিটির মেয়রের একজন উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

লাভ নেই জেনেও ফগিং চালু রাখার পেছনে দুটি কারণের কথা বলেন কবিরুল বাশার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যে ওষুধ ইতিমধ্যে কেনা হয়েছে, সেটা আর ফেরত দেওয়া যাবে না। এটাকে ব্যবহার করতে হবে। অন্যদিকে নগরবাসীর সামনে থেকে হঠাৎ একটি অস্ত্র তুলে নিলে নগরবাসীর বাজে মানসিক ধারণা হতে পারে।

এর ব্যাখ্যা দিয়ে কবিরুল বাশার বলেন, এক ধাক্কায় বন্ধ করে দিলে নগরবাসী হয়তো ভাববেন, সিটি করপোরেশন কোনো কাজ করে না। তবে ফগিং করলে নগরবাসীর খুশি হওয়ার কোনো কারণ নেই। ফগিং যে কোনো কার্যকরী পদ্ধতি নয়, এ নিয়ে নগরবাসীকে সচেতন হতে হবে। করপোরেশনও এটিকে ধীরে ধীরে বন্ধ করে দেবে।

ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা

মশকনিধন পদ্ধতিকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা চলছে বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন মেয়র আতিকুল ইসলাম। মিয়ামির অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সোসাইটিগুলোকে সচেতনতা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কারণ, সেখানে (মিয়ামিতে) ‘মসকিউটস বাইটস আর ব্যাড’—শিরোনামে একটি পাঠ্যবই রয়েছে। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বইটি পড়ানো হয়। শিক্ষার্থীরা কার্টুন আকারে রং করে বইয়ের বিষয়বস্তু অধ্যয়ন ও অনুশীলন করে।

এ ছাড়া ‘মশার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আপনার ভূমিকা পালন করুন’—শিরোনামে ছোট একটি প্ল্যাকার্ড রয়েছে। এতে জমা পানি ফেলে দেওয়ার বিষয়টি আছে। শিক্ষার্থীরা এই প্ল্যাকার্ড নিয়ে বিদ্যালয়ে কুচকাওয়াজ করে। সেখান থেকেই তারা মশার বিষয়ে সচেতন হয়।

মেয়র বলেন, ‘আমরা বছরের ৩৬৫ দিনই সব ওয়ার্ডে একই ওষুধ একই মাত্রায় ছিটাই। এটা পদ্ধতিগত ভুল। মিয়ামিতে আগে মশার প্রজাতি নির্ণয় করা হয়। তারপর ওষুধ প্রয়োগের সিদ্ধান্ত হয়।’

মশার প্রজাতি নির্ণয়ে পরীক্ষাগার না থাকার পাশাপাশি জনবলের সংকট আছে জানিয়ে মেয়র বলেন, পরীক্ষাগার নেই, পর্যাপ্ত কীটতত্ত্ববিদও নেই। তাই উপদেষ্টা ও স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়ে স্ট্যান্ডার্ড অপারেশন প্রসিডিউর (এসওপি) প্রণয়নের সিদ্ধান্ত হয়েছে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে এটি প্রস্তুত হবে।

পরীক্ষাগারের বিষয়ে মেয়র বলেন, মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে পরীক্ষাগার স্থাপন অনেক সময় সাপেক্ষ। তত দিন বসে থাকা যাবে না। কাজ করতে হবে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগার ও তাদের বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেওয়ার পরিকল্পনা চলছে।

মেয়রের উপদেষ্টা কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার প্রথম আলোকে বলেন, সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার জন্য এসওপি প্রণয়নের কাজ চলছে। এসওপির মূল বিষয় পরীক্ষাগার। এটি সিটি করপোরেশনের নিজস্ব হতে পারে। আবার কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতা নিয়ে বা সমঝোতা করেও হতে পারে।

এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যেহেতু প্রতিষ্ঠিত পরীক্ষাগার আছে, তাই তাদের সাহায্য নেওয়াটা বেশি কার্যকর হবে। পরীক্ষাগারে মশার প্রজাতি নির্ণয় হবে জানিয়ে করিরুল বাশার বলেন, কোন এলাকায় মশার কোন প্রজাতি আছে, কোন প্রজাতির জন্য কী ওষুধ প্রয়োগ করলে ভালো হবে, পরিপক্ব মশা বা লার্ভার ঘনত্ব কেমন—এসব নিয়ে পরীক্ষাগারে গবেষণা হবে।

সেখান থেকে মশকনিধনের একটি ব্যবস্থাপত্র দেওয়া হবে। যার মাধ্যমে ওষুধ ও এর মাত্রা নির্ধারণ করা হবে।

পরিবেশগত ব্যবস্থাপনার কথা উল্লেখ করে কবিরুল বাশার বলেন, ডোবা, নালা ও জলাশয় পরিচ্ছন্ন রাখতে এবং মশার প্রজননস্থল চিহ্নিত করতে একটি কর্মী বাহিনী থাকবে। একটি দল শুধু লার্ভা নিধনে কাজ করবে।

ব্যাসিলাস থুরিংয়েনসিস ইসরাইলেন্সিস (বিটিআই) নামের একটি ব্যাকটেরিয়ার বিষয়ে উল্লেখ করে কবিরুল বাশার বলেন, মিয়ামিতে এটি ব্যবহার করা হয়। মেয়র এর নমুনা এনেছেন। এটি দানা বা তরল হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এই ব্যাকটেরিয়া খেলে মশার লার্ভা মরে যায়।

এতে স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ঝুঁকি খুবই কম বলেন তিনি। এর দামও তুলনামূলকভাবে কম। সর্বোপরি পরীক্ষাগারের গবেষণার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে মশকনিধনের কার্যক্রম চলবে বলেও জানান তিনি।