পুলিশের মারধরের কথা তুলে ধরা হলো সর্বোচ্চ আদালতে

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের প্রথম দিন বুধবার সাংবাদিক ও নীল দলের আইনজীবীদের লাঠিপেটা করে ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেয় পুলিশ
ছবি: প্রথম আলো

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের শেষ দিনেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের মধ্যে উত্তেজনা ছিল। বৃহস্পতিবারও সকাল থেকে সমিতি প্রাঙ্গণে দুই পক্ষ মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে পাল্টাপাল্টি স্লোগান দিয়েছে, মিছিল করেছে। এ সময় দুই পক্ষে অন্তত দুই দফায় ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে।

এই নির্বাচনকে ঘিরে পুলিশের ভূমিকা, হামলা ও মারধরের ঘটনা দেশের সর্বোচ্চ আদালতে তুলে ধরেছেন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। গতকাল সকালে তারা সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে যান। এরপর তাঁরা প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর কার্যালয়ে গিয়ে এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যা যা ঘটেছে সেই বর্ণনা দেন। এ সময় আপিল বিভাগের অন্য সাত বিচারপতিও সেখানে ছিলেন। বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা প্রধান বিচারপতির কার্যালয় থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর সেখানে যান অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন।

আইন পেশা পরিচালনার জীবনে আমি কখনো এমনটি দেখিনি। এটি দুঃখজনক।
— শফিক আহমেদ,সাবেক আইনমন্ত্রী

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে গত বুধবার ছিল ভোট গ্রহণের প্রথম দিন। কিন্তু গত সোমবার নির্বাচন পরিচালনাসংক্রান্ত উপকমিটির আহ্বায়ক সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. মনসুরুল হক চৌধুরী ‘ব্যক্তিগত’ কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করেন। দুই পক্ষই ঐকমত্যের ভিত্তিতে তাঁকে আহ্বায়ক হিসেবে মেনে নিয়েছিল। মনসুরুল হক পদত্যাগ করলে গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ–সমর্থিত আইনজীবীরা নির্বাচন পরিচালনার উপকমিটির আহ্বায়ক হিসেবে মো. মনিরুজ্জামানকে মনোনীত করেন।

কিন্তু পাল্টা হিসেবে বিএনপি-সমর্থিত আইনজীবীরা এ এস এম মোকতার কবির খানকে আহ্বায়ক মনোনীত করেন। সমিতির কার্যকরী কমিটির ১৪টি পদের মধ্যে সভাপতি ও সম্পাদকসহ সাতটি পদে আছেন আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীরা। অপর সাতটি পদে আছেন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। পাল্টাপাল্টি এই অবস্থানের মধ্যে আওয়ামী লীগপন্থীদের মনোনীত আহ্বায়ক ভোটের কার্যক্রম শুরু করতে গেলে বাধা দেয় বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। এ নিয়ে মঙ্গলবার রাতে সমিতি ভবনে দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এর রেশ ভোটের প্রথম দিনে অর্থাৎ গত বুধবার সকাল থেকেই দেখা যায়। নির্বাচন পরিচালনাসংক্রান্ত কোন উপকমিটির মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে ভোট গ্রহণ হবে—এমন প্রশ্নে তর্কে জড়ায় দুই পক্ষ। এর কিছুক্ষণ পর পুলিশ গিয়ে আইনজীবী ও সাংবাদিকদের পিটিয়ে সমিতির মিলনায়তন (ভোটকেন্দ্র) থেকে বের করে দেয়। পুলিশের হামলায় আইনজীবী, সাংবাদিকসহ অন্তত ২৫ জন আহত হন।

আপিল বিভাগে ঘটনা তুলে ধরলেন বিএনপিপন্থীরা

বৃহস্পতিবার সকাল নয়টার আগে থেকেই আপিল বিভাগের প্রধান বিচারপতির এজলাসে (১ নম্বর বিচারকক্ষে) আসতে শুরু করেন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা। সকাল ৯টা ২৭ মিনিটে এজলাসে আসেন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী এবং আপিল বিভাগের অপর সাত বিচারপতি।

বিচারপতিরা এজলাসে আসন গ্রহণের পর বিএনপিপন্থী জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, আদালত প্রাঙ্গণে নজিরবিহীন ঘটনা বুধবার ঘটেছে, যা চলমান। কোনো কোনো আইনজীবীর কক্ষে তালা লাগানো আছে, কারও কারও কক্ষের চারপাশে পুলিশ রয়েছে। বাইরে থেকে এ ঘটনার পেছনে কেউ আছে কি না, তা দেখতে হবে। তিনি বলেন, ‘এই অঙ্গনে এটা কি অনুমোদিত? তারা সমিতির জ্যেষ্ঠ সদস্যদেরও নির্যাতন করেছে। সুরক্ষা চাইছি, ভুক্তভোগীরা বলবেন।’

এরপর বিএনপি প্যানেল থেকে সম্পাদক প্রার্থী মো. রুহুল কুদ্দুস আদালতে বলেন, ‘আপনারা দেশের বিচার বিভাগের অভিভাবক। তাই প্রত্যেকের ব্যথা, কষ্ট অভিভাবক হিসেবে অবহিত করা উচিত। সমিতির নির্বাচন হয় সব সময় উৎসবমুখর। তবে এবার কী হলো? আজও আমি রুমে ঢুকতে পারিনি। রুমের বাইরে থেকে তালা লাগানো। কক্ষের সামনে পুলিশ রয়েছে। হাজার হাজার পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। পুলিশ দিয়ে পিটিয়ে ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। অনেক আইনজীবী আহত হয়েছেন। পুলিশ কীভাবে ধাক্কাতে ধাক্কাতে বের করে দিয়েছে। আমরা কী অপরাধ করেছি? আমি প্রার্থী, আমি কেন ভোটকেন্দ্রে থাকতে পারব না?’

নির্বাচনে প্রতিপক্ষ প্রার্থীকে ঘায়েল করতে মামলা করা হয় উল্লেখ করে রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘মো. মনিরুজ্জামান (নির্বাচন উপকমিটির আহ্বায়ক) বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন। আমাকে ও সভাপতি প্রার্থীসহ অনেককে আসামি করা হয়েছে। দ্বিতীয় আরেকটি মামলা করেছে সমিতির প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে দিয়ে। সেখানে সমিতির বর্তমান কমিটির ছয়জন সদস্যকে আসামি করা হয়েছে।’

এ সময় প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, ‘আপনাদের সবাইকে সম্মান করি। আপনারা দুজন ১১টার সময় (বিরতি) আসেন। কোনো করণীয় থাকলে করব। প্রয়োজনে অ্যাটর্নি জেনারেলকেও ডেকে নেব।’

বিএনপি প্যানেল থেকে সভাপতি প্রার্থী মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘নজিরবিহীন ঘটনা। ভোটকেন্দ্রে ৩০০ থেকে ৪০০ পুলিশ ঢুকে ধাক্কা দিতে থাকে। সবাই পড়ে যাচ্ছিল আর পুলিশ পা দিয়ে পাড়িয়েছে। আমার পায়ে ব্যথা। ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছি না। অনেক আইনজীবী ও সাংবাদিককে আহত করা হয়েছে।’

তখন প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, ‘এ কথাগুলো ভেতরে বসে শুনি। ১১টায় আসেন, আপনাদের কথা শুনব। এখন কোর্টের কাজ করি।’ একপর্যায়ে রুমের তালা খুলে দেওয়ার ও পুলিশ সরানোর আরজি জানান রুহুল কুদ্দুস। তখন প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘কোর্টে বসে এটি বললে আদেশ হয়ে যাবে। ১১টায় আসেন, শুনি।’ এ সময় বিএনপিপন্থী শতাধিক আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন।

এরপর মাহবুব উদ্দিন খোকন ও রুহুল কুদ্দুস বেলা ১১টার দিকে প্রধান বিচারপতির কার্যালয়ে গিয়ে দেখা করেন। ১১টা ৫৭ মিনিটে তাঁরা বেরিয়ে এসে সমিতির এনেক্স ভবনের সামনে ব্রিফ করেন। এর পরপরই প্রধান বিচারপতির কার্যালয়ে গিয়ে দেখা করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন।  

অ্যাটর্নি জেনারেলের ব্রিফিং

অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন তাঁর কার্যালয়ে গতকাল দুপুরে ব্রিফিংয়ে বলেন, ‘বুধবার সকালে ওনারা (বিএনপিপন্থী) ভোটারদের বাধা দিচ্ছিলেন, নির্বাচন করতে দিচ্ছিলেন না। যখন বর্তমান সভাপতি মোমতাজ উদ্দিন ফকির ও সম্পাদক আবদুন নূর দুলাল নির্বাচন করার জন্য গেলেন, তখন দুই পক্ষের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি ও হাতাহাতি হচ্ছিল। সেই পর্যায়ে সেখানে পুলিশ প্রবেশ করে। সমিতির পক্ষ থেকে আগে থেকেই চিঠি দিয়ে পুলিশকে জানানো হয়েছিল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি রক্ষার বিষয়ে। প্রতিবছরই নির্বাচনের সময় চিঠি দেওয়া হয় এবং পুলিশ থাকে।’

অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘তিনি (প্রধান বিচারপতি) তাঁকে জানিয়েছেন, বিএনপি থেকে সমিতির বর্তমান সভাপতি ও সম্পাদক প্রার্থী কথা বলতে গিয়েছিলেন। প্রধান বিচারপতি বলেছেন, এটি সমিতির বিষয়, আমাদের করণীয় নেই। এই বিষয় তাঁদের (সভাপতি ও সম্পাদক প্রার্থী) জানিয়েছেন।’

এদিকে গত বুধবার সমিতি ভবনে সাংবাদিকদের ওপর পুলিশের ওপর হামলা ও মারধরের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ। গতকাল সকালে তিনি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ভবনে ল রিপোর্টার্স ফোরামের কার্যালয়ে যান। সেখানে বুধবারের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশের পাশাপাশি ঘটনাটি অনিচ্ছাকৃত বলে উল্লেখ করেন তিনি।

পাল্টাপাল্টি স্লোগান ও ধাক্কাধাক্কি

বৃহস্পতিবার সকালে আপিল বিভাগ থেকে বেরিয়ে এসে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা সমিতির সভাপতির কক্ষের সামনে জড়ো হয়ে স্লোগান দিতে থাকেন এবং মিছিল করেন। অন্যদিকে সমিতি প্রাঙ্গণে অবস্থান করা আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীরাও পাল্টা স্লোগান দিতে থাকেন।

দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা মিছিল নিয়ে ভোটকেন্দ্রে যেতে তৈরি করা শামিয়ানার দিকে আসতে থাকেন। এ সময় দুই পক্ষে উত্তেজনা দেখা দেয়। পাল্টাপাল্টি স্লোগানের একপর্যায়ে দুই পক্ষে ধাক্কাধাক্কির ঘটনাও ঘটে।

বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে আবার মিছিল নিয়ে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা সমিতি প্রাঙ্গণে ওই শামিয়ানার দিকে আসতে থাকেন। সেখানে আগে থেকেই ছিলেন আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীরা। আধা ঘণ্টার বেশি সময় ধরে দুই পক্ষ পাল্টাপাল্টি স্লোগান দেয়। এ সময় দুই পক্ষে ধাক্কাধাক্বি হয়। একপর্যায়ে স্লোগান দিতে দিতে সমিতি ভবনের দিকে চলে যান বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা।

আরও পড়ুন

বিএনপিপন্থী ২১ আইনজীবীর আগাম জামিন

সমিতির নির্বাচনের ব্যালট পেপার চুরি ও ছিঁড়ে ফেলা এবং ভাংচুরের অভিযোগে শাহবাগ থানায় করা পৃথক দুটি মামলায় বিএনপিপন্থী ২১ আইনজীবী ৮ সপ্তাহের আগাম জামিন পেয়েছেন। জামিন চেয়ে তাঁদের করা পৃথক আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি মো. আমিনুল ইসলাম এ জামিন দেন।

আদালতে জামিন আবেদনকারীদের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী ও জয়নুল আবেদীন।

এদিকে নির্বাচন পরিচালনাসংক্রান্ত উপকমিটির সদস্য আসাদুজ্জামান মনির গত রাত সোয়া ১০টার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনে ভোটার ৮ হাজার ৬০২ জন। দুই দিনে ৪ হাজার ১৩৭ ভোট পড়েছে।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিতে সভাপতি ও সম্পাদকসহ মোট পদ ১৪টি।

আরও পড়ুন

বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের বিরুদ্ধে পুলিশের মামলা

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে পুলিশের ওপর হামলা ও ভোটকেন্দ্রে ভাঙচুর চালানোর অভিযোগে বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করা হয়েছে। রাজধানীর শাহবাগ থানায় গতকাল করা এ মামলার বাদী পুলিশ। এতে বিএনপিপন্থী আইনজীবী এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, রুহুল কুদ্দুস, মনজুরুল আলমসহ ১৪ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা ৩৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
তবে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় গত বুধবার সুপ্রিম কোর্টে পুলিশের মারধরের শিকার হন অন্তত ১০ সাংবাদিক। তাঁরা অভিযোগ করেন, পুলিশ তাঁদের ঘিরে ধরে লাথি মেরেছে ও লাঠিপেটা করেছে। ঘটনার ভিডিও ধারণ করায় কয়েকজন সাংবাদিকের মুঠোফোনও কেড়ে নেয় তারা। তবে পুলিশের করা মামলায় সাংবাদিকদের মারধর করার কোনো তথ্য নেই।

সমিতি ভবনে আইনজীবী ও সাংবাদিকদের ওপর পুলিশের হামলার বিষয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আইন পেশা পরিচালনার জীবনে আমি কখনো এমনটি দেখিনি। এটি দুঃখজনক।’

আরও পড়ুন