সিটি করপোরেশনের গাড়ির চাকায় পিষ্ট মাহিন, মূর্ছা যাচ্ছেন মা

সপ্তম শ্রেণির ছাত্র মাহিন আহমেদ গতকাল বৃহস্পতিবার সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়ছবি: সংগৃহীত

মতিঝিল সরকারি আইডিয়াল স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র মাহিন আহমেদ পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলায়ও ভালো ছিল। ক্রিকেট, ফুটবল ও সাঁতারে এলাকার শিশু–কিশোরদের মধ্যে পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছিল সে। মাহিন অবশ্য এগুলোর চেয়েও ভালো করছিল সাইক্লিংয়ে। বন্ধুদের কাছে বড় সাইক্লিস্ট হওয়ার স্বপ্নের কথা বলত এই কিশোর।

অর্থাভাবে বড় ছেলেকে এসএসসির পর আর পড়াতে না পারা মা–বাবা এই মাহিনকে ঘিরেই স্বপ্ন দেখছিলেন। মাহিনের সঙ্গে একই স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে তাদের একমাত্র বোন ফাতেমা আক্তার। স্কুলপড়ুয়া এ দুই ভাই–বোনের পড়াশোনা কোনোমতে চালিয়ে নিচ্ছিলেন। কিন্তু গতকাল বৃহস্পতিবার এক দুর্ঘটনায় শেষ হয়েছে দুরন্ত মাহিনকে ঘিরে পরিবারের সব স্বপ্ন ও সংগ্রাম।

বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে উত্তর মুগদার মদিনাবাগ এলাকায় নিজের বাসার কাছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একটি ময়লার ট্রাকের চাপায় প্রাণ হারায় ১৩ বছরের মাহিন। তার মৃত্যুতে মুষড়ে পড়েছেন স্বজনেরা।

ঢাকা মেডিকেল কলেজে ময়নাতদন্ত শেষে আজ শুক্রবার বিকেলে পরিবারের কাছে মাহিনের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়। সেখান থেকে নিয়ে তাকে দাফন করা হয় মুগদা কবরস্থানে। এরপর মাহিনদের উত্তর মুগদার মামা–ভাগিনা গলির বাসায় গিয়ে দেখা যায়, বারবার সন্তানের কথা বলে মূর্ছা যাচ্ছেন মা জ্যোৎস্না আক্তার। ছোট বোন ফাতেমা বাসার এককোণে বসে কাঁদছে। সে বলে, ভাই তাকে নিয়ে একসঙ্গে খেলতে যেত। স্কুলেও যেত একসঙ্গে। এখন কে তাকে স্কুলে নিয়ে যাবে?

ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গের ফটকের সামনে একটি রিকশায় নির্বাক হয়ে বসেছিলেন মাহিনের বড় ভাই মাহফুজ আহমেদ
ছবি: প্রথম আলো

এর আগে দুপুরে ঢাকা মেডিকেলের মর্গের সামনে গিয়ে দেখা যায়, মর্গের ফটকের সামনে একটি রিকশায় নির্বাক হয়ে বসেছিলেন মাহিনের বড় ভাই মাহফুজ আহমেদ (২১)। ঠিকভাবে কথাও বলতে পারছিলেন না। একমাত্র ভাইকে হারিয়ে বিলাপ করতে করতে চুপ হয়ে গেছেন তিনি। কথা বলতে এগিয়ে গেলে বললেন, ‘আমাদের আর কিছু রইল না। গতকালও আমার ভাইটা কথা বলেছে, খেয়েছে, ঘুরেছে। আজ সে মর্গে শুয়ে আছে। কিছুতেই মানতে পারছি না।’

মাহিনের মৃত্যুর খবর শুনে মর্গের সামনে ছুটে আসে তার খেলার সঙ্গী মো. মারুফ আহমেদ। আফসোস করে সে বলে, ‘খুব ভালো সাইকেল চালাত মাহিন। সব সময় হাসিখুশি ছিল। সবাইকে মাতিয়ে রাখত। তাঁর ইচ্ছা ছিল ভালো সাইক্লিস্ট হবে।’

আরও পড়ুন

মর্গের সামনে লাশের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন মাহিনের মামাতো ভাই সৈয়দ শাহ আলম। তিনিও মাহিনের সাইক্লিস্ট হওয়ার স্বপ্নের কথা তুলে ধরলেন। বললেন, ‘টাকার অভাবে মাহিন নতুন সাইকেল পায় নাই। আশপাশের বন্ধুদের কাছ থেকে সাইকেল নিয়ে চালাত। বড় হয়ে সাইক্লিস্ট হওয়ার স্বপ্ন দেখত সে।’

উত্তর মুগদার মামা-ভাগিনা গলির একটি ভাড়াবাসায় পরিবারের সঙ্গে থাকত মাহিন। বাবা মাছুম মিয়া একসময় পোশাক কারখানায় বোতাম, সুতাসহ বিভিন্ন সামগ্রী সরবরাহের কাজ করতেন। এই ব্যবসায় অনেক টাকা বাকি পড়ে যাওয়ায় কয়েক বছর ধরে তা বন্ধ রয়েছে। এখন যেখানে যে কাজ পান, তা–ই করেন। আর্থিক অনটনে কোনোমতে চলছে তাঁদের সংসার। তিন সন্তানের দেখাশোনা করতেন গৃহিণী মা জ্যোৎস্না আক্তার।

মাহিনের ফুফাতো ভাই শফিকুল আলম প্রথম আলোকে জানান, অর্থসংকটের কারণে মাহফুজের মাধ্যমিকের পর আর পড়াশোনা হয়নি। অনেক কষ্ট করে ছোট ছেলে মাহিন ও মেয়ে ফাতেমার পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন মা–বাবা। এ দুজনকে ঘিরেই তাঁরা স্বপ্ন দেখতেন।

মাহিনের পরিবার জানায়, মাহিনের মা জ্যোৎস্না আক্তার বৃহস্পতিবার রোজা রেখেছিলেন। সন্ধ্যায় তাঁর সঙ্গে ইফতার করে মাহিন। ইফতারের পর মাকে বলে বাসা থেকে বের হয় সে। কথা ছিল রাতে একই এলাকায় তার চাচার বাসায় থেকে পরদিন ফিরবে। সেখানে যাওয়ার পথে মুগদার মদিনাবাগ এলাকায় সিটি করপোরেশনের বেপরোয়া ময়লার ট্রাক উল্টো পথে এসে তাকে চাপা দেয়। রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে মাহিনকে প্রথমে নেওয়া হয় মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। অবস্থার অবনতি হলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ১১টার দিকে তাঁর মৃত্যু হয়।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এই ময়লার ট্রাকটি ধাক্কা দেয় মাহিনকে
ছবি: সংগৃহীত

স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ শাকিল প্রথম আলোকে বলেন, মাহিনকে চাপা দেওয়ার পর স্থানীয় বাসিন্দারা গাড়িটিকে ধাওয়া করেন। কিছু দূর গিয়ে গাড়িটি থামালে চালকের সহকারী মো. রুবেলকে চালকের আসনে পাওয়া যায়। তখন তাঁর কথা অসংলগ্ন মনে হচ্ছিল। খবর পেয়ে পুলিশ এসে তাঁকে গ্রেপ্তার করে।

মাহিনের মৃত্যুর ঘটনায় মুগদা থানায় সড়ক পরিবহন আইনে একটি মামলা হয়েছে। এতে রুবেলকে একমাত্র আসামি করা হয়েছে। মুগদা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. কামরুল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ‘রুবেলকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানো হয়েছে। সে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখাতে পারেনি।’

আরও পড়ুন