‘ভালো ফলে’র ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া

ফল প্রকাশের পর আনন্দ–উচ্ছ্বাসের মুহূর্ত ক্যামেরবন্দী করছেন কয়েকজন। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকাছবি: আশরাফুল আলম

এখন আর বুকে ঢিবঢিব কাঁপুনি নিয়ে নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নোটিশ বোর্ড থেকে পরীক্ষার ফল জানার দরকার পড়ে না। যেকোনো জায়গা থেকে অনলাইনে ফল দেখা যায়। প্রত্যাশিত বা আশাতীত ভালো ফল করলে উচ্ছ্বাস যা প্রকাশ করার, তা বাড়ির গণ্ডিতেই শেষ হয়ে যায়। তবে আনন্দ ভাগাভাগি করলে বাড়ে, সেই ‘সূত্র’ অনুসরণ করে ফল জানার পরও এখনো অনেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্ধু–আপনজনদের নিয়ে ঢুঁ মারেন। আজ বুধবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর এমন কয়েকজনের সঙ্গে দেখা হলো রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীতে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রাঙ্গণে।

আনন্দ প্রকাশের মাধ্যম পেয়ে তাঁরা আপ্লুত হলেন, আনন্দাশ্রুতে ভাসলেন। প্রত্যাশিত ফল করেননি, এমন কাউকে কলেজ প্রাঙ্গণে এই প্রতিবেদক খুঁজে পাননি। হয়তো অনলাইনে ফল জেনে কলেজমুখী হতে আর ইচ্ছে করেনি। এক শিক্ষার্থীর ভাষায়, ‘রেজাল্ট খারাপ হলে কেউ আসে না।’

আরও পড়ুন

এ বছর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে মোট ২ হাজার ৩৩৯ জন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন। এর মধ্যে ৪ জন ছাড়া সবাই পাস করেছেন। জিপিএ–৫ পেয়েছেন ২ হাজার ১ জন। পাসের হার ৯৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং জিপিএ–৫ প্রাপ্তির হার ৮৫ দশমিক ৭০ শতাংশ।

ফল সন্তোষজনক হয়েছে উল্লেখ করে ভিকারুননিসা স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ কামরুন নাহার প্রথম আলোকে বলেন, করোনা–পরবর্তী সময়ে মেয়েদের নিয়ে এগোচ্ছে প্রতিষ্ঠান। করোনার সময় পড়াশোনার ক্ষেত্রে কিছুটা বাধাগ্রস্ত হতে হয়েছে। সেসব থেকে উত্তরণের চেষ্টা করা হচ্ছে। মেয়েদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও নজর দেওয়া হচ্ছে। চূড়ান্ত পরীক্ষার আগে বিভিন্ন পরীক্ষা নিয়ে মেয়েদের পড়াশোনায় সক্রিয় রাখা হয়েছে।  

নেচে–গেয়ে ভালো ফল করার মুহূর্তটি উদ্‌যাপন করছেন কয়েকজন শিক্ষার্থী। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা
ছবি: আশরাফুল আলম।

‘ভয়ে ছিলাম, এত ভালো করব ভাবিনি’
মেয়ে তো ভালো ফল করল, আপনার একটু প্রতিক্রিয়া নিই—বাণিজ্য বিভাগ থেকে জিপিএ–৫ পাওয়া তাসমিয়াহ্‌ খানমের মা হামিদা খানমকে এ প্রতিবেদক ডাকার পর তাঁর অশ্রু ঝিলিক মারছিল। কথা শুরুর পর যেন চোখের জল আরও বাড়ল। তাসমিয়াহর বাবা কামাল পাশা খান দেড় বছর আগে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হন। এখনো অসুস্থ। বাড়িতেই থাকেন। একধরনের ঝড়ঝাপটার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে মেয়েকে। মা হিসেবে তিনিও খুব বেশি সময় দিতে পারেননি।

নিজেকে ‘গড়পড়তা’ ছাত্রী উল্লেখ করে তাসমিয়াহ্‌ বললেন, ‘ফিন্যান্স পরীক্ষার আগে ১৩ দিনের বিরতি ছিল। ফিন্যান্স আমার প্রিয় বিষয়ও। পরীক্ষার হলে গিয়ে দেখি বেশির ভাগ প্রশ্ন ধরতে পারছি না। এসএসসি পরীক্ষার অভিজ্ঞতা থেকে মাথা ঠান্ডা রেখে লিখতে শুরু করলাম। আর নিজেকে বারবার বোঝাচ্ছিলাম কাঁদা যাবে না। ভয়ে ছিলাম। এত ভালো করব ভাবিনি।’ এসএসসি পরীক্ষায় এক বিষয়ে সব না পেরে কান্নাকাটি করে হল থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন তাসমিয়াহ্‌। ফলে এসএসসির ফল জিপিএ–৫ ছুঁতে পারেনি।

বিজয়সূচক ‘ভি’ চিহ্ন দেখাচ্ছেন জিপিএ–৫ পাওয়া শিক্ষার্থীরা। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা
ছবি: আশরাফুল আলম।

‘ও একটা সিরিয়াস বাচ্চা’
নাদিয়া তাবাস্‌সুমের রাত জেগে পড়ার অভ্যাস। পরীক্ষার আগের দিন সারা রাতই জেগে থেকে পড়েন। এ নিয়ে মা নাজমুনা টুম্পার আপত্তি আছে। তবে পরীক্ষার সময় মেয়ে যেন মানসিক চাপে না পড়েন, তাই সেই ‘আপত্তি’ নিজের ভেতরেই রেখে দিতেন। মেয়ে সব কটি বিষয়ে এ প্লাস পেয়েছে, এটা প্রত্যাশিত ফল বলেই জানালেন। মা বললেন, ‘ও একটা সিরিয়াস বাচ্চা। সব সময় স্কুল–কলেজে ভালো ফল করেছে।’

নাদিয়া জানালেন, তিনি বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পরীক্ষা দিয়েছিলেন। তিনি পড়াশোনা করতেন পরিকল্পনামাফিক।

আরও পড়ুন

বোনের ফল জানতে এসেছেন শিবচর থেকে
সুমাইয়া জান্নাতের স্বামী মাদারীপুরের শিবচর উপজেলায় কৃষি কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। ছয় মাসের ছেলেসন্তান নিয়ে সুমাইয়া সেখানেই থাকেন। বোন সুরাইয়া জান্নাতের পরীক্ষার ফল ভালো হবে, এটা নিয়ে আত্মবিশ্বাস ছিল তাঁর। তাই ফল ঘোষণার তারিখ ধরে তিনি ঢাকায় এসেছেন একসঙ্গে আনন্দ করবেন বলে। কলেজ প্রাঙ্গণে সুরাইয়ার সঙ্গে আরও এসেছিলেন মা নাহিদা বেগম এবং ছোট বোন। সুরাইয়া ভাগনে রাফসানকে কোলে নিয়ে ঘুরছিলেন।

বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ–৫ পাওয়া সুরাইয়া জানালেন, ভালো ফলের ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য পরিশ্রম করেছেন, ফলও পেয়েছেন। এখন প্রস্তুতি নিচ্ছেন মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার জন্য। মেয়ের কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত মা নাহিদা বেগম। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আমার মেয়েটা অনেক লক্ষ্মী। কখনো পড়ার জন্য চাপ দিতে হয়নি।’

আরও পড়ুন

অনলাইনে ফল দেখার পর নায়ার হুমায়রার মতো অনেকে একা একাই এসেছিলেন কলেজে। নোটিশ বোর্ডে ঝোলানো ফলে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। তিনি বললেন, বেলা সাড়ে ১১টায় অনলাইনে ফল জেনেছেন।

এক বাবাকে দেখা গেল নোটিশ বোর্ডে সাঁটানো পরীক্ষার ফলের ছবি মুঠোফোনে তুলে নিচ্ছেন। অনলাইনে কি ফল দেখা হয়নি জানতে চাইলে বললেন, ‘এখনো ছাপার অক্ষরে রেজাল্ট দেখতে ভালো লাগে। তাই ছবি তুলে নিলাম। রেজাল্ট আগেই জেনেছি।’ জানালেন, তাঁর মেয়ে মেহজাবিন কাদির বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ–৫ পেয়েছেন। মেয়ে বাবার মতো প্রকৌশলী হতে চান। বাবার সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে মেহজাবিন ছুটে এসে বাবাকে কী বলে আবার দৌড় দিলেন বন্ধুদের দিকে। ওদিকে তখন আনন্দ উদ্‌যাপনে ব্যান্ড বাজানো চলছে।

আরও পড়ুন