ঢাকার কোথায় কোথায় পাবেন কৃষ্ণচূড়া, সোনালু, জারুলের দেখা
রুদ্ররূপের বিপরীতে এক কোমল পরশ থাকে। তেমন কোমলতা দেখিয়ে প্রকৃতি নিজেই হয়তো চমকে দিতে চায় আমাদের। এবার বৈশাখ মাসেই তাপদাহে প্রাণ ওষ্ঠাগত। অথচ এরই মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ দেখা মিলছে কত রঙের ফুলের। যেন প্রকৃতি নিজেই বলতে চাইছে—‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতূর্য’।
‘মাধবী হঠাৎ কোথা হতে এল ফাগুন দিনের স্রোতে/ এসে হেসেই বলে ‘যাই যাই যাই’।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রকৃতি পর্বের গানের সেই মাধবী আছে রাজধানীর রমনা পার্কে। মাধবী দুলছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের লোহার শিক ধরেও। অপূর্ব সুগন্ধমাখা ভ্রমরপ্রিয় এই ফুল বসন্তকালের। তবে গ্রীষ্মেও মাধবীকে পাওয়া যাচ্ছে।
এই আনন্দ–নগরের মানুষের জন্য রমনায় ফুটেছে কৃষ্ণচূড়া, সোনালু, নাগেশ্বর, রাধাচূড়া, গুস্তাভিয়া, কাঠগোলাপ, মধু মঞ্জুরি, কনকচূড়ার মতো নানা ফুল। দক্ষিণের লেকপারের গেটের ভেতরে ছোট থোকায় ফুটে থাকা বেগুনি-নীল ফুলটির নাম অঞ্জন। বাগানবিলাসের অনেকগুলো ঝাড় আছে এই পার্কে।
ভাষানটেক এলাকায় রাঁধাচূড়া, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জারুলের কথা না বললেই নয়। মেট্রোরেলের সুবাদে এখন গাছের তলায় দাঁড়িয়ে মুখ তুলে ফুল না দেখে বরং দৃষ্টির সমান্তরালে থেকে ফুল দেখা যায়। যদিও এতে ফুলের সুঘ্রাণ নেওয়া আর ছুঁয়ে দেখার সাধ অধরাই রয়ে যায়। রমনার পাশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এখন রঙের সমাহার। বেগুনি জারুল, থরে থরে থাকা হলদে সোনালুকে ছাপিয়ে যেতে চাইছে আগুনরঙা কৃষ্ণচূড়া।
ঢাকা শহরে সব ফুলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আধিপত্য এখন সোনালু ফুলের। ধানমন্ডির বিলাসী বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একা গাছের ফুল হোক, কিংবা পুরোনো বিমানবন্দর সড়কে সারি সারি হলুদের নয়নকাড়া রূপ হোক—সোনালুই সেরা। এ ফুলের যেমন ‘বাঁদর লাঠি’র মতো একেবারে আটপৌরে কিছু আঞ্চলিক নাম রয়েছে, তেমনি আছে অসম্ভব মর্যাদাপূর্ণ আরও দুটি নাম ‘স্বর্ণাঙ্গ’, ‘হেম পুষ্প’। তাদের দেখা মিলছে এখন সবখানে।
জাতীয় সংসদ ভবনের পাশে চন্দ্রিমা উদ্যান এলাকা এখন কৃষ্ণচূড়ার দখলে। চিরল পাতার কৃষ্ণচূড়ার ছায়া বটের মতো নয়। হালকাপলকা হওয়ায় বাতাসে খুব দোল খায়। আর তাতেই যেন ক্লান্তি হরণ করে নেয় পথচারীর। গত মঙ্গলবার দুপুরে চন্দ্রিমা উদ্যান এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কৃষ্ণচূড়ার তলায় বাঁধানো লাল ইটের দেয়ালে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে মানুষ। অধিকাংশই মজুর কিংবা আশপাশের ফেরিওয়ালা। তপ্ত দুপুরে তাঁদের আশ্রয় দিয়েছে কৃষ্ণচূড়ারা। হৃদয় হরণ করা এই কৃষ্ণচূড়ার আরেক নাম গুলমোহর। লালের পাশাপাশি কমলা, হলুদ রঙেরও হয়। তবে বাংলাদেশের মানুষের কাছে কৃষ্ণচূড়া মানেই লাল রঙের একটি ফুল।
শহরজুড়ে বিভিন্ন সড়ক বিভাজকে ফুটেছে হলুদ রঙের কলকে ফুল, যেন এই প্রখর রোদের থেকে রং নিয়েই সে হলুদ হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে টিএসসির ভেতর ফুটেছে কাঠগোলাপ। ক্যাম্পাসজুড়ে হরেক রকম ফুলের সঙ্গে রয়েছে জারুল। জারুল ফুলের এক মজার বৈশিষ্ট্য, হালকা থেকে ফুলটির রং ক্রমেই গাঢ় হতে থাকে। আর বৃষ্টির পানি পেলে নাকি জারুলের রং সবচেয়ে বেশি খোলতাই হয়।
গ্রীষ্মের দুপুরে ঘুরতে ঘুরতে দেখা হলো সাদা টগরের সঙ্গেও। মিরপুর ১৪ আর ১০ নম্বরের সড়ক বিভাজকে ফুটে আছে টগর। এখন ডুলি চাপা, উদয়পদ্ম, ঝুমকোলতার মতো বহু রঙের ফুল ফোটার সময়। আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ–চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের মাঠে ফুটেছে গোলাপি আভার পাতলা পাপড়ির নাম না–জানা এক ফুল। ভাষানটেকে দেখা মিলল রাঁধাচূড়ার। উত্তরা ১৫ নম্বর সেক্টরের ২ নম্বর সেতু–সংলগ্ন সড়কের ওপরও ফুটেছে কৃষ্ণচূড়া। এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে উড়োজাহাজ ওঠানামার দৃশ্যও দেখা যায়।
এসব ফুলের কানে ভ্রমর এসে চুপি চুপি কিছু বলে যায় কি না, জানা নেই। তবে এসব ফুল হাতে বিক্রির জন্য ছোটাছুটি করতে দেখা যায় পথশিশুদের। ফুল বাড়লে সড়কে-সিগনালে ওদের বিক্রিও বাড়ে। তবে বিক্রি হয় না ‘মেঘ শিরীষ’ নামে পরিচিত যেখানে-সেখানে থাকা ‘রেইনট্রি কড়ই’য়ের ছোট্ট গোলাপি ফুলগুলো। গাছের একেবারে ওপরের দিককার ডালগুলো ছাড়িয়ে পাতার ভেতর থাকে ফুল। দূর থেকে দেখে মনে হয়, বাতাসের পলকাতে উড়ে যাবে। কিন্তু পাতা ঠিক আঁকড়ে রাখে নিজের ফুলেদের।
ঢাকার মানুষের নাগরিক মনের অলিন্দে গ্রীষ্মের ফুল আলাদা জায়গা করে নিতে পারে কি না, ঠিক বোঝা যায় না। তবে ঘ্রাণ শুঁকে না দেখলেও ফুলের ছবির সয়লাব ঠিকই চোখে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, বিশেষ করে কৃষ্ণচূড়া আর সোনালু। শরতের কাশফুলের মতো করে এই দুটি ফুল নিয়ে নেট দুনিয়ায় মেতেছে মানুষ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রকৃতি পর্বের বাণীতে লিখেছিলেন, ‘নিবিড় অমা-তিমির হতে বাহির হলো জোয়ার স্রোতে/ শুক্ল রাতে চাঁদের তরণী/ ভরিল ভরা অরূপ ফুলে, সাজালো ডালা অমরাকূলে/ আলোর মালা চামেলি বরণী।’ এই অরূপ ফুল বলতে ঠিক কোন ফুলের কথা বলছেন কবি, সেটা আমরা জানি না। তবে বসন্তের শুরু থেকে ফুটতে থাকা চামেলির হঠাৎ দেখা পাওয়া যায় শহরের কোনো পুরোনো বনেদি বাড়ির প্রবেশদ্বারে। সেখানে থমকে দাঁড়াবে মানুষ একমুহূর্ত। বিস্মিত হতে হতে ভাববে, আমরা গ্রাম, মফস্সলের স্মৃতিচারণা করি, কিন্তু যে নগরে আমাদের বসবাস, সেই নগরের প্রতি আমাদের প্রেম জাগে না। ইট–কাঠ–পাথরের সেই নগরকে ভালোবাসার যাত্রা শুরু হয় এসব ফুলের হাত ধরেই।