রমনা বটমূলে গান–কবিতা–উচ্ছ্বাসে ছায়ানটের বর্ষবরণ, বিভাজন ভাঙার প্রত্যয়

রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে শিল্পীদের পরিবেশনা। ঢাকা, ১৪ এপ্রিলছবি: জাহিদুল করিম

পুব আকাশে সবে লাল সূর্য উঠতে শুরু করেছে। মঞ্চে প্রস্তুত শিল্পীরা। সামনে দর্শকসারিতে ভিড় জমে গেছে। শিল্পী সুপ্রিয়া দাশ গেয়ে উঠলেন ‘ভৈরবী’ রাগালাপ। এর মধ্য দিয়ে শুরু হলো বাংলা নববর্ষ ১৪৩২ বরণের পালা। আজ সোমবার ভোরে রাজধানীর রমনা বটমূলে এর আয়োজন করে ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট।

রাগালাপের পর ‘নূতন প্রাণ দাও, প্রাণসখা’ সম্মেলক গান শোনান ছায়ানটের শিল্পীরা। ‘তিমির দুয়ার খোলো’ একক গান পরিবেশন করেন শিল্পী দীপ্র নিশান্ত। পাখিডাকা ভোরে, সবুজের আচ্ছাদনে দর্শনার্থীরা যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো উপভোগ করেন এ আয়োজন।

এরপর একে একে ২৫টি রাগালাপ, গান আর আবৃত্তি পরিবেশন করা হয়। সকাল সাড়ে আটটার দিকে ছায়ানটের শিল্পীদের সমবেত কণ্ঠে পরিবেশিত হয় জাতীয় সংগীত। এ সময় কণ্ঠ মেলান উপস্থিত হাজারো দর্শক। এর মধ্য দিয়ে এবারের আয়োজন শেষ হয়।

তবে অনুষ্ঠান শেষের আগে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি বাহিনীর নির্বিচার হত্যাযজ্ঞে নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এ সময় ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি সারওয়ার আলী বলেন, ফিলিস্তিনের গাজায় ভয়াবহ মানবতার বিপর্যয় এবং গণহত্যায়, বিশেষ করে শিশু হত্যার তীব্র নিন্দা জানান তাঁরা। ফিলিস্তিনিরা আপন ভূমি রক্ষায় যে সংগ্রাম করছেন, তার প্রতিও সংহতি জানানো হয়।

এবার বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের মূল বার্তা ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়’। রমনার বটমূল, ঢাকা, ১৪ এপ্রিল
ছবি: জাহিদুল করিম

রমনা বটমূলে বাংলা নববর্ষ বরণের এ অনুষ্ঠানে মানুষের ভিড় দেখা গেছে। অনুষ্ঠান শুরুর আগে অনেক মানুষ রমনার বটমূলে এসে উপস্থিত হয়। সোয়া ছয়টায় অনুষ্ঠান শুরু হলে ধীরে ধীরে আরও দর্শক আসেন। বটমূলের সামনে বসার জায়গা মানুষে পূর্ণ হয়ে যায়। অনেকে দাঁড়িয়ে অনুষ্ঠান দেখেন। পার্কের ভেতরেও অনেক মানুষ ছিলেন।

অনুষ্ঠানস্থলে কথা হলো রোকসানা আহমেদের সঙ্গে। তিনি থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। তিনি জানালেন, এবার দেশে থাকায় দীর্ঘ ২৫ বছর পর তিনি রমনা বটমূলে বর্ষবরণের আয়োজনে আসতে পেরেছেন। তাই উচ্ছ্বাসটাও বেশি। রোকসানা বললেন, ‘প্রবাসী হওয়ার পর যখনই দেশে আসি, বৈশাখ পাই না। আড়াই যুগ পর এবার সেই সুযোগ হলো। সকালবেলায় বটমূলের সামনে বসে অনুষ্ঠান দেখতে পেয়ে অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করছে।’

বাংলা বর্ষবরণের অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে লিখিত বক্তব্য দেন ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি ডা. সারওয়ার আলী। রমনার বটমূল, ঢাকা, ১৪ এপ্রিল
ছবি: প্রথম আলো

রাজধানীর লালবাগ এলাকা থেকে পাঁচ বছরের মেয়ে আয়রাকে নিয়ে এসেছিলেন শাহ হোসেন। এখানে এসে মেয়েকে একটি দোতরা ও কাগজের ঘূর্ণি কিনে দিয়েছেন তিনি। শাহ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রতিবছর রমনা বটমূলে বর্ষবরণের আয়োজনে পরিবার নিয়ে আসি। বড় মেয়ের এসএসসি পরীক্ষা থাকায় ওকে আনা হয়নি। ছোট মেয়েকে এনেছি, যাতে সন্তানেরা বাঙালি সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের সংস্পর্শ পায়।’

বটমূলে আসা দর্শনার্থীদের মধ্যে বৈশাখী সাজ দেখা গেছে। নারীদের বেশির ভাগ শাড়ি পরে এসেছেন। পুরুষদের পরনে পাঞ্জাবি বেশি। শাড়ি–পাঞ্জাবির রঙে লাল-সাদার আধিক্য। শিশু-কিশোরদের পোশাকেও লাল-সাদার প্রাধান্য দেখা গেছে।

বর্ষবরণের অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে ‘নববর্ষের কথন’ বিষয়ে বক্তব্য দেন ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি সারওয়ার আলী। তিনি বলেন, সবাই ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণ, মুক্তচিন্তার নির্ভয় প্রকাশ, আবহমান সংস্কৃতির নির্বিঘ্ন যাত্রা হৃদয়ে ধারণ করলে মুক্তির আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সুগম হবেই।

সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গাওয়ার মধ্য দিয়ে শেষ হয় ছায়ানটের বর্ষবরণের আয়োজন। রমনা বটমূল, ঢাকা, ১৪ এপ্রিল
ছবি: জাহিদুল করিম

সারওয়ার আলী আরও বলেন, মুক্তির অন্বেষায়, দীর্ঘ বন্ধুর পথপরিক্রমায় অর্ধশতবর্ষ আগে, বিপুল আত্মদানের বিনিময়ে অর্জিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এই যাত্রাপথের নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে। ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছে বাঙালির শিল্প, সাহিত্য, সংগীতসহ সব মাধ্যম ও বিভিন্ন স্থাপনায়। বাঙালির স্বাধিকার অর্জনের সংগ্রামে অনন্য মাত্রা যুক্ত করেছে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে এই অসাম্প্রদায়িক উৎসব, নতুন বাংলা বছরকে বরণ করার আয়োজন।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

‘আমরা এক আলোকিত দেশ ও সমাজের স্বপ্ন দেখি’ মন্তব্য করে সারওয়ার আলী বলেন, ‘প্রত্যাশা করি, দেশের মানুষ সর্বজনের শান্তি-স্বস্তি-নিরাপত্তা নিশ্চিত করে ধর্ম-জাতি-বিত্তের বিভাজন ভাঙবে, গড়বে উদার সম্প্রীতির সহিষ্ণু সমাজ।’

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন