কারওয়ান বাজার এলাকায় কারা, কীভাবে ছিনতাই করে

ছিনতাইকারীকে ধরার পর পুলিশ সদস্যের সঙ্গে কথা বলছেন বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রী।
ফাইল ছবি

রাজধানীর কারওয়ান বাজার ও এর আশপাশে দিনে অন্তত তিন থেকে পাঁচটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। তিনটি পেশাদার দলের সঙ্গে তেজগাঁও এলাকার ২৫ জন ভাসমান শিশু জড়িত রয়েছে চুরি ও ছিনতাইয়ে।

ঢাকা মহানগর পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে ও প্রথম আলোর অনুসন্ধানে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

অফিস শুরু ও শেষ হওয়ার সময় কারওয়ান বাজার ও ফার্মগেটের মাঝে রহমান ম্যানশনের সামনে, তেজগাঁও ট্রাক টার্মিনাল, সাতরাস্তা ও এফডিসির সামনে একাধিক দলে বিভক্ত হয়ে ছিনতাইয়ে নামে চক্রের সদস্যরা। চক্রের প্রধান চোখের ইশারায় লক্ষ্য ঠিক করে দেন। চক্রের সদস্যরা সেই অনুযায়ী ছিনতাই করে পালিয়ে যায়।

বাসের জানালার পাশে বসা যাত্রীর মুঠোফোন, পথচারী, রিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার যাত্রীদের অস্ত্রের মুখে ভয় দেখিয়ে টাকা ও দামি জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। চক্রটি কারওয়ান বাজারে আসা পণ্যবাহী পিকআপ ভ্যান ও ট্রাকের পণ্যও ছিনিয়ে নেয়।

সম্প্রতি কারওয়ান বাজার থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পারিশা আকতারের মুঠোফোন ছিনতাইয়ের পর তেজগাঁও থানা-পুলিশ ও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) কারওয়ান বাজারকেন্দ্রিক ছিনতাইকারী চক্রের ২৭ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে। চক্রের গ্রেপ্তার সদস্যরা ডিবিকে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, গত তিন মাসে কারওয়ান বাজার ও আশপাশ এলাকা থেকে অর্ধশতাধিক চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটিয়েছে তারা।

৪ আগস্ট কারওয়ান বাজার অফিস থেকে বাসায় ফেরার পথে ফার্মগেট এলাকায় ছিনতাইয়ের শিকার হন দৈনিক ইত্তেফাকের বিশেষ প্রতিনিধি জামাল উদ্দিন। ছিনতাইকারীরা তাঁর হাত থেকে ব্যাগ ছিনিয়ে পালিয়ে যায়। ব্যাগে নগদ সাত হাজার টাকা, একটি মুঠোফোন ও ব্যাংকের কার্ড ছিল।

জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফার্মগেটে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছিনতাই চক্রের সদস্যরা আমার হাতে থাকা ব্যাগটি ছিনিয়ে পালিয়ে যায়। ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা করেছি। ঘটনার এক সপ্তাহ পরও আমার ব্যাগ উদ্ধার ও জড়িত ছিনতাইকারীদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।’

কারওয়ান বাজার এলাকার একাধিক ব্যবসায়ী বলেন, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ কারওয়ান বাজারে আসেন। বিপুল লোকসমাগম হওয়ায় এই এলাকায় প্রতিদিনই ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। পুলিশ নির্দিষ্ট কয়েকটি স্থানে বসে টহল দেন। ব্যবসায়ীদের দাবি, ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা পুলিশের ওপর নজর রাখে। যেখানে পুলিশের উপস্থিতি থাকে না, সেখানে ছিনতাই করে তারা। ছিনতাই বন্ধে পুলিশের নজরদারি বাড়ানোর দাবি জানান ব্যবসায়ীরা।

আরও পড়ুন

পুলিশের কয়েক কর্মকর্তা বলেন, চুরি ও ছিনতাইয়ের অধিকাংশ ঘটনায় ভুক্তভোগী থানায় মামলা করেন না। মামলা না করায় পুলিশ জানতে পারে না। ফলে জিনিসপত্রও উদ্ধার হয় না। তেজগাঁও থানা-পুলিশের একটি সূত্র জানায়, গত জুন মাসে তেজগাঁও এলাকায় ছিনতাইয়ের ঘটনায় মোট ছয়টি মামলা হয়েছিল। আর জুলাই মাসে মামলা হয়েছে মাত্র একটি।

তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অপূর্ব হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা কম হয়। তবে মুঠোফোন চুরি ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় প্রতি মাসে প্রায় অর্ধশতাধিক সাধারণ ডায়েরি হয়। মাসে ৪০টির মতো মুঠোফোন উদ্ধার করে ফিরিয়েও দেয় বলে জানিয়েছে পুলিশ।

ডিএমপি সূত্র আরও জানায়, রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগে। ছিনতাইয়ের ঘটনায় সর্বাধিক মামলাও হয় এ বিভাগে।

আরও পড়ুন

ছিনতাইয়ে ২৫ ভাসমান শিশু

ডিবি সূত্র বলছে, কারওয়ান বাজারকেন্দ্রিক ছিনতাইয়ে তিনটি দল জড়িত। একটি দলের নেতৃত্ব দেন লোকমান হোসেন। তাঁর দলে ছয় থেকে সাতজন সদস্য রয়েছে। গত ২৬ জুলাই লোকমান হোসেনসহ তাঁর চক্রের আটজনকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবির তেজগাঁও বিভাগ। আর দুটি দলের নেতৃত্ব দেন কালু ও আলমগীর হোসেন। ডিবি কালুসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে। তবে আলমগীর ও তাঁর চক্রের সদস্যরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে ভাসমান অন্তত ২৫টি শিশু রয়েছে। তারা তেজগাঁও এলাকার বিভিন্ন বস্তি ও রেললাইনের ওপর থাকা ট্রেনের বগিতে থাকে। ছিনতাইয়ে জড়িত এসব ভাসমান শিশুদের একটি তালিকা করেছে ডিবি।

এ প্রসঙ্গে ডিবির তেজগাঁও বিভাগের সহকারী কমিশনার হাসান মুহাম্মদ মুহতারিম প্রথম আলোকে বলেন, কারওয়ান বাজারকেন্দ্রিক ছিনতাই বন্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। কয়েকজনকে ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

লোকমান কারওয়ান বাজার এলাকায় ১২ বছর ধরে ছিনতাই করছেন বলে জানিয়েছে ডিবি। তিনি মূলত বিভিন্ন স্পটে দাঁড়িয়ে পুলিশের ওপর নজর রেখে তাঁর চক্রের সদস্যদের দিয়ে ছিনতাই করান। এই চক্রের সদস্যরা চুরি–ছিনতাই ছাড়াও কারওয়ান বাজারে আসা পণ্যবাহী গাড়ি থেকে মালামাল ছিনতাই করে। তারা বেশির ভাগ সময় কারওয়ান বাজার ও এফডিসি এলাকায় ছিনতাই করে।

ডিবি সূত্র আরও জানায়, আলমগীরের নেতৃত্বে সাত থেকে আটজন কারওয়ান বাজার ও তেজগাঁও ট্রাক টার্মিনাল ও সাতরাস্তা মোড় এলাকায় ছিনতাই করেন। তাঁরা মূলত রিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার যাত্রীদের অস্ত্রের মুখে থামিয়ে নগদ টাকা, মুঠোফোন ও দামি জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেন।

কালুর নেতৃত্বে থাকা দলটি চুরি ও ছিনতাইয়ের বাইরে ডাকাতির সঙ্গেও জড়িত। তাঁরা কারওয়ান বাজার, ফার্মগেটসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় চুরি ও ছিনতাইয়ের পাশাপাশি পণ্যবাহী ট্রাক ও পিকআপ ভ্যানে ডাকাতি করেন।