এবার ‘ভিউ ব্যবসায়ীদের কবলে’ বাবা

আ জ ম আজিজুল ইসলাম, তাঁর স্ত্রী লায়লা আফরোজা ও মেয়ে নাফিসা নাওয়াল বিনতে আজিজছবি: পরিবারের সৌজন্যে

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মা ও মেয়ে হত্যার ঘটনায় স্বজন হারানো আ জ ম আজিজুল ইসলাম এবার ‘ভিউ ব্যবসায়ীদের’ কবলে পড়েছেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক এবং ভিডিও প্রচারমাধ্যম ইউটিউবে কেউ কেউ বলছেন, স্ত্রী ও সন্তান হত্যাকাণ্ডে আজিজুল ইসলাম জড়িত। এতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন আজিজুল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেকে বলতে চাইছেন, খুনের পেছনে নাকি আমার হাত আছে। স্ত্রীহারা, সন্তানহারা বাবার জন্য এটা খুব কষ্টের ও যন্ত্রণার।’

৮ ডিসেম্বর খুন হন মা লায়লা আফরোজা (৪৮) ও মেয়ে নাফিসা নাওয়াল বিনতে আজিজ (১৫)। তাঁদের শরীরে ধারালো অস্ত্রের অনেক আঘাত ছিল।

হত্যার ঘটনাটিতে আজিজুল ইসলামের করা মামলায় ১০ ডিসেম্বর ঝালকাঠির নলছিটি থেকে গৃহকর্মী আয়েশা ও তাঁর স্বামী রাব্বি শিকদারকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। রিমান্ড শেষে আয়েশা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন।

খুন হওয়া স্ত্রী ও মেয়ের ছবি দেখছেন আ জ ম আজিজুল ইসলাম
ছবি: মানসুরা হোসাইন

পুলিশও বলছে, তারা হত্যাকাণ্ডে আজিজুল ইসলামের কোনো সংশ্লিষ্টতা পায়নি। মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেজবাহ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ঘটনার সঙ্গে লায়লা আফরোজের স্বামী কোনোভাবে জড়িত—সে রকম কোনো তথ্য পাইনি। অনেকের মনেই প্রশ্ন, একজন নারী একা কীভাবে দুজন মানুষকে মেরে ফেললেন। আয়েশা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তারও বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন।’

আজিজুল ইসলামকে জড়িয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা কথা ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ কর্মকর্তা মেজবাহ বলেন, ফেসবুকে অনেকে ভিউ ব্যবসার জন্য নানা গুজব ছড়ায়।

আয়েশাকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, চুরি করে পালানোর সময় তাঁকে পেছন থেকে ধরে পুলিশে দেওয়ার কথা বললে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি লায়লাকে ছুরিকাঘাত করেন। মাকে বাঁচাতে এলে নাফিসাকেও ছুরিকাঘাত করা হয়। দুজনকে হত্যার পর বাথরুমে গিয়ে গোসল করে নাফিসার স্কুলড্রেস পরে পালিয়ে যান আয়েশা।

পরে ভবনটির সিসিটিভি ক্যামেরার ভিডিওতে দেখা যায়, ঘটনার দিন আয়েশা বোরকা পরে ভেতরে ঢুকেছিলেন। বেরিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর পরনে ছিল নিহত নাফিসার স্কুলড্রেস।

আরও পড়ুন
আ জ ম আজিজুল ইসলামের কাছে এই ছবি এখন স্মৃতি
ছবি: পরিবারের কাছ থেকে পাওয়া

আজিজুল ইসলাম উত্তরায় সানবিমস স্কুলের শিক্ষক। মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডের নিজের যে ফ্ল্যাটে স্ত্রী ও সন্তান খুন হয়েছেন, সেখানে থাকার মতো মানসিক অবস্থা নেই তাঁর। এ কারণে ধানমন্ডিতে ছোট বোনের বাসায় এখন থাকছেন তিনি।

১৮ ডিসেম্বর ছোট বোন জুবাইদা গুলশান আরার বাসায় স্ত্রী ও সন্তানের হত্যাকাণ্ড নিয়ে নানা কথা বলেন আজিজুল ইসলাম। এ সময় তাঁর বড় বোন আঞ্জুমান আরা ও ভাগনি নূরেম মাহপারা প্রাপ্তিও উপস্থিত ছিলেন। আজিজুলের এই স্বজনেরা বারবার বলছিলেন, তাঁরা হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান।

আজিজুল ইসলাম বলেন, তিনি ও তাঁর স্ত্রী ‘একটু বেশি বয়সেই’ বিয়ে করেছিলেন, ২০০৮ সালে।

আজিজুল বলেন, ‘জানেন, সবার সামনেই স্ত্রীকে ডাকতাম নীনা বউ। সকালে বাইরে বের হওয়ার সময় স্ত্রীর দুই হাত ধরতাম। তারপর ওর মাথায় ধরে আদর করতাম। সেদিন তেমনই বের হয়েছিলাম। কিন্তু কে জানত, সেটাই আমাদের শেষবিদায় ছিল।’

সন্দেহভাজন গৃহকর্মী ঘটনার দিন সকালে বাসাটিতে ঢোকেন বোরকা পরে। দেড় ঘণ্টার কিছু সময় পরে তিনি স্কুলড্রেস পরে বাসা থেকে বের হয়ে যান। নিহত ব্যক্তিদের বাসার সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়া গৃহকর্মীর ছবি
ছবি: ইউএনবি থেকে নেওয়া

মেয়ে নাফিসা নাওয়ালকেও কখনো নাম ধরে ডাকতেন না আজিজুল। ‘জাদু বাবা’, ‘বাবা’—এমন নানাভাবে ডাকতেন। পরীক্ষা শেষে স্কুলপার্টির জন্য খুন হওয়ার আগের দিনই মেয়ে মেরুন রঙের একটি জুতা কিনেছিল। এটিই ছিল মেয়েকে দেওয়া তাঁর শেষ উপহার।

নাফিসা মোহাম্মদপুরের প্রিপারেটরি স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল।

লায়লা ও নাফিসার মরদেহ নাটোরে গ্রামের বাড়িতে দাফন করে ঢাকায় ফেরেন আজিজুল ইসলাম। তারপর থানা থেকে অনুমতি নিয়ে নিজের ফ্ল্যাটটি পরিষ্কার করেছেন। পরিষ্কার করার আগে বিভিন্ন ঘরের ভিডিও করে রেখেছেন। সেই ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, ঘরগুলোর মেঝে, দেয়াল, আশপাশের জিনিসপত্রে রক্তে মাখামাখি। আজিজুল এখন আর সেসব স্মৃতি মনে করতে চান না।

আরও পড়ুন

কেন খুন হলেন মা-মেয়ে

কোন কারণে স্ত্রী ও মেয়ে খুন হয়েছেন, তার হিসাব মেলাতে পারছেন না আজিজুল ইসলামও। ঘটনার দিন তিনি সকালে স্কুলের পথে বেরিয়ে যান, বাসায় ফিরে দেখেন স্ত্রীর রক্তাক্ত লাশ। রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকা মেয়ের শরীর তখনো একটু গরম মনে হওয়ায় তাকে পাঠানো হয়েছিল শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানেই চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

আজিজুল ইসলামের ভাগনি নূরেম মাহপারা প্রাপ্তি প্রথম আলোকে বলেন, নাফিসার গলায় আঘাতের ছয়টি চিহ্ন ছিল। আর তাঁর মামির শরীরে ছিল ৩০টির বেশি আঘাতের চিহ্ন।

২০১২ সাল থেকে নিজের ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন আজিজুল ও লায়লা দম্পতি। আজিজুল ইসলাম বলেন, তাঁর স্ত্রী বাসার কাজ নিজেই করতেন। শুধু ঘর মোছার জন্য খণ্ডকালীন গৃহকর্মীর প্রয়োজন ছিল। ভবনের নিরাপত্তা প্রহরীকে গৃহকর্মী লাগবে, তা বলে রেখেছিলেন।

লায়লা আফরোজা ও তাঁর মেয়ে নাফিসা নাওয়াল বিনতে আজিজ
ছবি: পরিবারের সৌজন্যে

আজিজুল ইসলাম বলেন, তাঁর পরিবারের সঙ্গে কারও কোনো শত্রুতা নেই। তাই এই খুনের পেছনে আসলে অন্য কোনো কারণ আছে কি না, তা–ও বুঝতে পারছেন না।

‘অনেকেই বলাবলি করছেন, আমার নাকি অনেক টাকা। এটাও অতিরঞ্জিত তথ্য। ফ্ল্যাট কিনেছি ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে। স্কুলের বেতনের টাকা, কোচিং থেকে পাওয়া টাকা আর ভবনে আমার গ্যারেজের জন্য যে জায়গা, তা একজন ভাড়া নিয়েছেন আমার নিজস্ব গাড়ি নেই বলে। এই টাকা দিয়ে ফ্ল্যাটের কিস্তি পরিশোধ করেছি। সব খরচ শেষে মাসে স্বল্প কয়েকটা টাকা সঞ্চয় করতাম,’ বলেন আজিজুল ইসলাম।

বাসা থেকে খুব বেশি যে মূল্যবান জিনিস গায়েব হয়েছে, তা–ও মনে হচ্ছে না আজিজুল ইসলামের। দুটি ল্যাপটপ, দুটি মুঠোফোন (একটি স্বল্প দামের), স্ত্রীর গলার একটি সোনার চেইন খোয়া গেছে। এর বাইরে স্ত্রী বা মেয়ে আলমারিতে যদি কোনো গয়না রেখে থাকে, তা খোয়া গিয়ে থাকতে পারে।

আরও পড়ুন
আ জ ম আজিজুল ইসলাম
ছবি: মানসুরা হোসাইন

ঘটনার আগের দিন অভিযুক্ত আয়েশা দুই হাজার টাকা চুরি করে ধরা পড়েছিলেন—গণমাধ্যমে এমন তথ্য এসেছে উল্লেখ করে আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘এমন চুরির কথা আমার স্ত্রী আমাকে বলেনি। স্ত্রীর সঙ্গে ফোনে বা সরাসরি সারা দিনে নানা কথা বলতাম। চুরির ঘটনা ঘটলে আমি জানতাম।’

আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘এই আয়েশাই আমার বাসায় কাজ করতে এসেছিল। পুলিশ তাকেই ধরেছে, এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে সবার মতো আমারও প্রশ্ন, একা কেমনে দুজন মানুষকে মেরে ফেলল?’

স্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথা বলা প্রসঙ্গে আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘কেউ কেউ লিখেছে, আমি নাকি ঘটনার দিন স্ত্রীর ফোনে অনেকবার ফোন করে না পেয়ে স্কুল থেকে দ্রুত চলে এসেছি। কিন্তু সেদিন স্কুলে যাওয়ার পর স্ত্রীর সঙ্গে কোনো কথাই হয়নি। স্কুলের বাচ্চাদের পরীক্ষা চলছিল, পরীক্ষার সময় মুঠোফোন ব্যবহার করা যায় না।’

‘ফেক নিউজ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে’

কোনো ঘটনা ঘটলেই ফেসবুক ও ইউটিউবে নানাজন নানা তথ্য দেন। অনেক ক্ষেত্রেই তথ্যের সত্যতা থাকে না। কেউ কেউ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচারে লিপ্ত। এর বিপরীতে প্রতিকারের সুযোগও কম। কিন্তু আজিজুল ইসলামের মতো বহু মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হচ্ছে মিথ্যা তথ্যের কারণে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সততা, বন্ধুত্ব, পরিবারসহ আমাদের বিশ্বাসের যে জায়গাগুলো ছিল, তা দুর্বল হয়ে গেছে। ধ্রুব সত্য বলে এখন আর কিছু নেই। সামাজিক, রাজনৈতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। মূল্যবোধের সংকটও চলছে। ফেক নিউজ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। বলা যায়, আমরা সত্য–উত্তর যুগে বাস করছি।’

মনিরুল ইসলাম খান আরও বলেন, কেউ কোনো কাজ করে না থাকলে, সেই কাজের জন্যই দায়ী করলে তা ওই ব্যক্তিকে মর্মাহত করে, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলে।