ঢাকা দক্ষিণ সিটি: পড়ে আছে শতকোটি টাকার জবাইখানা

হাজারীবাগের পাশাপাশি কাপ্তানবাজারে আরেকটি জবাইখানার নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৮ সালে। সেটিও পড়ে আছে পরিত্যক্ত অবস্থায়।

হাজারীবাগ আধুনিক পশু জবাইখানা। সম্প্রতি গজমহল এলাকায়প্রথম আলো

নগরবাসীকে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে গরু-ছাগলের মাংস খাওয়াতে প্রায় শতকোটি টাকা খরচ করে আধুনিক জবাইখানা নির্মাণ করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। কিন্তু এ জবাইখানা পরিচালনার দায়িত্ব কেউ নিতে চাইছে না। এক বছর ধরে দফায় দফায় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়েও এটি পরিচালনার জন্য কাউকে না পেয়ে বিপাকে পড়েছে সংস্থাটি।

রাজধানীর হাজারীবাগের গজমহল এলাকায় আধুনিক এ পশু জবাইখানার নির্মাণকাজ পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই ২০১৯ সালে সাবেক মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন এর উদ্বোধন করেন। কিন্তু গত চার বছরে সেখানে একটি পশুও জবাই হয়নি।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, পাঁচতলাবিশিষ্ট এই জবাইখানার প্রধান ফটকে তালা ঝুলছে। এটি দেখভালের জন্য ফটকের ভেতরে বা বাইরে কোনো নিরাপত্তাকর্মী বা অন্য কেউ নেই।

দেশের বাইরে থেকে বিশেষজ্ঞ এনে চলতি মাসেই এসব যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করা হবে। এরপর বাকি দুটি প্যাকেজের কাজ শুরু করা হবে।’
খায়রুল বাকের, প্রকল্প পরিচালক ও ঢাকা দক্ষিণ সিটির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী

বিপুল ব্যয়ে আধুনিক এই পশু জবাইখানা নির্মাণ করা হলেও এটি কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়নি। সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের যুক্তি, রাজধানীতে আরও কয়েকটি জবাইখানা থাকলে সম্ভাব্যতা যাচাই করার প্রয়োজন ছিল। বর্তমান বাস্তবতায় নাগরিকদের সুবিধার জন্যই এমন জবাইখানা চালু হওয়া দরকার। এটি চালু না হওয়ার জন্য মানুষের অসচেতনতাকে দায়ী করছেন তাঁরা।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির সম্পত্তি বিভাগ সূত্র বলছে, জবাইখানাটি পরিচালনা করার জন্য এ পর্যন্ত দরপত্র জমা দিতে তিনবার করে সময় দিয়ে পত্রিকায় দুই দফায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দেয়নি। অনানুষ্ঠানিকভাবে এটি পরিচালনার আগ্রহ দেখালেও পরে করপোরেশনের সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেনি।

সম্পত্তি বিভাগের সূত্র আরও বলছে, তিন বছরের জন্য জবাইখানা পরিচালনা করতে সিটি করপোরেশনকে ৮ কোটি ৫৬ লাখ ১১ হাজার ২১০ টাকা দিতে হবে। এমন তথ্য উল্লেখ করে গত বছরের ডিসেম্বরে প্রথম বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলেও কেউ দরপত্র জমা দেয়নি। পরে ইজারামূল্য কমিয়ে ৬ কোটি ১৬ লাখ ৪০ হাজার ৩১৯ টাকা নির্ধারণ করে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে আবার বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এ দফায়ও কেউ দরপত্র জমা দেয়নি। ইতিমধ্যে দরপত্র জমা দেওয়ার সময় শেষ হয়ে গেছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. মুনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ইজারামূল্য কমিয়ে আবারও বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা চলছে। এর পাশাপাশি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে।

হাজারীবাগের পাশাপাশি গুলিস্তানের কাপ্তানবাজারে আরেকটি আধুনিক পশু জবাইখানার নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৮ সালে। কিন্তু এক বছর ধরে এটিও পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা।

অচল না সচল, এ নিয়েও সংশয়

ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রকৌশল বিভাগ সূত্র বলছে, ২০১৭ সালে নির্মাণকাজ শুরুর পর হাজারীবাগে পশু জবাইখানা তৈরিতে ৮১ কোটি ১৯ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। সেখানে ঘণ্টায় ৩০টি গরু ও ৬০টি ছাগল জবাই করা যাবে। প্রতিদিন ১৬ ঘণ্টা জবাইখানা চালু রাখা যাবে। এদিকে এ জবাইখানায় নতুন করে কিছু যন্ত্র বসাতে হবে। পাশাপাশি আনুষঙ্গিক কিছু কাজ করতে সব মিলিয়ে ১৫ কোটি টাকার বেশি খরচ হতে পারে। সে হিসাবে এই জবাইখানার পেছনে সরকারের প্রায় শতকোটি টাকা খরচ হচ্ছে।

তবে সমস্যা হচ্ছে, যেহেতু চার বছর আগে জবাইখানায় যন্ত্রপাতি বসানো হয়েছে, তাই এগুলো এখন সচল আছে কি না, এ নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় যন্ত্রপাতিগুলো ঠিক আছে কি না, তা চলতি ডিসেম্বরে পরীক্ষা করে দেখা হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক ও ঢাকা দক্ষিণ সিটির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী খায়রুল বাকের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশের বাইরে থেকে বিশেষজ্ঞ এনে চলতি মাসেই এসব যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করা হবে। এরপর বাকি দুটি প্যাকেজের কাজ শুরু করা হবে।’

আরও পড়ুন

পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে আরেকটি

হাজারীবাগের পাশাপাশি গুলিস্তানের কাপ্তানবাজারে আরেকটি আধুনিক পশু জবাইখানার নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৮ সালে। কিন্তু এক বছর ধরে এটিও পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা।

এই জবাইখানা ভবনের কাজ শুরুর পরই ৩৩ কোটি টাকা খরচ করে ২০১৯ সালে যন্ত্রপাতি কেনা হয়। এগুলো গত বছর বসানো হলেও এখন সচল আছে কি না, সংশয় রয়েছে। জবাইখানাটি নির্মাণে প্রায় ৫২ কোটি টাকা খরচ করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি।

প্রকৌশলী খায়রুল বাকের প্রথম আলোকে বলেন, এ জবাইখানার নির্মাণকাজ যথাসময়ে শেষ না হওয়ায় ঠিকাদারের কার্যাদেশ বাতিল করা হয়েছে। নতুন ঠিকাদার পেতে তাঁরা দরপত্র আহ্বান করেছেন।

সিটি করপোরেশনের পরিকল্পনা ছিল, এ দুটি জবাইখানা ঠিকমতো চললে আরও জবাইখানা নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হবে। কিন্তু প্রায় ১৫০ কোটি টাকা খরচ করে এসব নির্মাণের পর এখন পর্যন্ত সুফল না পাওয়ায় উদ্বেগে পড়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

আরও পড়ুন

দায় কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে

জনগণের কাছে জবাবদিহি না থাকায় ইচ্ছেমতো বিশাল অপচয়ের প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে বলে মনে করছেন ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান।

এই নগর পরিকল্পনাবিদের মতে, যেকোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে এটার কার্যকারিতা কতটুকু, তা দেখতে সম্ভাব্যতা যাচাই করতে হয়। বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে সম্ভাব্যতা যাচাই না করে নির্মাণ করার কারণে এটি (জবাইখানা) এখন বিষফোড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। অপেশাদারি আচরণের কারণেই এ পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, জনগণের করের এসব টাকার দায় কর্তৃপক্ষকেই নিতে হবে।