নীতিমালার তোয়াক্কা না করে সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি, জনদুর্ভোগে ঢাকা উত্তরের মানুষ

পশ্চিম আগারগাঁওয়ের শাপলা হাউজিং এলাকার একটি সড়কছবি: প্রথম আলো

রাজধানীর পশ্চিম আগারগাঁওয়ের শাপলা হাউজিং আবাসিক এলাকা। পানিনিষ্কাশনে একটি গলিপথে নালা নির্মাণের কাজ করছে ঢাকা উত্তর সিটি। আবার পানি সরবরাহের সংযোগ স্থাপনে হাউজিংয়ের প্রধান সড়ক খুঁড়েছে ঢাকা ওয়াসা। উন্নয়নকাজ করতে গিয়ে সংস্থা দুটির কোনোটি সড়ক খননের নীতিমালা মানছে না। খামখেয়ালি সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি–কাটাকাটিতে দুর্ভোগে স্থানীয় বাসিন্দারা।

 শাপলা হাউজিংয়ের বাসিন্দা সাকিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গত জুন থেকে মূল সড়কের এক পাশ কেটে পানির পাইপ বসানো হয়েছে। কাটা সড়ক এখনো মেরামত করা হয়নি। এখন আবার এক মাস ধরে আরেকটি সড়কে ড্রেনের কাজ করা হচ্ছে। এ সড়কে যান চলাচল এখন পুরোপুরি বন্ধ। এতে দিনের পর দিন এলাকাবাসীকে কষ্ট করতে হচ্ছে। কবে যে এ দুর্ভোগের মুক্তি মিলবে।

তিন মাসের বেশি সড়কটি এ অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে। কবে পিচঢালাই দেওয়া হবে কেউ জানেন না। এই সড়কে রিকশাও চলতে পারে না। বয়স্ক ও শিশুদের কষ্ট করে হেঁটে চলতে হয়।
—রোকনুজ্জামান খান, পশ্চিম মণিপুরের মোল্লাপাড়ার বাসিন্দা

সমন্বয়হীন এমন খোঁড়াখুঁড়ি চলছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আওতাধীন বিভিন্ন এলাকায়। কোথায়, কোন সংস্থা সড়ক খুঁড়ছে কিংবা কাটছে, এর কোনো বিজ্ঞপ্তি বা সাইনবোর্ড টাঙানো নেই। সংশ্লিষ্ট সড়কে জনসাধারণের চলাচলের ক্ষেত্রে সতর্কতা হিসেবে কোনো ফিতাও টানানো হয়নি। কোথাও সড়ক খুঁড়ে ওঠানো মাটি দীর্ঘদিন ধরে ফেলে রাখা হয়েছে। কোথাও আবার সড়ক মেরামতের জন্য আনা বালু, ইট ও পাথর রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।

৬০ ফুট সড়কের কামাল সরণি এলাকা
ছবি: প্রথম আলো

বিভিন্ন প্রকল্পের উন্নয়নকাজসহ নানা কাজেই সড়ক খনন করা ও পরে যথাসময়ে তা মেরামত না করায় প্রতিবছরই রাজধানীবাসীকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। তাই সিটি করপোরেশনভুক্ত এলাকায় সড়ক খননে সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় আনতে প্রণয়ন করা হয়েছে ‘ঢাকা মহানগরীর সড়ক খনন নীতিমালা-২০১৯’। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ছাড়াও ঢাকা ওয়াসা, তিতাস গ্যাস, ডিপিডিসি, ডেসকো, বিটিসিএলের মতামত ও সুপারিশের ভিত্তিতে নীতিমালা চূড়ান্ত করা হয়। তবে তা মানার ব্যাপারে উদ্যোগ নেই।

সড়ক খনন ও পরে যথাসময়ে তা মেরামত না করায় প্রতিবছরই রাজধানীবাসীকে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। সড়ক খননে সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় আনতে প্রণয়ন করা হয়েছে ‘ঢাকা মহানগরীর সড়ক খনন নীতিমালা-২০১৯’। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ছাড়াও ঢাকা ওয়াসা, তিতাস গ্যাস, ডিপিডিসি, ডেসকো, বিটিসিএলের মতামত ও সুপারিশের ভিত্তিতে নীতিমালা চূড়ান্ত করা হয়। তবে তা মানার ব্যাপারে উদ্যোগ নেই।

 নীতিমালায় কী আছে

 নীতিমালায় উল্লিখিত নির্দেশনার কয়েকটি হলো কোনো একটি এলাকার একটি সড়কের পুরোটা একসঙ্গে খোঁড়া যাবে না। মাসের পর মাস একটানা কোনো সড়ক খোঁড়া যাবে না। ১৫ দিনে ভাগ করে খননকাজ করতে হবে। ধুলাবালি উড়ে যাতে ভোগান্তি না হয়, সে জন্য নিয়মিত পানি ছিটাতে হবে। সতর্কীকরণ ফিতা দিয়ে খনন এলাকা ঘিরে রাখতে হবে। চলাচলে বিঘ্ন ঘটিয়ে মালামাল মজুত করে রাখা যাবে না।

 এ ছাড়া সিটি করপোরেশনভুক্ত এলাকায় কোনো সংস্থা বা ব্যক্তি সড়ক খুঁড়তে চাইলে তা আগে করপোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তাকে জানাতে হবে। খননের অনুমতি দেওয়ায় গঠিত ওয়ানস্টপ সমন্বয় সেলের অনুমোদন নিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি করতে হবে। কোনো সংস্থা বা ব্যক্তি বিনা অনুমতিতে সড়ক খুঁড়লে মূল ক্ষতির পাঁচ গুণ জরিমানা আদায় করতে পারবে সিটি করপোরেশন। যদিও কাউকে জরিমানা করার ঘটনা জানা যায় না।

মিরপুরের মধ্য মণিপুর এলাকার একটি সড়ক
ছবি: প্রথম আলো

 নীতিমালায় আরও বলা হয়েছে, সড়ক খননে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাকে দীর্ঘমেয়াদি মহাপরিকল্পনা তৈরি করতে হবে এবং তা সিটি করপোরেশনকে জানাতে হবে। আর বছরের খনন পরিকল্পনা এপ্রিলের মধ্যে দিতে হবে। আধুনিক জরিপ পদ্ধতিতে সড়কের নিচে পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ লাইন ও অপটিক্যাল কেব্‌ল স্থাপনের মতো পরিষেবার নকশা প্রণয়ন করতে হবে। তবে নীতিমালা প্রণয়নের পাঁচ বছর পেরোলেও এসব ক্ষেত্রে অগ্রগতি নেই।

আরও পড়ুন

 দফায় দফায় খনন

 ঢাকা উত্তর সিটির ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাধীন মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডে গত ফেব্রুয়ারিতে খননকাজ চালিয়েছিল ঢাকা ওয়াসা। ওই সময় পাশের গজনবী রোডে খুঁড়েছিল ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (ডিপিডিসি)। পরে গত জুনে সড়ক দুটি মেরামত করে ঢাকা উত্তর সিটি কর্তৃপক্ষ। কিন্তু দুই সড়কেই আবার জায়গায় জায়গায় খুঁড়ে পানির সংযোগ স্থাপনের কাজ করছে ওয়াসা।

 মোহাম্মদপুরের বেশির ভাগ সড়কেই চলতি বছরের শুরুতে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়। সড়কগুলোতে নালা নির্মাণের পাইপ বসিয়েছে সিটি করপোরেশন। কিছু সড়কে পানির পাইপ বসিয়েছে ঢাকা ওয়াসা। কিছু সড়ক কাটা হয়েছে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেটের সংযোগ স্থাপনে। এর মধ্যে কাটাসুর, শের-শাহ সুরি রোড, তাজমহল রোড, বাঁশবাড়ি রোড, রাজিয়া সুলতানা রোড ও নুরজাহান রোডের সংযোগ সড়কগুলোর (বাইলেন) কোথাও এক পাশে, কোথাও কিছু দূর পরপর আড়াআড়ি করে কেটে রাখা হয়েছে।

পশ্চিম মণিপুরের মোল্লাপাড়া এলাকা
ছবি: প্রথম আলো

অন্যদিকে মোহাম্মদপুরের নবোদয় ও মোহাম্মদিয়া হাউজিং লিমিটেডের প্রধান রাস্তা এবং রিং রোডে একটি প্রকল্পের আওতায় মেরামতকাজ করেছিল উত্তর সিটি কর্তৃপক্ষ। সড়কগুলোতে এখন খোঁড়াখুঁড়ি করছে ঢাকা ওয়াসা।

 এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটির প্রকৌশলী ফারুক হাসান মো. আল মাসুদ প্রথম আলোকে বলেন, সিটি করপোরেশন থেকে যখন ওই সড়কের কাজ করা হয়, তখন ওয়াসাকে তাদের কাজ করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু ওয়াসা তা করতে পারেনি। প্রকল্পের কাজ হয়ে যাওয়ার পর ওয়াসা এখন কাজ করছে।

সড়ক খননের কারণে মানুষের যে ভোগান্তি হয়, সেটা দেখার দায়িত্ব কেউই নেয় না। ঠিকাদার থেকে শুরু করে সংস্থাগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা—প্রত্যেককে দায়িত্ব পালনে বাধ্য করার ব্যবস্থা চালু করতে হবে। যে বা যারা করবে না, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে সরকারের উদ্যোগ নিতে হবে।
 —আদিল মুহাম্মদ খান, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি

মাসের পর মাস দুর্ভোগ  

গতকাল সোমবার মোহাম্মদপুর, মিরপুর, বড়বাগ, পশ্চিম কাজীপাড়া, পীরেরবাগ, পশ্চিম আগারগাঁও, মণিপুর ঘুরে দেখা যায়, এসব এলাকার ছোট-বড় সড়ক ও অলিগলিতে খনন করছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। কোনো কোনো সড়ক চার–পাঁচ মাস আগে কাটাকাটি করা হয়েছে; যা এখনো মেরামত করা হয়নি।

 এসব সড়কে হেঁটে চলতেও কষ্ট হচ্ছে পথচারীদের। কোথাও খনন করা অংশ নিয়ম মেনে ভরাট করে চলাচলের উপযোগী করা হয়নি। এতে স্থানে স্থানে দেবে গেছে, সৃষ্টি হয়েছে গর্তের। এ ছাড়া কোনো কোনো এলাকায় সড়কে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নির্মাণসামগ্রী ও খনন করে তোলা মাটি।

 এমনই এলাকার একটি মিরপুরের মধ্য মণিপুর। এলাকায় পানি সরবরাহের সংযোগ স্থাপনের জন্য সড়ক খুঁড়েছিল ওয়াসা। তবে খনন করা অংশ বালু দিয়ে ভরাট করে ইট বিছিয়ে চলাচলের উপযোগী করে দেয়নি। সড়কের খনন করা অংশ দেবে গেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা সেখানে রাবিশ (ভাঙা ইট-কংক্রিটের টুকরো) ফেলে চলাচলের ব্যবস্থা করেছেন।

উত্তর পীরেরবাগ এলাকার একটি সড়ক
ছবি: প্রথম আলো

আরেক এলাকা পশ্চিম মণিপুরের মোল্লাপাড়া। সেখানে নালা নির্মাণ করেছিল সিটি করপোরেশন। নালা নির্মাণে খনন করা সড়ক ভরাট করা হলেও সেই অবস্থায় প্রায় তিন মাস ফেলে রাখা হয়েছে। পিচঢালাই না হওয়ায় নালার স্ল্যাবগুলো সড়ক থেকে উঁচু হয়ে রয়েছে। সড়কটিতে এখন শুধু হেঁটে চলা যায়।

 মোল্লাপাড়ার বাসিন্দা রোকনুজ্জামান খান বলেন, তিন মাসের বেশি সড়কটি এ অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে। কবে পিচঢালাই দেওয়া হবে, কেউ জানেন না। এই সড়কে রিকশাও চলতে পারে না। বয়স্ক ও শিশুদের কষ্ট করে হেঁটে চলতে হয়।

একই রকম অবস্থা দক্ষিণ মণিপুরের মোল্লাপাড়ার।

আরও পড়ুন

 সংস্থাগুলোর কাজে সমন্বয়হীনতা  

নীতিমালা মেনে নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে প্রকল্পের কাজ না করার অভিযোগ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে নতুন নয়। ফলে সড়কে খোঁড়াখুঁড়িতে জনসাধারণকে দুর্ভোগ পোহানো এক সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে।

 বর্তমানে ঢাকা উত্তর সিটির বেশ কিছু এলাকায় সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি করছে ঢাকা ওয়াসা। সংস্থাটির ‘ঢাকা পানি সরবরাহ নেটওয়ার্ক উন্নয়ন প্রকল্প’-এর কাজ প্রায় শেষ দিকে রয়েছে। যদিও ৩ হাজার ৯৮০ কোটি টাকার প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২১ সালের ডিসেম্বরে।

 প্রকল্পের পরিচালক মো. ওয়াজ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ঠিকাদার নিয়োগের পর সিটি করপোরেশনের অনুমতি চাওয়া হলে চাহিদা মোতাবেক অনুমতি পাওয়া যায় না। এ ছাড়া কোনো একটি সড়কে কাজ করার অনুমতি না দিয়ে ঠিক ওই সড়কেই মেরামতের কাজ করে সিটি করপোরেশন। পরে সড়ক নতুনভাবে মেরামত করা হয়েছে এই অজুহাত দেখিয়ে খননের অনুমতি দেওয়া হয় না। এমন জটিলতায় সঠিক সময়ে কাজ করা যায় না।

 সিটি করপোরেশন থেকে অন্য সংস্থাগুলোকে নিজেদের পরিকল্পনার বিষয়ে জানানো হয় না বলেও অভিযোগ করেন এই কর্মকর্তা।

 সার্বিক বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, নীতিমালার শর্তগুলো কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ে মানা হয় না। কারণ, খননকাজগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় হয়; যেগুলো সমন্বয় করতে দেরি হয়। তবে (প্রকল্পের কাজ শেষ করতে) যতটা সম্ভব কঠোরভাবে সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হচ্ছে, না মানলে জরিমানাও করা হচ্ছে।

গুলশান-বাড্ডা লিংক রোড
ছবি: প্রথম আলো

 দায়িত্ব পালনে বাধ্য করতে হবে  

নগরবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘কোনো আইন তখনই মানুষের কাজে লাগে, যখন আইন মানানোর জন্য একটি সিস্টেম কাজ করে। কিন্তু সিস্টেমই এত দিন অকার্যকর ছিল।’

 আদিল মুহাম্মদ খান আরও বলেন, ‘সড়ক খননের কারণে মানুষের যে ভোগান্তি হয়, সেটা দেখার দায়িত্ব কেউই নেয় না। ঠিকাদার থেকে শুরু করে সংস্থাগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা—প্রত্যেককে দায়িত্ব পালনে বাধ্য করার ব্যবস্থা চালু করতে হবে। যে বা যারা করবে না, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে সরকারের উদ্যোগ নিতে হবে।’

আরও পড়ুন