৩৬০ বছরের পুরোনো মসজিদটি এখন যেমন

পুরান ঢাকার নারিন্দায় ‘হায়াত ব্যাপারী মসজিদ’ প্রতিষ্ঠিত হয় ৩৬০ বছর আগে। শুরুতে এক গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটি ছিল আয়তাকার। এর স্থাপনাশৈলী ছিল ঢাকার প্রথম মসজিদ বলে পরিচিত বিনত বিবি মসজিদের মতোই।

নারিন্দার ৭১ হৃষিকেশ দাস লেনের ঐতিহাসিক হায়াত আলি ব্যাপারী মসজিদ। ঢাকা, ২৬ মার্চছবি: প্রথম আলো

খুব সাধারণ সাদামাটা গড়ন মসজিদটির। মিনারও নেই। অনেক বহুতল বাড়ি উঠেছে তিন দিকে। কেবল পশ্চিম দিকটি খোলা। ফলে সামনে এসে না দাঁড়ালে মসজিদটি চোখে পড়ে না। তবে ঢাকার ইতিহাসে নাম আছে নারিন্দার ৭১ হৃষীকেশ দাস লেনের মসজিদটির। নাম ‘হায়াত ব্যাপারী মসজিদ’। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৬৬৪ সালে।

পুরান ঢাকার নারিন্দা এলাকায় মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান—তিন ধর্মের মানুষেরই প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ঢাকার প্রথম মসজিদ হিসেবে পরিচিত নারিন্দার ‘বিনত বিবির মসজিদ’ এখানেই প্রতিষ্ঠিত হয় ১৪৫৬ সালে। ঢাকায় খ্রিষ্টানদের অন্যতম পুরোনো উপাসনালয় ‘চার্চ অব দ্য অ্যাসাম্পশন’ গড়ে ওঠে ১৬২৮ সালে। এ ছাড়া এখানে বলধা গার্ডেনের অদূরেই গড়ে উঠেছে খ্রিষ্টানদের সমাধিক্ষেত্র। খ্রিষ্টান সমাধিক্ষেত্রের অদূরে একই সড়কে হিন্দু সম্প্রদায়ের ‘শ্রীশ্রী গৌড়ীয় মাধব মঠ’।

জাতীয় তথ্য বাতায়নের ঢাকা জেলার তথ্যানুসারে ১৯২১ সালে এ মঠের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শ্রী সিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী। ফলে খুবই কাছাকাছি থাকা এই তিন ঐতিহাসিক স্থাপনা নারিন্দা এলাকার সর্বধর্ম সম্প্রীতির অনন্য নিদর্শন হয়ে আছে।

নারিন্দা এলাকাটি ছিল মোগল রাজধানী ঢাকার পূর্ব দিকের সর্বশেষ সীমান্ত। পর্তুগিজ মিশনারি ও পরিব্রাজক সেবাস্তিয়ান মানরিক ১৬৪০ সালে ঢাকা ভ্রমণ করেন। ভ্রমণ বিবরণীতে ঢাকার যে বিবরণ দিয়েছেন, তা ঐতিহাসিক ও ঢাকা নিয়ে কৌতূহলীদের কাছে তথ্যের আকর হিসেবে উল্লেখযোগ্য। মানরিক নারিন্দার ক্যাথলিক চার্চটি পরিদর্শন করেছিলেন এবং নারিন্দা, মনেশ্বর ও ফুলবাড়িয়া এলাকার বিশেষ বলে উল্লেখ করেছিলেন তাঁর বিবরণে।

নারিন্দায় বিনত বিবির মসজিদটি মোগল আমলের আগের। আর মোগল আমলের স্থাপনা ‘হায়াত ব্যাপারী মসজিদ’। নারিন্দায় আরও একটি ‘ব্যাপারী মসজিদ’ আছে।

মূল মসজিদটি ছিল খুবই ছোট। সব মিলিয়ে দেড় কাঠার মতো জায়গায় একতলা মসজিদটিতে দুই শর মতো মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারতেন। জায়গা কম থাকায় সম্প্রসারণ করাও যাচ্ছিল না। এমন অবস্থায় মসজিদের পাশের বাসিন্দা ব্যবসায়ী আবদুল গাফফার (প্রয়াত) এক কাঠা জায়গা ছেড়ে দেন।

হায়াত ব্যাপারী মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা ব্যবসায়ী হায়াত ব্যাপারী সম্পর্কে ঢাকার ইতিহাস বিষয়ের বইগুলোতে বিশেষ বর্ণনা নেই। বলা হয়েছে, তিনি এ এলাকার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ছিলেন। অধ্যাপক ড. হাসান দানী তাঁর ‘কালের সাক্ষী: ঢাকা’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, হায়াত ব্যাপারী এক গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। মসজিদটি ছিল আয়তাকার। এর স্থাপনাশৈলী ছিল বিনত বিবি মসজিদের মতোই।

৩৬০ বছরের পুরোনো মসজিদটি ছাড়াও একই সময় ধোলাই খালের ওপর একটি ইটের সেতুও তৈরি করেছিলেন হায়াত ব্যাপারী। একক খিলানবিশিষ্ট এই সেতুর নির্মাণকাল ১০৭৪ হিজরি মোতাবেক ১৬৬৪ খ্রিষ্টাব্দ। সেতুটির খিলান বহুকাল আগেই ভেঙে গিয়েছিল। দানি বলেছেন, সেখানে খিলানের পরিবর্তে ‘লোহার গ্রাইডার’ নির্মাণ করা হয়েছিল। এখন তো ধোলাই খালই নিশ্চিহ্ন, সেতু থাকার প্রশ্নই আসে না।

টাইলস ও ওপরের অংশে সাদা টাইলস বসানো। মেঝেতে মার্বেল কুচির মোজাইক। প্রধান মেহরাবটির দুই পাশে দুটি কাঠের দরজার দেয়াল আলমারি। বাড়তি কোনো কারুকাজ নেই।

হায়াত ব্যাপারীর আদি স্থাপনা দুটির কোনোটিই এখন নেই। মসজিদটি ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত টিকে ছিল। মঙ্গলবার দুপুরে পবিত্র জোহর নামাজের পর হায়াত ব্যাপারী মসজিদে কথা হলো মসজিদের খতিব হাফেজ মাওলানা মো. আবুল কাশেম, মসজিদ পরিচালনা কমিটির কোষাধ্যক্ষ আখতারুল আলম, প্রবীণ মুসল্লি আবদুর রহিমসহ বেশ কয়েকজনের সঙ্গে। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মূল মসজিদটি ছিল খুবই ছোট। সব মিলিয়ে দেড় কাঠার মতো জায়গায় একতলা মসজিদটিতে দুই শর মতো মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারতেন। জায়গা কম থাকায় সম্প্রসারণ করাও যাচ্ছিল না। এমন অবস্থায় মসজিদের পাশের বাসিন্দা ব্যবসায়ী আবদুল গাফফার (প্রয়াত) এক কাঠা জায়গা ছেড়ে দেন। এরপর প্রায় আড়াই কাঠা জায়গায় ধীরে ধীরে চারতলা ভবনটি নির্মাণ করা হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের দানেই মসজিদটি নির্মিত হচ্ছে।

মসজিদটির চারতলা পর্যন্ত নির্মাণ শেষ। নিচের তলায় চারপাশের দেয়ালে, মেঝে থেকে দেয়ালের প্রায় এক–তৃতীয়াংশ কাঠের টেক্সচার দেওয়া টাইলস ও ওপরের অংশে সাদা টাইলস বসানো। মেঝেতে মার্বেল কুচির মোজাইক। প্রধান মেহরাবটির দুই পাশে দুটি কাঠের দরজার দেয়াল আলমারি। বাড়তি কোনো কারুকাজ নেই। এখন এই মসজিদে প্রায় ৮০০ মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন।

কোষাধ্যক্ষ আখতারুল আলম জানান, মসজিদের মিনার তৈরি শুরু হয়নি। জায়গা আছে। আর্থিক সামর্থ্য হলেই মিনার তৈরির কাজ করা হবে। নিচের তলায় সড়কসংলগ্ন সামনের কিছু অংশে চারটি দোকান। দোকানভাড়া আর দানবাক্সে মুসল্লিদের দানেই প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদের পরিচালন ব্যয় চলছে।

নারিন্দা রোডের জরিপ ব্যাপারী মসজিদ
ছবি: প্রথম আলো

জরিপ ব্যাপারী মসজিদ

নারিন্দার অপর ব্যাপারী মসজিদটির নাম ‘জরিপ ব্যাপারী মসজিদ’। এটি পাঁচতলা। শ্বেতপাথরের ফলক লাগানো লম্বা মিনারটি বহুদূর থেকে দেখা যায়। গতকাল মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক জানান, স্থানীয় ব্যবসায়ী আবদুল কাদের এ মসজিদের জমিদাতা। তাঁর বাবা জরিপ ব্যাপারীর নামে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে। এ মসজিদ অন্য দুই মসজিদের মতো পুরোনো নয়। মুক্তিযুদ্ধের কিছু আগে এটি নির্মিত হয়েছে, তবে তিনি সঠিক সময় বলতে পারেননি।

পবিত্র রমজান মাসে পবিত্র জুমার নামাজ ছাড়াও প্রতি ওয়াক্তের জামাতেই মসজিদগুলোতে প্রচুর মুসল্লির সমাগম হয়। এ ছাড়া পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা আর পুণ্য লাভের জন্য অনেকেই মসজিদে এসে নফল নামাজ, জিকির বা কোরআন তিলাওয়াতে মগ্ন থাকেন।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন