পুলিশ লাইনের জন্য জলাধারের অংশ অধিগ্রহণে ঢাকা জেলা প্রশাসন

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কাটাসুর মৌজার এই জলাধারের অংশবিশেষ অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চালাচ্ছে ঢাকা জেলা প্রশাসনছবি: প্রথম আলো

স্পেশাল সিকিউরিটি অ্যান্ড প্রোটেকশন ব্যাটালিয়নের (এসপিবিএন) পুলিশ লাইন নির্মাণের লক্ষ্যে জলাধারের অংশ অধিগ্রহণ করতে চায় সরকার। এ নিয়ে আপত্তি উচ্চ আদালতে গড়িয়েছে। আদালত তিন মাসের স্থগিতাদেশসহ রুল দিয়েছেন।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কাটাসুর মৌজায় জলাধারটির অবস্থান। অধিগ্রহণ প্রস্তাবে জলাধারের একাংশকে ‘বোর’, অন্য অংশকে ‘ডোবা’ উল্লেখ করা হয়েছে। ভূমি জরিপকারীরা বলছেন, ‘বোর’ বলতে বোরো চাষের নিচু জমিকে বোঝানো হয়।

গত শতকের মাঝামাঝির ভূমি জরিপ ডিভিশনের সার্ভেতে (আরএস) জায়গাটি জলাধার হিসেবে চিহ্নিত করা আছে। জলাধার, জলাশয় বা পানি ধারণ এলাকা রক্ষায় দেশে কমপক্ষে তিনটি আইন আছে। জাতীয় অপরিহার্য স্বার্থে জলাশয়-জলাধার ভরাট করতে হলে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রের প্রয়োজন হয়। অধিগ্রহণের প্রস্তাবের সময় একটি অনাপত্তিপত্র নিলেও এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত পুলিশের পক্ষ থেকে অবস্থানগত ছাড়পত্রের জন্য কোনো আবেদন করা হয়নি।

‘মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সব পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০’ অনুযায়ী, খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান ও প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। এমন জায়গা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার করা যাবে না। এ ধরনের জায়গা ভাড়া, ইজারা বা অন্য কোনোভাবে হস্তান্তর করা যাবে না।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ৬ (ঙ) ধারায় বলা হয়েছে, জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গা ভরাট বা অন্য কোনোভাবে শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। তবে অপরিহার্য জাতীয় স্বার্থে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র গ্রহণক্রমে এই বিধিনিষেধ শিথিল করা যেতে পারে।

ভূমি অধিগ্রহণ প্রায় শেষ পর্যায়ে। উচ্চ আদালত থেকে এখানে দুটি দাগে অধিগ্রহণে স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়েছে। সেটা নিষ্পত্তি হলে আমরা পুরো জায়গাটি পুলিশকে হস্তান্তর করব।
লিটুস লরেন্স চিরান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, ঢাকা

এসপিবিএন বাংলাদেশ পুলিশের একটি বিশেষায়িত ইউনিট। এই ইউনিট দেশের প্রধানমন্ত্রী-রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা-সুরক্ষা দেয়। তাঁদের বাসভবনসহ কার্যালয়ের নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকে। ভিআইপি হিসেবে সরকার মনোনীত দেশি-বিদেশি ব্যক্তির নিরাপত্তা-সুরক্ষা দেয় তারা।

আরও পড়ুন

এসপিবিএনের পুলিশ লাইন প্রকল্প বাস্তবায়নে মোহাম্মদপুরের কাটাসুর মৌজার ২৫টি দাগে ৪ দশমিক ২২ একর ভূমি অধিগ্রহণ হচ্ছে। খতিয়ান অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট জলাধারটির আয়তন সাড়ে ৩ একর। জলাধারের দেড় একরের মতো জায়গা অধিগ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ জন্য স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইন ২০১৭ অনুযায়ী ২০২২ সালের অক্টোবরে নোটিশ জারি করে ঢাকা জেলা প্রশাসন।

জানতে চাইলে ঢাকা জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক লিটুস লরেন্স চিরান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভূমি অধিগ্রহণ প্রায় শেষ পর্যায়ে। উচ্চ আদালত থেকে এখানে দুটি দাগে অধিগ্রহণে স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়েছে। সেটা নিষ্পত্তি হলে আমরা পুরো জায়গাটি পুলিশকে হস্তান্তর করব।’

অধিগ্রহণ প্রস্তাবে জলাধার কীভাবে বোর জমি হয়ে গেল, জানতে চাইলে লিটুস লরেন্স বলেন, ‘রেকর্ডীয় শ্রেণি হিসেবে এটি বোর আছে। আমরা যখন অধিগ্রহণ করি, তখন বাস্তবভিত্তিক শ্রেণি পরিবর্তনের বিষয়ে একটা নির্দেশনা দেওয়া থাকে।’

এ ক্ষেত্রে ‘বাস্তবভিত্তিক শ্রেণি পরিবর্তন’ হয়েছে কি না, জানতে চাইলে লিটুস লরেন্স বলেন, ‘এটা যেহেতু আগের বিষয়। আমাকে ফাইল দেখে বলতে হবে।’

রাজধানীর মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে বসিলামুখী সড়ক ধরে এগিয়ে গেলে র‍্যাব-২-এর কার্যালয়ের একটু আগেই অধিগ্রহণের জন্য প্রস্তাবিত জায়গাটির অবস্থান।

আরও পড়ুন

গত শনিবার সরেজমিনে দেখা যায়, জায়গাটির চারদিকে নিরাপত্তাদেয়াল। দেয়ালঘেঁষে কিছুটা এগিয়ে গেলে ডানে একটি গলি। গলির শেষপ্রান্তে জলাধার। জলাধারে বাঁশের খুঁটি দেওয়া। চাষ হচ্ছে মাছ।

স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, জলাধারের কিছু অংশ এর মধ্যে ভরাট করে শেড নির্মাণ করা হয়েছে। তাঁরা শুনেছেন, এখানে পুলিশ লাইন হবে। এ জন্য জলাধারের একাংশ ভরাট করা হবে।

জমি অধিগ্রহণের লক্ষ্যে নিয়ম অনুযায়ী আগেই পরিবেশ অধিদপ্তরের অনাপত্তিপত্র নেয় পুলিশ। ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বরে পরিবেশ অধিদপ্তরের দেয়া সেই অনাপত্তিপত্রে বলা হয়, কোনো অবস্থায় প্রাকৃতিক জলাধার (আরএস দাগ নম্বর ৮০৫ ও ৮১০) ভরাট করা যাবে না। প্রকল্প এলাকায় বিদ্যমান প্রাকৃতিক জলাধার যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। এ বিষয়ে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুসরণ করতে হবে। তার লঙ্ঘন প্রমাণিত হলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

আরও পড়ুন

জলাধার রক্ষায় স্থানীয় বাসিন্দা রোকেয়া বেগম গত ৯ সেপ্টেম্বর উচ্চ আদালতে রিট আবেদন করেন। তাঁর আইনজীবী ইশিত মনজুল সোহিনী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আরএস দাগ নম্বর ৮০৫ ও ৮১০ স্পষ্টভাবে জলাধার হিসেবে চিহ্নিত। কিন্তু তা গোপন করে অধিগ্রহণ নোটিশে একে দেখানো হয়েছে বোর জমি হিসেবে। আমরা এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপ চেয়েছি।’

যেভাবে জলাধারকে বোর জমি বানিয়ে অধিগ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া হলো, সেটা একটা অপরাধ। সারা দেশে নদী-নালা, খাল-বিলের ক্ষেত্রে এমনটা করা হচ্ছে।
আখতার মাহমুদ, অধ্যাপক, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

উচ্চ আদালত জলাধার অধিগ্রহণের ওপর তিন মাসের স্থগিতাদেশ দিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন আইনজীবী ইশিত মনজুল সোহিনী। তিনি বলেন, একই সঙ্গে জলাধারের অংশকে এই অধিগ্রহণের আওতাভুক্ত করা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানাতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।

আরও পড়ুন

নগর পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) ২০২৪ সালের এক গবেষণায় বলা হয়, তিন দশক আগে ঢাকার মোট আয়তনের ২০ শতাংশের বেশি এলাকায় জলাভূমি ছিল। কমতে কমতে জলাভূমির পরিমাণ ৩ শতাংশের নিচে নেমেছে। অর্থাৎ তিন দশকে ঢাকায় জলাভূমি কমেছে ১৭ শতাংশ।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আখতার মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, যেভাবে জলাধারকে বোর জমি বানিয়ে অধিগ্রহণের প্রস্তাব দেওয়া হলো, সেটা একটা অপরাধ। সারা দেশে নদী-নালা, খাল-বিলের ক্ষেত্রে এমনটা করা হচ্ছে।

ঢাকা শহরের বসবাসযোগ্যতা একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে বলে উল্লেখ করেন নগর পরিকল্পনাবিদ আখতার মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘ঢাকায় জলাবদ্ধতা হয়। জলাবদ্ধতার প্রকোপ কমাতে জলাশয়-জলাধার-ঝিল দরকার। নগর প্রতিবেশের জন্য এগুলো থাকা অপরিহার্য। এখন এগুলো ভরাট করে আমরা যদি অন্য কাজে ব্যবহার করি, তাহলে এ শহরের বসবাসযোগ্যতা থাকবে না। এখনো অবশ্য তা নেই। ভবিষ্যতে যে এই বসবাসযোগ্যতা গড়ে উঠবে, তার সম্ভাবনাও আমরা ধ্বংস করে ফেলছি।’