তেলাপোকা মারার ওষুধ: ঘরে ঢুকেই তীব্র ঝাঁজালো গন্ধ পেয়েছিলেন তাঁরা

বাবার সঙ্গে দুই ভাই শাহির মোবারত (৯) ও শায়ান মোবারত (১৫); এই দুই ভাই এখন শুধুই স্মৃতি
ছবি: সংগৃহীত

নতুন ফ্ল্যাট কিনে সপ্তাহ দুয়েক আগেই তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ওই বাসায় উঠেছিলেন মোবারক হোসেন ও শারমিন জাহান দম্পতি। নতুন ভবন হলেও সেখানে ছিল তেলাপোকার উৎপাত। স্কুলপড়ুয়া ছেলেরা তেলাপোকা ভয় পেত। সে কারণে ডাকা হয়েছিল পোকামাকড় নিধন প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের। কিন্তু তাঁদের কাজ শেষে বাসায় ফিরে আর বসবাস করা হলো না পরিবারটির দুই ছেলের। গত রোববার এক দিনেই শায়ান মোবারত (১৫) ও শাহির মোবারত (৯) মারা যায়।

আজ মঙ্গলবার সকালে ওই বাসায় গিয়ে দেখা যায়, ক্ষণে ক্ষণে ছেলেদের নাম ধরে ডাকাডাকি করে হাহাকার করছিলেন মা শারমিন জাহান। মাঝেমধ্যেই তিনি ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছিলেন। বড় ছেলে সকালের নাশতার অর্ডার (অ্যাপের মাধ্যমে) দিয়েছে কি না, জানতে চাইছিলেন তিনি। বারবার তিনি বলছিলেন, তাঁর ছেলেরা কত লক্ষ্মী, কত সুন্দর! ২৮ জুন শাহির ১০ বছরে পা দেবে। ছেলে প্রতিদিন গুনত, কবে জন্মদিন আসবে! মায়ের পাশে শোকাহত বাবা মোবারক হোসেন পাথরের মতো বসে ছিলেন।

রোববার ভোরে অসুস্থ হয়ে পড়লে শায়ান ও শাহিরকে এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। সেখানকার চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, বিষক্রিয়ায় দুই ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে। বিষের উৎস হিসেবে পরিবার ধারণা করছে, তেলাপোকা মারার ওষুধ।

আরও পড়ুন

শায়ান–শাহিরদের বাসাটি দোতলায়। ওই বাসায় গত শুক্রবার বেলা ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত তেলাপোকা মারার ওষুধ দেন ডিসিএস অর্গানাইজেনশন লিমিটেড নামের বারিধারার একটি প্রতিষ্ঠানের দুই কর্মী। সে সময় শিশুদের বাবা মোবারক হোসেনও মাস্ক পরে তাঁদের সঙ্গে ছিলেন।

মোবারক হোসেন আজ জানান, ঘরে তেলাপোকা নিধনের কাজ করা হবে বলে স্ত্রী, দুই ছেলে ও মেয়েকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা এসে ঘরের কোনায় কোনায় টিস্যুর মধ্যে একটি ট্যাবলেট দিয়েছিল। তাঁরা বলেছিলেন, তিন ঘণ্টা পরে ঘরে প্রবেশ করা যাবে। আর ১০ ঘণ্টা পর ট্যাবলেটগুলো ফেলে দিতে বলেছিলেন।

রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এই ফ্ল্যাটে তেলাপোকা মারার ওষুধ দেওয়ার এক দিন পর অসুস্থ হয়ে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে
ছবি: প্রথম আলো

বাসায় ওষুধ দেওয়া শেষে ঘর তালাবন্ধ করে বের হন মোবারক হোসেন। আগের বাসার এলাকা উত্তরায় বন্ধুদের আড্ডায় যান তিনি। আর তাঁর স্ত্রী-সন্তানেরাও উত্তরায় একটি দাওয়াতে যান। তাঁরা একসঙ্গে গাড়িতে করে বাসায় ফেরেন ভোর চারটায়। অর্থাৎ পোকামাকড় নিধনকর্মীরা চলে যাওয়ার প্রায় ১০ ঘণ্টা পর। ঘরে ঢুকেই তীব্র ঝাঁজালো গন্ধ পেয়েছিলেন বলে জানান মোবারক হোসেন।

মোবারক হোসেন বলেন, ঘরে ফেরার দুই–তিন ঘণ্টা পর স্ত্রী ও তিন সন্তান বমি করে। তাঁরা ভেবেছিলেন, এই গরমে দাওয়াতে ভারী খাবার খাওয়ার জন্য এমন হতে পারে। তখন ঘরের জানালাগুলো খুলে দেন। তেলাপোকা মারার জন্য যেসব জায়গায় ট্যাবলেটগুলো রাখা হয়েছিল, সেগুলো সংগ্রহ করে ফেলে দেন।

পরদিন শনিবার সারা দিন সবাই স্যালাইন, ফলের রসসহ তরল খাবার খান। রাতে তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর কক্ষে দুই ছেলে বাবার সঙ্গে ঘুমায়। মা ছিলেন মেয়ের সঙ্গে আরেক কক্ষে। বড় ছেলে শায়ান ভোরে (রোববার) তাঁদের ডেকে বলছিল, ছোট ভাই যেন কেমন করছে। ছেলের অবস্থা দেখে মোবারক হোসেন দ্রুত ছেলেকে কোলে নিয়ে গাড়িতে ওঠেন। সঙ্গে স্ত্রী, বড় ছেলে ও মেয়েও ছিল। বাসা থেকে অল্প দূরত্বে এভারকেয়ার হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যান। তখন চিকিৎসকেরা জানান, হাসপাতালে আনার আগেই শাহিরের মৃত্যু হয়েছে। বড় ছেলে গাড়ি পার্ক করে জরুরি বিভাগে গিয়ে শোনে ছোট ভাই বেঁচে নেই।

মোবারক হোসেন বলেন, ‘ভাইয়ের মৃত্যুর কথা শুনে জাহিন (বড় ছেলে) বলে ওঠে, “দি ইজ নট ফেয়ার, বাবা (এটা ঠিক হয়নি না বাবা)।” অভিমান হলে ছেলে এমন বলে। মনে হচ্ছিল যেন ভাইয়ের চলে যাওয়ায় সৃষ্টিকর্তার ওপর ওর অভিমান হয়েছে। এর পরপরই ও অসুস্থ হয়ে যায়। হাসপাতালে জায়ানের (শাহির) দেহে বিষক্রিয়ার কথা বলেছিলেন চিকিৎসকেরা। পরে তাঁরা জাহিনের (শায়ান) দেহেও বিষক্রিয়ার উপস্থিতি পেয়ে আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) ভর্তি করে নেন।’

বাসায় উপস্থিত শিশুদের খালা রওশন জাহান বলেন, রোববার রাতে শাহিরকে বনানী কবরস্থানে দাফন করার সময় হাসপাতাল থেকে ফোন আসে শায়ানের অবস্থা সংকটাপন্ন। রাত ১০টার দিকে সে–ও মারা যায়। দুটো ছেলেই মা-বাবার বাধ্য, খুব ভদ্র ও শান্ত প্রকৃতির ছিল।

কীভাবে এই শোক কাটাবেন মা

শায়ান ও শাহির উত্তরার ইংরেজি মাধ্যম ডিপিএস এসটিএস স্কুলে তৃতীয় ও অষ্টম শ্রেণিতে পড়ত। জুলাই মাসে তাদের চতুর্থ ও নবম শ্রেণিতে ওঠার কথা ছিল। বোন শাহরিন মোবারত (জাইমা) একই স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী।

আজ বাসায় গিয়ে শাহিরের কক্ষটিতে ঢুকলেই বোঝা যায়, এখানে কোনো ছেলেশিশু থাকে। ছোট-বড় খেলনা গাড়ি দিয়ে ভর্তি চারপাশ। পড়ার টেবিল ও আলমারি দেয়ালের সঙ্গে লাগিয়ে (বিল্টইন) তৈরি করা। মাঝে একটি বিছানা। ওই কক্ষের বাঁ পাশের কক্ষটিতে তার কিশোর ভাই শায়ান থাকত। দুটি কক্ষই এখন শূন্য। দুই ভাই যখন স্কুলে থাকত, তখনো এমন শূন্য পড়ে থাকত ঘর। তবে এবারের শূন্যতা অসীম। তারা আর কখনো ফিরছে না। পাশাপাশি দুই কক্ষের বাসিন্দা দুই ভাই এখন রাজধানীর বনানী কবরস্থানে শায়িত।

শিশুদের মা শারমিন ঘোরের মধ্যেই বলে যাচ্ছিলেন, তাঁর ছেলেরা তেলাপোকা খুব ভয় পেত। নতুন বাসা হলেও দুই ছেলের কক্ষেই তেলাপোকা ছিল। ওরা ভয়ে রাতে নিজেদের কক্ষে থাকতে চাইত না। এ কারণে তেলাপোকা মারতে পোকামাকড় নিধন প্রতিষ্ঠানকে ডেকেছিলেন। কেন তাদের ডেকেছিলেন, তা নিয়ে আফসোস করছেন এখন।

শারমিন জাহান বলেন, শুক্রবার রাতে দাওয়াত ছিল। কিন্তু পোকামাকড় নিধনের কাজের কারণে তাঁরা আগে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। বাবা ছেলেমেয়েদের সব আবদার মেটাতেন। কিন্তু তিনি ছেলেমেয়েদের কেনাকাটা নিয়ন্ত্রণ করতেন। তবে সেদিন তিনিও তাদের আবদার মিটিয়েছিলেন। তাঁরা একসঙ্গে কেনাকাটা করেছেন। তাঁর ‘বেবি জান’ (শাহির) একটি খেলনা গাড়ি ও চেইনে ঝুলে থাকা ছোট ভালুকছানা কিনেছিল। কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, এই খেলনাগুলোই তাঁর ছেলের শেষ আবদার, শেষ কেনাকাটা।

শিশুদের নানি শামসুন্নাহার আহাজারি করে বলেন, তাঁর মেয়ে (শিশুদের মা) কেমন করে বাঁচবেন! কীভাবে তিনি এই শোক কাটিয়ে উঠবেন!  

ওষুধটি কতটা বিপজ্জনক

শিশুদের বাবা টিস্যুতে রাখা ট্যাবলেটের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা শুনে সেটিকে অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট বলে ধারণা করছেন গাজীপুরের বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কীটতত্ত্ব বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন প্রধান। তিনি আজ প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের ট্যাবলেট খাদ্যগুদামে পোকামাকড় নিধনে ব্যবহার করা হয়। এক টন খাদ্যের বিপরীতে ৫–৭টি ট্যাবলেট কাপড়ে বা টিস্যুতে মুড়িয়ে ব্যবহার করা হয়। এখন যে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা, তাতে গুদামে ট্যাবলেট ব্যবহারের পর অন্তত তিন দিন পর্যন্ত মানুষ বা কোনো প্রাণীর প্রবেশ করা নিষেধ। ট্যাবলেটগুলো পরে ফেলে দেওয়ার সময় নাক–মুখ ও কান ঢেকে, চোখে গ্লাস পরে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে হয়।

দেলোয়ার হোসেন বলেন, ট্যাবলেট থেকে বের হওয়া গ্যাস নাক, কান ও চোখের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করে বিষক্রিয়া ঘটাতে পারে। এটা অত্যন্ত বিষাক্ত বলে বাসায় ব্যবহার একেবারেই নিষিদ্ধ। যদি শিশুদের বাড়িতে ব্যবহার করা ট্যাবলেট অ্যানুমিনিয়াম ফসফাইড হয়ে থাকে, তবে তা ব্যবহার করা আইনবিরুদ্ধ হয়েছে। তেলাপোকা মারতে তিনি বাজারে সাধারণভাবে বিক্রি হওয়া চক, জেল ও স্প্রে ব্যবহারের পরামর্শ দেন।

আরও পড়ুন

শিশুদের মৃত্যুর ঘটনায় পোকামাকড় নিধন প্রতিষ্ঠান ও কর্মীদের বিরুদ্ধে গতকাল সোমবার বিকেলে ভাটারা থানায় মামলা করেছেন শিশুদের বাবা। ভাটারা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ বি এম আসাদুজ্জামান আজ প্রথম আলোকে বলেন, অবহেলাজনিত কারণ দেখিয়ে মামলা করা হয়েছে। টিটু মোল্লা নামের প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি পোকামাকড় নিধনে ওই বাড়িতে কাজ করা দুজনের একজন।

অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ট্যাবলেট ব্যবহারের কারণে শিশুদের বিষক্রিয়া হয়েছিল কি না, জানতে চাইলে ওসি আসাদুজ্জামান বলেন, ছোট ছেলেটিকে ময়নাতদন্ত ছাড়া দাফন করা হয়েছে। বড় ছেলের ময়নাতদন্ত হয়েছে। সেই প্রতিবেদন হাতে আসার পর বোঝা যাবে কী কারণে বিষক্রিয়া হয়েছে। গ্রেপ্তার টিটু মোল্লা ওই ট্যাবলেট ব্যবহারের বিষয়টি বলেছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, রিমান্ডে আনার পর এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। আদালত আজ তাঁর দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন।

এদিকে পোকামাকড় নিধন প্রতিষ্ঠান ডিসিএস অর্গানাইশজেশন লিমিটেডের ওয়েবসাইটে দেওয়া মুঠোফোন নম্বরে ফোন করলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। তবে প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরহাদুল আমীন গতকাল একটি গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, সব নিয়ম মেনেই ওই বাড়িতে কীটনাশক দেওয়া হয়েছে। মেডিকেল প্রতিবেদন পাওয়ার পর শিশুদের মৃত্যু কীভাবে হয়েছে, জানা যাবে।

বেলা সাড়ে ১১টার দিকে শিশুদের বাসা থেকে বের হওয়ার সময় সেখানে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন–পিবিআইয়ের (ঢাকা মহানগর দক্ষিণ) একটি দল প্রবেশ করে। সেখানে থাকা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তেলাপোকা মারতে বাসার ভেতরে কী রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়েছে, তা পরীক্ষা করে দেখবেন। বাসার সবকিছু ধোয়ামোছা করা হয়েছে, সে ক্ষেত্রে তাঁরা কোনো রাসায়নিক পাবেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, দেখা যাক, কী পাওয়া যায়।