টাকা দিয়ে দোকানে টিকার নিবন্ধন

রাজধানীর কম্পিউটার সেবা দেওয়ার কোনো কোনো দোকানে অনলাইনে টিকা নিবন্ধন করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নেওয়া হচ্ছে ৫০ থেকে ১০০ টাকা।

করোনার টিকা নিচ্ছেন খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা লাভলী দাশ। গতকাল দুপুরে রাজধানীর মিরপুর লালকুঠির মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে
ছবি: আশরাফুল আলম

রাজধানীর শ্যামলী সিনেমা হল মার্কেটের নিচতলার দেয়ালে একটি কাগজে লেখা, ‘করোনার টিকা কার্ডের জন্য এই দিকে’। গতকাল রোববার সকালে নির্দেশনা অনুযায়ী সেদিকে যাওয়ার পর পাওয়া গেল একটি বড় স্টেশনারি দোকান, যেখানে ছয়টি কম্পিউটারে কাজ করেন দোকানের কর্মীরা। এই দোকানে ৫০ টাকার বিনিময়ে সরকারের সুরক্ষা ওয়েবসাইটে করোনাভাইরাসের টিকার নিবন্ধন করিয়ে দেওয়া হয়।

রাজধানীতে যাঁরা টিকা নিতে আগ্রহী, কিন্তু ইন্টারনেট সুবিধা নেই বা ব্যবহারে দক্ষ নন, তাঁদের ফি বা মাশুলের বিনিময়ে নিবন্ধন করিয়ে দিচ্ছে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সেবাদাতা দোকানগুলো। এ ক্ষেত্রে গ্রাহকের কাছ থেকে নেওয়া হয় ৫০ থেকে ১০০ টাকা। কেউ কেউ কমও নেন।

সরকার দেশের ৪০ বছরের বেশি বয়সী নাগরিক ও অগ্রাধিকার তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের টিকা নিতে নিবন্ধনের সুযোগ দিচ্ছে। তবে নিবন্ধন করতে হয় অনলাইনে, সরকারের সুরক্ষা ওয়েবসাইটে গিয়ে। কয়েক দিন টিকাকেন্দ্রে গিয়ে তাৎক্ষণিক নিবন্ধনের সুযোগ ছিল, যা গত বৃহস্পতিবার থেকে বন্ধ রয়েছে। ফলে এখন অনলাইন ছাড়া বিকল্প নেই। এ ছাড়া বয়স্কদের ও নিম্ন আয়ের মানুষের অনেকের ইন্টারনেট সুবিধা ও দক্ষতা নেই।

রাজধানীর কলেজ গেট ও শ্যামলী এলাকায় বেশ কয়েকটি সরকারি হাসপাতালে করোনার টিকাদানকেন্দ্র আছে। এসব কেন্দ্রে টিকা নিতে এই এলাকা ও আশপাশের স্টেশনারি দোকানগুলো থেকে অনলাইনে নিবন্ধন করে নিচ্ছেন সাধারণ মানুষেরা। শ্যামলী সিনেমা হল মার্কেটের অন্তত ১০টি কম্পিউটারের দোকান থেকে অনলাইনে নিবন্ধন করে করোনার টিকা কার্ড দেওয়া হচ্ছে।

দোকানিরা জানালেন, করোনার টিকা নিবন্ধন কার্যক্রমের শুরু থেকেই তাঁরা মানুষকে অনলাইনে নিবন্ধন করিয়ে দিচ্ছেন। তবে সুরক্ষা ওয়েবসাইটটির সার্ভার ডাউন হয়ে গেলে প্রায়ই তাঁরা নিবন্ধন করতে সমস্যায় পড়ছেন। তখন নিবন্ধন বন্ধ থাকে। আবার অনেক সময় সুরক্ষা ওয়েবসাইটে জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর নিতে চায় না। সবকিছু ঠিক থাকলে নিবন্ধন করে টিকা কার্ড নিতে মিনিট পাঁচেক সময় লাগে।

এই মার্কেটের স্টেশনারির দোকান এম এ ইন্টারন্যাশনালের কর্মচারী শাবিব নূর প্রথম আলোকে জানান, দৈনিক ৫০ থেকে ৬০ জন গ্রাহক পাওয়া যায়, যাঁরা টিকার জন্য নিবন্ধন করতে যান।

ঢাকার নীলক্ষেতে কম্পিউটার সেবাদানকারী দোকানগুলোতেও করোনার টিকার জন্য নিবন্ধন করিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। ওই এলাকার ২১টি দোকানে গিয়ে কথা বলে জানা যায়, সেখানে টিকা নিবন্ধনের জন্য মানুষ খুব একটা যাচ্ছে না। পাঁচটি দোকানের কর্মীরা জানান, তাঁরা দিনে দু-একজন টিকা নিবন্ধনের গ্রাহক পান। এদিকে দক্ষিণ বনশ্রীর জামান কম্পিউটার নামের একটি দোকানে দেখা যায়, তারা ১০ টাকা করে নিয়ে নিবন্ধন করিয়ে দিচ্ছে।

আদাবরের বাসিন্দা ৫০ বছর বয়সী খোরশেদ আলম দোকান থেকে নিবন্ধন করিয়েছেন। তাঁর স্মার্টফোন আছে, তবে প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানা ছিল না। গত বুধবার ৮০ টাকা দিয়ে টিকা কার্ড সংগ্রহ করে পরদিন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ কেন্দ্র থেকে তিনি টিকা নেন। পেশায় গাড়িচালক এই ব্যক্তি বলেন, ‘প্রথমে শুনেছিলাম হাসপাতালেই নিবন্ধন হবে। পরে শুনলাম বন্ধ। এরপর কম্পিউটারের দোকানে গিয়ে টিকা কার্ড করে ফেললাম।’

ঢাকায় গতকাল ৪০ বছরের বেশি বয়সী নানা পেশার ১৪ জন মানুষের সঙ্গে কথা হলে প্রত্যেকেই বলেন, তাঁরা টিকা নিতে আগ্রহী। তবে ১২ জনেরই ইন্টারনেট সুবিধা ও স্মার্টফোন নেই। ১৩ জন জানান, অনলাইনে করোনার টিকা নিবন্ধন করার বিষয়ে তাঁদের ধারণা নেই। তাঁরা এই বিষয়গুলো বোঝেন না।

তেমনই একজন ৫৮ বছর বয়সী আবদুল মতিন। পেশায় তিনি মোহাম্মদপুরের খিলজী সড়কের একটি ভবনের নিরাপত্তাকর্মী। তাঁর পরিবারে সদস্যসংখ্যা সাতজন। আবদুল মতিন বলেন, ‘আমি তো অনলাইনের কিছুই বুঝি না। ফোনও নাই। করোনা টিকা নিবন্ধন করার কোনো জায়গা থাকলে সুবিধা হইত।’

এদিকে তাৎক্ষণিক নিবন্ধন সুবিধা বন্ধ হওয়ার পরও অনেকে হাসপাতালের টিকাদানকেন্দ্রে নিবন্ধন করতে যাচ্ছেন। মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক অসীম কুমার নাথ বলেন, মানুষজন জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে নিবন্ধনের জন্য হাসপাতালে আসছে। তবে আমরা এখন তাৎক্ষণিক নিবন্ধন বন্ধ রেখেছি। কারণ হলো, তাৎক্ষণিক নিবন্ধন নিতে আসা ব্যক্তিদের সেবা দিতে গেলে আগে থেকে অনলাইনে নিবন্ধন করা ব্যক্তিদের টিকাদান ব্যাহত হয়।

মুগদা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, গতকাল পর্যন্ত সেখানে টিকা নেওয়ার জন্য ২০ হাজার মানুষ নিবন্ধন করেছেন। ফলে হাসপাতালের টিকার কোটা শেষ হয়ে গেছে। বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আবেদন জানানো হয়েছে।

সারা দেশে করোনাভাইরাসের টিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়েছে ৭ ফেব্রুয়ারি। প্রথম দিকে টিকাদান নিয়ে মানুষের আগ্রহ কম থাকলেও ধীরে ধীরে তা বাড়ছে। তবে টিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ।

নিউমার্কেট এলাকায় সড়কের পাশে ভ্যানে করে ডাব বিক্রি করছিলেন মো. আনোয়ার (৪১)। তিনি বলেন, বিনা মূল্য টিকা দেওয়া হচ্ছে বলে তিনি শুনেছেন। কিন্তু টিকা নেওয়ার জন্য অনলাইনে নিবন্ধন করার মতো জ্ঞান নেই তাঁর। সহজ উপায়ে টিকা না দিলে তিনি তা নেবেন না।