মামুন হত্যার পেছনে কি অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ, শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনের নাম আসছে যে কারণে

নিহত শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাঈফ মামুন ও শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমনছবি: সংগৃহীত

২০২৩ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রাত ১০টা। তখন ঢাকার তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের সিটি পেট্রলপাম্প ও বিজি প্রেসের মাঝামাঝি এলাকার মূল সড়কে ছিল তীব্র যানজট। ওই যানজটে তখন আটকে ছিলেন শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাঈফ মামুন। প্রকাশ্যে ১০–১২ জনের একটি দল মামুনের ওপর হামলা চালায়। প্রথমে মামুনের গাড়ি লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করা হয়। একপর্যায়ে মামুন গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। তখন তাঁকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করা হয়। মামুন তখন প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন। তবে তাঁকে লক্ষ্য করে ছোড়া গুলিতে ভুবন চন্দ্র শীল নামে একজন মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হন।

এ ঘটনার প্রায় দুই বছর দুই মাস পর আজ সোমবার সকাল ১০টার দিকে আবারও ঢাকার রাস্তায় প্রকাশ্যে মামুনকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। এবার আর তিনি প্রাণে বাঁচতে পারেননি। গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। আজকের ঘটনাটি ঘটেছে পুরান ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের সামনে। সেখানে দুজন মাস্ক পরা ব্যক্তি খুব কাছ থেকে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। মামুন ২৪ বছর কারাভোগের পর জামিনে মুক্ত হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই ২০২৩ সালে ওই হামলার শিকার হয়েছিলেন।

প্রায় দুই যুগ কারাবাস শেষে মুক্ত হওয়ার পর মামুনকে হত্যায় কারা, কেন এত মরিয়া হয়ে উঠলেন, সেই প্রশ্ন সামনে এসেছে। প্রথমবার হামলার ঘটনার সঙ্গে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমনের নাম এসেছিল। যদিও তখন ইমন কারাগারে ছিলেন। পরের বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে ছাত্র–জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরপরই ইমন কারাগার থেকে মুক্ত হন। বর্তমানে তিনি কোথায় আছেন, সে বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায়নি।

২০২৩ সালে মামুনের ওপর হামলার ঘটনার তদন্তের সঙ্গে যুক্ত এক পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সে সময় কারাগারে থাকলেও ওই ঘটনার নেপথ্যে ছিলেন শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন। একসময় ইমন ও মামুন ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে ঢাকার হাজারীবাগ, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর ও তেজগাঁও এলাকার অপরাধজগতের অন্যতম নিয়ন্ত্রক ছিলেন ইমন ও মামুন। তাঁদের গড়ে তোলা বাহিনীর নাম ছিল ‘ইমন-মামুন’ বাহিনী। ওই সময় এই বাহিনী রাজধানীর এসব এলাকায় ব্যাপক আতঙ্ক তৈরি করেছিল। তাঁরা দুজনই চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী ও সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ভাই সাঈদ আহমেদ টিপু হত্যা মামলার আসামি। ২০২৩ সালে কারাগার থেকে বের হওয়ার পর বিভিন্ন এলাকায় একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন মামুন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে কারাগার থেকেই মামুনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন ইমন।

আরও পড়ুন
সিসিটিভির ফুটেজে দেখা যায়, তারিক সাইফ মামুন দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করছেন (বাঁয়ে)। দুই ব্যক্তি খুব কাছে থেকে তাঁকে গুলি করছেন (ডানে)
ছবি: সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে নেওয়া

পুলিশের এই কর্মকর্তার ধারণা, আজকে মামুনকে হত্যার নেপথ্যে ইমনের ভূমিকা থাকতে পারে। কারণ হিসেবে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলছেন, ৫ আগস্টের পর ইমন কারামুক্ত হন। তারপর ধানমন্ডি, কলাবাগান, হাজারীবাগ, মোহাম্মদপুর ও আশপাশের এলাকায় ইমন একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। এর আগেও মামুন কারামুক্ত হয়ে অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্ব থেকে মামুনকে হত্যার পরিকল্পনা করতে পারেন ইমন।

মামুনের স্ত্রী বিলকিস আক্তারও একই সন্দেহ করছেন। তিনি আজ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর স্বামীকে হত্যার পেছনে ইমনের হাত থাকতে পারে। এর আগেও মামুনকে হত্যার চেষ্টা করেছিলেন ইমন। এ কারণে এই হত্যার পেছনে ইমন থাকতে পারেন বলে তাঁর ধারণা।

আরও পড়ুন

মামুনকে যেখানে হত্যা করা হয়, সেই স্থান পুলিশের লালবাগ বিভাগের আওতাধীন কোতোয়ালি থানার মধ্যে পড়েছে। পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মল্লিক আহসান উদ্দিন সামী প্রথম আলোকে বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসী মামুনকে হত্যায় সরাসরি জড়িত দুজন শুটারকে চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। তাঁদের চিহ্নিত করতে প্রযুক্তির সহায়তা নেওয়া হচ্ছে।

আরও পড়ুন
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিহত তারিক সাঈফ মামুনের স্বজনের আহাজারি
ছবি: প্রথম আলো

ঢাকার পশ্চিমাঞ্চল ছেড়ে পূর্বাঞ্চলে বাসা নিয়েছিলেন মামুন

ঢাকার পশ্চিমাঞ্চল বিশেষ করে ধানমন্ডি, কলাবাগান, হাজারীবাগ ও মোহাম্মদপুর অঞ্চলে আধিপত্য ছিল ইমন ও মামুনের। তবে ২০২৩ সালে হামলার শিকার হয়ে প্রাণে বেঁচে যাওয়ার পর মামুন বাড্ডার আফতাবনগর এলাকায় বাসা ভাড়া নেন। এই অঞ্চলের অপরাধজগতে ইমন ও তাঁর সহযোগীদের তেমন প্রভাব নেই।

মামুনের পারিবারিক সূত্র জানায়, মামুন বাসা থেকে খুব বেশি বাইরে যেতেন না। তবে মামলার হাজিরা দিতে তিনি পুরান ঢাকার আদালতে যেতেন। মামুন কবে আদালতে হাজিরা দিতে যান, সেটি ইমন জানেন। কারণ, নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে হত্যাসহ নানা অপরাধে তাঁরা একসঙ্গেই জড়িয়েছিলেন। এ কারণে ওই সময় যেসব খুনের মামলায় ইমন আসামি ছিলেন, একই মামলায় আসামি ছিলেন মামুনও। ফলে মামুন ও ইমনের আদালতে হাজিরার তারিখ একই দিনে পড়ে। হয়তো এ কারণেই মামুনকে হত্যার জন্য পুরান ঢাকাকেই বেছে নেওয়া হয়।

আদালতসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ১৯৯৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে মোহাম্মদপুর পিসি কালচার হাউজিং এলাকায় জাহিদ আমিন ওরফে হিমেল নামের ২৫ বছরের এক যুবককে গুলি করে হত্যার মামলায় আজ সকাল সাড়ে ১০টার পর আদালতে হাজিরা দেন মামুন। এই মামলায় অভিযোগপত্রভুক্ত অপর পাঁচ আসামির একজন সানজিদুল ইসলাম ইমন। হাজিরা দিয়ে বেলা পৌনে ১১টার দিকে আদালত থেকে বের হওয়ার পর হামলার শিকার হন মামুন।

৫ আগস্টের পর ইমনের আধিপত্য

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মোহাম্মদপুর, বছিলা ও হাজারীবাগ এলাকায় পেশাদার অপরাধীদের তৎপরতা ব্যাপক বেড়ে যায়। খুনাখুনির পাশাপাশি দেশি অস্ত্র ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্য মহড়া, প্রতিষ্ঠান দখলে গুলি, হামলাসহ একের পর এক সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটতে থাকে। বেপরোয়া চাঁদাবাজি শুরু করে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। ওই এলাকায় নানা অপরাধের ঘটনা সামনে আসতে থাকে।

এমন একটি ঘটনার উদাহরণ হচ্ছে, গত ১০ জানুয়ারি রাতে এলিফ্যান্ট রোডের বিপণিবিতান মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের সামনে ব্যবসায়ী এহতেশামুল হককে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে জখম করা হয়। এ ঘটনার নেপথ্যে শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনের নাম আসে। পরে এ ঘটনায় আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলালের ভাই ও এলিফ্যান্ট রোড কম্পিউটার কল্যাণ সমিতির সভাপতি ওয়াহিদুল হাসান নিউমার্কেট থানায় মামলা করেন।

মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, হাজারীবাগ, এলিফ্যান্ট রোডসহ আশপাশের এলাকার অপরাধজগতে পিচ্চি হেলালের অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী ইমন। ওই মামলার পর ইমনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত অনেকেই একের পর এক গ্রেপ্তার হন। জিগাতলা থেকে গ্রেপ্তার হন ইমনের ‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’ হিসেবে পরিচিত শীর্ষ সন্ত্রাসী এজাজ বিন আলম। ওই সময় ইমন গা ঢাকা দেন। কেউ বলছেন, ইমন দেশে আছেন, আবার কেউ বলছেন, ইমন বিদেশে পালিয়ে গেছেন।

আরও পড়ুন