অপরাধীকে পালানোর সুযোগ দিয়ে রাস্তা থেকে ধরে আনা ব্যক্তি হন আসামি

প্রতীকী ছবি

ফেনসিডিলবাহী গাড়ির চালককে পালানোর সুযোগ দিয়ে রাস্তা থেকে এক ব্যক্তিকে ধরে এনে করা হয়েছে মাদক মামলার আসামি। মামলার তদন্তও সঠিকভাবে করা হয়নি। অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় আসামিকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছে।

১৫ মে পটুয়াখালীর অতিরিক্ত দায়রা জজ এ কে এম এনামুল করিমের আদালত ছয় বছর আগে করা এক মাদক মামলার রায়ে এমন পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন।

আদালত রায়ে বলেন, র‍্যাবের মতো এলিট ফোর্সের সদস্যরা প্রকৃত আসামিকে ধরতে না পেরে রাস্তা থেকে একজনকে ধরে এনে উদ্ধার করা ফেনসিডিলসহ গ্রেপ্তার দেখানোর ঘটনা প্রতিষ্ঠানের (র‍্যাব ফোর্সেস) সুনামের পরিবর্তে সমালোচনার সৃষ্টি করেছে। এটি মোটেও কাম্য নয়।

আদালত রায়ে বলেন, র‍্যাবের মতো এলিট ফোর্সের সদস্যরা প্রকৃত আসামিকে ধরতে না পেরে রাস্তা থেকে একজনকে ধরে এনে উদ্ধার করা ফেনসিডিলসহ গ্রেপ্তার দেখানোর ঘটনা প্রতিষ্ঠানের (র‍্যাব ফোর্সেস) সুনামের পরিবর্তে সমালোচনার সৃষ্টি করেছে। এটি মোটেও কাম্য নয়।

আবার তদন্ত কর্মকর্তার বিষয়ে আদালত বলেছেন, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে তদন্তে অবহেলা করেছেন। অন্যায় লাভের আশায় জব্দ হওয়া গাড়ির মালিক ও চালককে আড়াল করে অভিযোগপত্র দিয়েছেন। ফলে মাদকের এত বড় চালানের পেছনে যে রাঘববোয়াল জড়িত ছিল, সে অধরাই রয়ে গেছে।

মূল অপরাধীকে না ধরে অন্য একজনকে মাদক মামলার আসামি করার এই ঘটনা পটুয়াখালীর দুমকি থানা এলাকার। ঘটনার নেপথ্যে ছিলেন র‍্যাব-৮–এর পটুয়াখালী ক্যাম্পের তৎকালীন উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) মনছুর আলম। মামলার বাদী তিনি। আর তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন দুমকি থানার তৎকালীন পরিদর্শক (তদন্ত) মো. গোলাম মোস্তফা।

মামলায় যাঁকে ফাঁসানো হয়েছে, তিনি সাইফুল ইসলাম ওরফে রাসেল। পটুয়াখালীর লেবুখালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) তৎকালীন চেয়ারম্যান শাহ আলম আকনের ভাতিজা তিনি।

এদিকে এমন কাণ্ডে মনছুর আলমসহ র‍্যাবের সংশ্লিষ্ট টহল দলের সাত সদস্যকে জবাবদিহির আওতায় আনার প্রয়োজন বলে মনে করেন আদালত। এ ছাড়া তদন্ত কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছেন আদালত।

মাদকে জড়িতদের বাঁচানো, আবার নিরীহ অনেককে ফাঁসানোর অনেক অভিযোগ বিভিন্ন সময় শোনা যায়। তবে এবার আদালতের পর্যবেক্ষণেই উঠে এল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো কোনো কর্মকর্তা অবৈধভাবে লাভের আশায় এ ধরনের কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন। এ পর্যবেক্ষণ আমলে নিয়ে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে নজির স্থাপন করা উচিত।
মুহাম্মদ উমর ফারুক, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক

এজাহারের তথ্যে গরমিল ও আদালতের পর্যবেক্ষণ

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালের ৭ জুলাই দুমকির পাগলার মোড় ইউনিভার্সিটি স্কয়ার এলাকায় পাকা রাস্তার ওপর তল্লাশিচৌকিতে দায়িত্ব পালন করছিলেন র‍্যাবের সাত সদস্য। ভোর পাঁচটার দিকে সাদা রঙের একটি গাড়ি লেবুখালী ফেরিঘাটের দিক থেকে পটুয়াখালীর দিকে যাচ্ছিল। থামার সংকেত দিলে র‍্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে অজ্ঞাতনামা চালক গাড়ি রেখে পালিয়ে যান। পালানোর সময় সাইফুল ইসলামকে আটক করা হয়। গাড়ি থেকে ৭০০ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয়।

আদালত মামলার বাদী ডিএডি মনছুর আলমের বক্তব্য পর্যালোচনা করে বলেছেন, তিনি চালককে পালাতে দেখেছেন। তবে চালককে ধাওয়া করে ধরতে পারেননি—এমন কোনো কথা এজাহার বা সাক্ষ্য দেওয়ার সময়  বলেননি। এমনকি তাঁর সঙ্গে থাকা টহল দলের সদস্যরাও সাক্ষ্য দেওয়ার সময় এমন কোনো কথা বলেননি। চালককে ধরতে পিছু ধাওয়া না করায় বোঝা যায়, চালককে পালিয়ে যেতে সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

আদালত আরও বলেন, গ্রেপ্তারের সময় ধস্তাধস্তিতে সাইফুল ইসলামের সামান্য আহত হওয়ার কথা মনছুর আলম আদালতে বলেছেন। সাইফুলকে পটুয়াখালী সদর হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার কথাও মনছুর আলম জানিয়েছেন। তবে টহল দলে থাকা র‍্যাবের তিন সদস্য আসামি আহত হওয়ার তথ্য দেননি। আদালত মনে করেন, সাইফুল আহত হলে টহল দলের সদস্যরা পরস্পরকে সমর্থন করে সাক্ষ্য দিতেন। এমনকি আসামি সামান্য আহত হলে কেন তাঁকে ঘটনাস্থলের কাছে দুমকি হাসপাতালে চিকিৎসা না করিয়ে পটুয়াখালীতে নেওয়া হয়েছে, সেটি বোধগম্য নয়। তা ছাড়া প্রত্যক্ষদর্শী একজন সাক্ষী বলেছেন, সাইফুলকে দুমকির দিক থেকে ধরে নিয়ে আসতে দেখেছেন তিনি।

আরও পড়ুন

আসামিকে গ্রেপ্তারের সময় নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন আদালত। এজাহারে গ্রেপ্তারের সময় ভোর পাঁচটা উল্লেখ করা হলেও র‍্যাব সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে সংবাদ পেয়ে তল্লাশিচৌকি বসিয়ে সাইফুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আদালত মনে করেন, প্রেস ব্রিফিংয়ের বক্তব্য অনুযায়ী সকাল সাড়ে ছয়টায় সংবাদ পেলে গ্রেপ্তারের সময় অবশ্যই সাড়ে ছয়টার পর হওয়ার কথা।

মূল অপরাধীকে না ধরে অন্য একজনকে মাদক মামলার আসামি করার এই ঘটনা পটুয়াখালীর দুমকি থানা এলাকার। ঘটনার নেপথ্যে ছিলেন র‍্যাব-৮-এর পটুয়াখালী ক্যাম্পের তৎকালীন উপসহকারী পরিচালক মনছুর আলম। আর তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন দুমকি থানার তৎকালীন পরিদর্শক মো. গোলাম মোস্তফা।

মামলার বাদী তৎকালীন র‍্যাব কর্মকর্তা মনছুর আলম এখন আনসার ব্যাটালিয়ন ১৬–এর সহকারী পরিচালক হিসেবে কর্মরত। আদালতের পর্যবেক্ষণের বিষয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘রায়ের কপি আমি পাইনি। পেলে আইনগত দিক দেখে বলতে পারব।’ তিনি বলেন, ‘এভাবে করার তো (ফাঁসানো) সুযোগ নেই। র‍্যাব তো এলিট ফোর্স। এখানে একজন সিও (অধিনায়ক) আছেন, কোম্পানি কমান্ডার আছেন। এখানে তো সবাই সংশ্লিষ্ট। এখানে একা, নিম্নস্তরের, অধস্তন কর্মচারীদের করার কিছু নেই। এখানে সবকিছু দেখে–শুনে চেইন অব কমান্ডে (আদেশের ক্রম) সব কাজ চলে। ওভাবে কিছু করার সুযোগ নেই।’

আরও পড়ুন

মাদক কারবারিদের আড়াল করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা

আদালত বলেছেন, তদন্ত কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফার সাক্ষ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি আসামিকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। জব্দ হওয়া গাড়ির মালিকানা সঠিকভাবে যাচাই করেননি তিনি। ওই গাড়ির নম্বরপ্লেট পরিবর্তন করে মাদক পাচার করা হচ্ছিল। তদন্ত কর্মকর্তা বিআরটিএ চট্টগ্রাম সার্কেল-১ থেকে জানতে পেরেছেন গাড়ির চেসিস ও ইঞ্জিন নম্বরের কোনো মিল নেই। এ কারণে তিনি মালিকানা যাচাই করতে পারেননি।

তবে নথি পর্যালোচনা করে আদালত দেখেছেন, ওই গাড়ির প্রকৃত নম্বর আলাদা। গাড়িটি ঢাকার মিরপুর বিআরটিএ থেকে নিবন্ধন করা হয়েছে। সেখানে খোঁজ নিয়ে মালিককে খুঁজে বের করা হলে চালক সম্পর্কেও জানা যেত। তদন্ত কর্মকর্তা তদন্তের ক্ষেত্রে নিদারুণ অবহেলা করে মূল আসামিকে আড়াল করেছেন।

জব্দ তালিকায় তিন বস্তা ফেনসিডিল উদ্ধারের কথা বলা হলেও কোন বস্তায় কত বোতল ছিল, সেটি উল্লেখ করা হয়নি। অভিযোগপত্রেও এ বিষয়ে তথ্য নেই। কত লিটার তরল জব্দ করা হয়, সেটিও এজাহার বা অভিযোগপত্রে নেই। খসড়া মানচিত্রে উল্লেখ করা বাড়িঘর ও দোকানের মালিকদের কাউকেই সাক্ষী করা হয়নি।

তদন্ত কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা এখন বাকেরগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) হিসেবে কর্মরত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘রায় না দেখে তো কিছু বলা যায় না। আর আদালত আমাদের সর্বোচ্চ সম্মানের জায়গা। রায় দেখি।’

অন্যায় লাভের আশায় গাড়িমালিক ও চালককে শনাক্ত না করেই অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে—আদালতের এ বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মামলার এজাহারনামীয় আসামি ছিলেন একজন। আরেকজন অজ্ঞাতনামা চালক। বিআরটিএতে ওই গাড়ির চেসিস নম্বরের কোনো তথ্য নেই। এখন নথি না দেখে বিষয়টি বিস্তারিত বলতে পারব না।’

আরও পড়ুন

শত্রুপক্ষের প্রভাবে সাইফুলকে আসামি: আইনজীবী

মামলার বিচার চলাকালে যুক্তিতর্কের সময় আসামির আইনজীবী মিজানুর রহমান বলেছেন, সাইফুল ইসলামের কাছ থেকে কোনো মাদক উদ্ধার করা হয়নি। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সঠিকভাবে তদন্ত করেননি। আসামির শত্রুপক্ষের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে এই মামলায় সাইফুলকে জড়ানো হয়েছে।

আইনজীবী আরও বলেছেন, সাইফুল স্থানীয় ইউপির তৎকালীন চেয়ারম্যান শাহ আলম আকনের ভাতিজা। তাঁকে দুমকি যাওয়ার রাস্তা থেকে ধরা হয়। র‍্যাব কার্যালয়ে নিয়ে নির্যাতনের পর প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। ঘটনার ১৩ ঘণ্টা পর এজাহার দায়ের করে সাইফুলকে আসামি করা হয়।

পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, আসামি তৎকালীন লেবুখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের ভাতিজা কি না, সেটি তদন্তে উঠে আসেনি। তদন্ত কর্মকর্তা বিষয়টি জানেন না বলেও জেরার সময় উল্লেখ করেছেন।

আরও পড়ুন

র‍্যাব ও পুলিশের ভাষ্য

র‍্যাবের তৎকালীন ডিএডিসহ টহল দলের সাত সদস্যকে জবাবদিহির আওতায় আনতে আদালতের রায়ের বিষয়ে জানতে এ বাহিনীর আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার আরাফাত ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদালত যদি এমন রায় দিয়ে থাকেন, সেটা মানা হবে।’

তদন্ত কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে আদালতের নির্দেশ দেওয়া প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র ও সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) ইনামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদালতের যেকোনো পর্যবেক্ষণই পুলিশের পক্ষ থেকে মানা হয়।’

আরও পড়ুন

বিশেষজ্ঞের মতামত

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাদকে জড়িতদের বাঁচানো, আবার নিরীহ অনেককে ফাঁসানোর অনেক অভিযোগ বিভিন্ন সময় শোনা যায়। তবে এবার আদালতের পর্যবেক্ষণেই উঠে এল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো কোনো কর্মকর্তা অবৈধভাবে লাভের আশায় এ ধরনের কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন। এ পর্যবেক্ষণ আমলে নিয়ে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে নজির স্থাপন করা উচিত।’