চাঁদাবাজি ও ক্যাসিনো থেকে ক্যাসিনো সাঈদের যত আয়

‘ক্যাসিনো’ সাঈদ
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠন যুবলীগের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পদ ব্যবহার করে সংঘবদ্ধ চাঁদাবাজি ও ক্যাসিনো (জুয়া) থেকে এ কে এম মমিনুল হক সাঈদ অবৈধভাবে আয় করেছেন ২৫ কোটি টাকা। তাঁর বিরুদ্ধে করা মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের একটি মামলায় এমন তথ্য উল্লেখ করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।

‘ক্যাসিনো সাঈদ’ নামে পরিচিত মমিনুল হক সাঈদ ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মোট তিনটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) একটি মামলায় আদালতে দেওয়া অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেছে, সিঙ্গাপুর, ওমান ও মালয়েশিয়ায় ৭৮ লাখ টাকা পাচার করেছেন তিনি। তবে দুদক তাঁর অবৈধ আয়ের পরিমাণ উল্লেখ করেছে সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা। অবশ্য দুদকও তাঁর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছে অভিযোগপত্রে।

আরও পড়ুন

দুদকের দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়, ওমানে ক্যাসিনো সাঈদের দুটি ব্যাংক হিসাব রয়েছে। ২০১৯ সালের ২৬ নভেম্বর থেকে ২০২০ সালের ২১ এপ্রিল পর্যন্ত ওই দুটি ব্যাংক হিসাবে ৩৪ লাখ টাকা জমা হওয়ার তথ্য পেয়ছে দুদক। এমনকি ওমানে ‘আনোয়ার আল খালিজ আল আমেরা’ নামের একটি কোম্পানির অংশীদার তিনি। কোম্পানিটি মাসকটের চারটি স্থানে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। 

ক্যাসিনো সাঈদের বিরুদ্ধে সিআইডি মামলা করেছে দুটি, দুদক করেছে একটি। এর মধ্যে দুদক তদন্ত শেষে গত বছরের ১৭ এপ্রিল আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে। আর সিইআইডি একটি মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছে। ২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর আদালতে দেওয়া অভিযোগপত্রে সিআইডি ক্যাসিনো সাঈদ সম্পর্কে বলেছে, নিজের ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে (আবুল কাসেম, পরে তাঁকে মামলার আসামি করা হয়) মোহামেডান ক্লাবে ক্যাসিনোর ব্যবসা চালানোর সুযোগ করে দিয়ে সেখান থেকে প্রতিদিন পাঁচ লাখ টাকা নিতেন তিনি। এ মামলার বিচার শুরু হয়েছে।

আরও পড়ুন

আর ক্যাসিনো সাঈদের বিরুদ্ধে সিআইডির করা আরেকটি মামলায় তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। এই মামলা হয়েছিল ২০২১ সালের ৩০ মে। এই মামলায় সিআইডি বলেছে, আরামবাগের বিভিন্ন দোকান ও ফুটপাথের ১২ হাজারের বেশি দোকান ও বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে ক্যাসিনো সাঈদের লোকজন চাঁদা তুলতেন। সেই টাকা তাঁর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বৈশাখী এন্টারপ্রাইজের ব্যাংক হিসাবে জমা হতো। তিনি আরামবাগ স্পোর্টিং ক্লাবের সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর ‘ওয়ান টেন’ (একধরনের জুয়া) চালু করেন। জুয়া ও চাঁদা থেকে আসা ১৪ কোটি ৪২ লাখ ২৫ হাজার টাকা ওই ব্যাংক হিসাবে জমা করার তথ্যও পেয়েছে সিআইডি। ওই টাকা ব্যাংকে জমা দেন তাঁর ঘনিষ্ঠ ছালাউদ্দিন ও আছাদ শাহ চৌধুরী। এর মধ্যে ছালাউদ্দিন কাজ করতেন ক্যাসিনো সাঈদের ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে। আর আছাদ ছিলেন তাঁর সহযোগী। এই দুজনকেও সিআইডি মামলার অভিযোগপত্রে আসামি হিসেবে যুক্ত করেছে। আর মতিঝিলের ওয়ার্ড যুবলীগ নেতা জামাল উদ্দিনও ক্যাসিনো সাঈদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে ২ কোটি ১৬ লাখ টাকা জমা দিয়েছিলেন। জামালও ক্যাসিনো সাঈদের সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন। তাঁকে পরে আসামি করা হয়। 

আরও পড়ুন

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর সময় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদে ছিলেন মমিনুল হক সাঈদ। এর আগে ২০১৫ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের (মতিঝিল এলাকা) কাউন্সিলর নির্বাচিত হন তিনি। মূলত এর পরই তিনি মতিঝিলের ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা চালু করেন বলে পুলিশ জানিয়েছে। মতিঝিল এলাকার আরও চারটি ক্লাবের (মোহামেডান, আরামবাগ, ওয়ান্ডারার্স ও দিলকুশা) ক্যাসিনোর ব্যবসাও তাঁর নিয়ন্ত্রণে ছিল।

দীর্ঘদিন পলাতক থাকা ক্যাসিনো সাঈদ গত জানুয়ারিতে সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফেরেন। যুবলীগের একটি সূত্র বলছে, সরকারের উচ্চ মহল থেকে সবুজ সংকেত পেয়েই দেশে ফিরে আসেন ক্যাসিনো সাঈদ। গত তিন বছর তিনি দুবাই, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থান করেন। উল্লেখ্য, ক্যাসিনো-কাণ্ডে গ্রেপ্তারের আড়াই বছর পর গত বছরের আগস্ট মাসে জামিনে প্রথমে মুক্তি পান যুবলীগ থেকে বহিষ্কৃত হওয়া নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট। এরপর জামিনে মুক্ত হন তাঁর সহযোগী খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। ক্যাসিনো সাঈদ ওই দুজনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। 

পলাতক থাকায় এক দিনের জন্যও জেল খাটতে হয়নি ক্যাসিনো সাঈদকে। যদিও তাঁর ঘনিষ্ঠদের প্রায় সবাইকে কমবেশি সময় কারাগারে থাকতে হয়েছিল। 

মমিনুল হক সাঈদের আইনজীবী শাহীনুর ইসলাম প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, হয়রানির উদ্দেশ্যে তাঁর মক্কেলের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। মামলাগুলো আইনিভাবে মোকাবিলা করা হবে। 

চাঁদাবাজি ও ক্যাসিনো থেকে ক্যাসিনো সাঈদের যত আয় 

দুদক ও সিআইডির অভিযোগপত্রের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৩ সালের এপ্রিলে মমিনুল হক সাঈদ মালয়েশিয়ান ‘রিসোর্ট ওয়ার্ল্ড বার হার্ড’ ক্যাসিনোর সদস্য হন। ২০১৭ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ক্যাসিনো খেলার বিভিন্ন যন্ত্রাংশ কেনার জন্য তিনি সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় বিপুল অঙ্কের টাকা লেনদেন করেছেন এমন তথ্য পেয়েছে সিআইডি। তবে বিদেশে তিনি সব মিলিয়ে কতো টাকা পাচার করেছেন তার পূর্ণাঙ্গ তথ্য পাওয়া যায়নি। 

এ ব্যাপারে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক মাধবী রানী পাল প্রথম আলোকে বলেন, মমিনুল হক সাঈদের অর্থ পাচারের তথ্য হাতে পাওয়ার জন্য সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় চিঠি পাঠানো হয়েছে।

সিআইডি বলছে, ক্যাসিনো ব্যবসা চালুর আগে মমিনুল হক সাঈদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বৈশাখী এন্টারপ্রাইজের ব্যাংক হিসাবে তেমন কোনো লেনদেন ছিল না। তবে ২০১৮ সালের ৫ জুলাই থেকে ২০১৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ওই ব্যাংক হিসাবে ১৬ কোটি ৬১ লাখ টাকা জমা হয়। মমিনুল হক যুবলীগের রাজনৈতিক পদ ব্যবহার করে সহযোগীদের নিয়ে সংঘবদ্ধ অপরাধে জড়ান। মোহামেডান ক্লাবে ক্যাসিনো থেকে আয় করা ১২ কোটি টাকা তিনি বৈশাখী এন্টারপ্রাইজের ব্যাংক হিসাবে হস্তান্তর করেন।

দুদক ও সিআইডি অভিযোগপত্রে টাকা পাচার এবং অবৈধ আয়ের যেসব তথ্য উঠে এসেছে, সে বিষয়ে মঙ্গলবার (২১ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় টেলিফোনে প্রথম আলো কথা বলেছে মমিনুল হক সাঈদের সঙ্গে। তিনি দাবি করেন, কারও কাছ থেকে তিনি জোর করে টাকা নিয়েছেন, এমন কথা কেউ বলতে পারবে না। ঢাকায় নিজের নামে কোনো সম্পদ, বাড়ি–গাড়ি নেই বলেও দাবি করেন তিনি। 

তবে মমিনুল হক সাঈদের বিরুদ্ধে করা মানি লন্ডারিং মামলায় দুদকের দেওয়া অভিযোগপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১০–১১ সালের দিকে তাঁর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বৈশাখী এন্টারপ্রাইজের মূলধন ছিল ৬২ লাখ টাকা। আর ২০১০ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তাঁর আয়কর বিবরণীর তথ্য পর্যালোচনা করে দুদক বলেছে, মমিনুলের আয় দেখিয়েছেন মোট ১ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। তবে দুদক বলছে, তাঁর বৈধ আয় ১২ লাখ টাকার বেশি খুঁজে পাওয়া যায়নি। বাকি টাকা কীভাবে তিনি আয় করেছেন, এর সপক্ষে কোনো কাগজপত্র পাওয়া যায়নি। 

আদালতকে দুদক লিখিতভাবে বলেছে, মমিনুল হক সাঈদ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর ক্ষমতার অপব্যবহার, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে জ্ঞাত আয়ের বাইরে ৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা অস্থাবর সম্পদ অর্জন করেছেন।