প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় হরদম মাদক বেচাকেনা 

এলাকায় প্রচলিত আছে, এখানে মাদকের এমন বড় চালান আসে যে মাদক বিক্রির টাকা মেশিনে গুনতে হয়।

প্রতীকী ছবি

ঢাকার দোহার ও নবাবগঞ্জ উপজেলায় মাদকের বড় রকমের ব্যবসা চলছে। বিভিন্ন স্থানে হরদম মাদক কেনাবেচা চলছে। এলাকার তরুণেরা মাদকাসক্ত হয়ে পড়লেও এ কারবার নিয়ন্ত্রণের বাইরেই রয়েছে। মাদক ব্যবসা ঘিরে হত্যাসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চলছে নিয়মিত। গত আট বছরে খুন হয়েছেন অন্তত পাঁচজন।

 অভিযোগ আছে, স্থানীয় কিছু জনপ্রতিনিধির ছত্রচ্ছায়ায় এই মাদক ব্যবসায়ীরা বিপুল অঙ্কের মাদক কেনাবেচা করছেন। এলাকার লোকমুখে প্রচলিত আছে, এখানে মাদকের এমন বড় চালান আসে যে মাদক বিক্রির টাকা হাতে গণনা করা যায় না, মেশিনে গুনতে হয়।

নবাবগঞ্জের বালুরচর এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাসিন্দা বললেন, ‘মাদক কারবারিগো উস্তাদ নবাবগঞ্জের পিন্টুকে পুলিশ ধরছে তো কী হইছে, হের লোকজন তো আর ধরা খায় নাই। তারাই এহন মাদকের কারবার করতাছে। তাগো মাদক ব্যবসা দিন দিন অরও চাঙা হইতাসে।’

গত অক্টোবরে ওই এলাকার অন্যতম মাদক ব্যবসায়ী মো. পিন্টুকে ৩০০টি ইয়াবা বড়ি, ২০০০ পুরিয়া হেরোইনসহ গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠিয়েছে পুলিশ। 

পুলিশ জানায়, এই দুই উপজেলায় মাদক মূলত আসে পদ্মা ও ধলেশ্বরী নদী পার হয়ে ফরিদপুর, মুন্সিগঞ্জ ও মানিকগঞ্জ জেলা থেকে। দুই থানায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, প্রতি মাসে যত অপরাধের মামলা হয়, তার অধিকাংশই মাদকসংক্রান্ত।

আরও পড়ুন
মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা যথেষ্ট নয়। এতে যুবসমাজের নৈতিক অবক্ষয় ঘটছে। নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এ জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। 
আবদুল বারেক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, দোহার

নবাবগঞ্জে মাদকের অন্যতম কেন্দ্র বালুরচরের বাগানবাড়ি

সম্প্রতি নবাবগঞ্জের বালুরচর এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, বালুরচর পুকুরের কাছে একটি আমবাগানের নিচে বেশ কয়েকজন তরুণ আড্ডা দিচ্ছেন। তাঁদের কেউ কেউ গাছের ডালে বসে আছেন। আবার কেউবা উঁকি দিয়ে সড়কের এদিক–সেদিক নজরদারি করছেন। এই দুই প্রতিবেদক পুকুরের কাছে গেলে তাঁরা অনেকে গাছ থেকে নেমে এদিক–সেদিক সটকে যাওয়ার চেষ্টা করেন। জানা গেছে, এঁরা মূলত মাদক বিক্রেতাদের সতর্ককারী হিসেবে কাজ করেন।

বালুরচর এলাকাটি বেশ নির্জন। চারপাশে ফসলের মাঠ ও ফলের বাগান। লোকবসতি কম। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুকুরপাড় এলাকার একাধিক বাসিন্দা জানান, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকেরাও এই সড়ক দিয়ে সচরাচর যাতায়াত পর্যন্ত করেন না। এই সুযোগ নিয়ে প্রতিদিন সকাল–সন্ধ্যা ৮ থেকে ১০ জন তরুণ দল বেঁধে পালা করে এসে এখানে আড্ডা দেন। মাদক ক্রেতা ও সরবরাহকারীরা সাধারণত মোটরসাইকেলে করে সেখানে আসেন। পুকুরপাড় থেকে প্রায় ৩০০ গজ দূরে রয়েছে একটি সবুজ রঙের আধপাকা একতলা টিনশেডের বাড়ি। অনেকটা বাগানবাড়ির মতো। এটি এলাকায় ‘মাদকসম্রাট’ বলে পরিচিত পিন্টুর মাদকের আস্তানা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, পিন্টু গ্রেপ্তারের পর মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করছেন তাঁর সহযোগীরা। এঁদের অনেকের সঙ্গে স্থানীয় কিছু জনপ্রতিনিধি ও রাজনীতিকের যোগসাজশ রয়েছে।

নবাবগঞ্জ থানার ওসি সিরাজুল ইসলাম শেখ তাঁর কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেন, নভেম্বর মাসে থানায় ২০টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ১০টিই মাদক মামলা। পুলিশ বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে সাতজন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করেছে। তাঁদের কাছ থেকে ১৩৫টি ইয়াবা বড়ি ও সাড়ে তিন কেজি গাঁজা উদ্ধার করা হয়। তিনি বলেন, ‘মাদকের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

আরও পড়ুন

দোহারে হাত বাড়ালে মাদক

দোহারের আগলা ইউনিয়নের দক্ষিণ চৌকিঘাটা, উত্তর চৌকিঘাটা, কালুয়াহাটি, ছাতিয়া, গালিমপুর ইউনিয়নের নোয়াদ্দা গ্রামে মাদকের ব্যবসা চলছে। এ ছাড়া আলগিরচর, বলমন্তরচর, বাউলচর, আমিরপুর, টিকরপুর, মাঝিরকান্দা ও বান্দুরা এলাকায় রয়েছে মাদক বিক্রির বেশ কয়েকটি কেন্দ্র।

দোহার উপজেলায় একজন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে নেপথ্যে থেকে মাদক, সোনা চোরাচালান ও জুয়া নিয়ন্ত্রণ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এমনকি তাঁর বিরুদ্ধে ডাকাতি ও খুনের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগও রয়েছে। স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী রাজনীতিক তাঁকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন বলে অভিযোগ। এ কারণে লোকজন ভয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পায় না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আবির শিকদার (৩৫) ও রাকিব দেওয়ান (৪০) দোহারের কুসুমহাটি ইউনিয়নের মাদকের অন্যতম প্রধান ব্যবসায়ী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁদের একাধিকবার গ্রেপ্তারও করছে। জামিনে মুক্তি পেয়ে আবার তাঁরা মাদকের কারবারে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে অভিযোগ। দোহারের বিভিন্ন স্থানে তাঁদের সহকারীরা খুচরা বিক্রেতা হিসেবে সরাসরি ক্রেতাদের কাছে মাদক বিক্রি করে থাকেন। এ ছাড়া রাইপাড়া, হাতুড়িপাড়া, ইকরাশি, দোয়াইর, বিলাসপুর, মৈনটঘাট, চরলটাখোলা, মেঘুলা বাজারসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় মাদক বিক্রি হচ্ছে। 

দোহার থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আজহারুল ইসলাম বলেন, নভেম্বর মাসে থানায় ২২টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ১৫টি মাদকের মামলা। এ ছাড়া মাদকের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চলছে। কাউকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। পিন্টুর সহযোগীদের গ্রেপ্তারে বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানো হচ্ছে।

পাঁচজন খুন

মাদক বেচাকেনা ও দ্বন্দ্বের জের ধরে ২০১৪ সাল থেকে দোহার ও নবাবগঞ্জে অন্তত পাঁচজন খুন হয়েছেন। 

পুলিশ জানায়, গত ১১ আগস্ট নবাবগঞ্জে মাদক ব্যবসা নিয়ে দ্বন্দ্বে হৃদয় হোসেন (২২) নামের এক তরুণ নিহত হন। এর আগে ২০১৯ সালের ১৬ জুন সন্ধ্যায় নবাবগঞ্জ উপজেলার ফুল্লা ইউনিয়নের আটকাউনিয়া গ্রামে মাদক ব্যবসায় বাধা দেওয়ায় যুবলীগ নেতা আরিফ হোসেনকে (৩৫) কুপিয়ে হত্যা করেন মাদক ব্যবসায়ীরা। আরিফ স্থানীয় ওয়ার্ড যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। 

২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রাতে মাদক ব্যবসায় বিরোধের জের ধরে দোহার উপজেলার কুসুমহাটি ইউনিয়নের বাবুডাঙ্গী এলাকায় মিন্টু শেখ (২৩) নামের এক ব্যক্তি খুন হন। 

এর আগের বছর ২০১৬ সালের ১৮ আগস্ট দোহার উপজেলার নারিশা ইউনিয়নের রুইতা গ্রামে খুন হন মো. সেলিম (২৬)। ২০১৫ সালে নবাবগঞ্জের খানিপুর বাজারে মাদক ব্যবসায়ীদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে গুরুতর আহত হন শেখ আবদুল আজিজ (৫৫) ও তাঁর ছেলে মহিউদ্দিন মিশু। নবাবগঞ্জে মাদক সেবন ও বেচাকেনায় বাধা দেওয়ায় ২০১৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর নবাবগঞ্জের বক্তারনগর গ্রামে মাদক ব্যবসায়ীরা ইয়ারন বেগম (৩৫) নামের এক নারীকে কুপিয়ে হত্যা করেন। এ ঘটনায় তাঁর স্বামী মোতাহার হোসেন (৪৫) ও নাতনি রিয়া আক্তার (৮) আহত হয়।

মাদক ব্যবসা বেড়ে যাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে দোহারের সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আবদুল বারেক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা যথেষ্ট নয়। এতে যুবসমাজের নৈতিক অবক্ষয় ঘটছে। নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এ জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলনের প্রয়োজন রয়েছে।