যাঁর লাইসেন্স নেই, তাঁর হাতেই গাড়ি তুলে দেন সিটি করপোরেশনের চালক ইরান

২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর গুলিস্তানে সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়িচাপায় নটর ডেমের কলেজছাত্র নাঈম হাসানের মৃত্যুর পর বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন ঢাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

রাসেল খান ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) চালক ছিলেন না। তাঁর গাড়ি চালানোর লাইসেন্সও নেই। তবু তিনিই ঢাকার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি চাপা দিয়ে নটর ডেম কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী নাঈম হাসানকে মেরে ফেলেন। সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির প্রকৃত চালক ছিলেন ইরান মিয়া। নিজে গাড়ি না চালিয়ে তিনি চাবি তুলে দিয়েছিলেন ডিএসসিসির আরেক পরিচ্ছন্নতাকর্মী হারুনের হাতে। ঘটনার প্রায় দেড় বছর আগে থেকে হারুন ওই গাড়ি চালিয়ে আসছিলেন। কিন্তু তাঁরও ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না। গত বছর ২৪ নভেম্বর তিনি গাড়ির চাবি তুলে দিয়েছিলেন রাসেলের কাছে। আর রাসেল সেদিন সায়েদাবাদ থেকে ময়লার গাড়ি চালিয়ে গুলিস্তানের হলমার্কেটের সামনে এসে নাঈমকে চাপা দিয়ে মেরে ফেলেন।

নটর ডেম কলেজের ছাত্র নাঈম হাসানের মৃত্যুর জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটির চালক ইরান মিয়াসহ তিনজনকে দায়ী করে ১৫ নভেম্বর ঢাকার আদালতে দেওয়া অভিযোগপত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। অভিযোগপত্রভুক্ত অপর দুই আসামি হলেন পরিচ্ছন্নতাকর্মী হারুন ও রাসেল। ইরান মিয়া ঘটনার পর থেকে পলাতক। তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও পল্টন থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আনিছুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডিএসসিসির চালক ইরান মিয়া দায়িত্বে অবহেলার পরিচয় দিয়েছেন। আইন অমান্য করে তিনি এ ঘটনার প্রায় দেড় বছর আগে হারুনকে গাড়ি চালাতে দিয়েছিলেন। পরে হারুন আবার রাসেলকে চালাতে দিয়ে অপরাধে জড়িয়েছেন। আর রাসেল তো বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে নাঈমকে মেরে ফেলেছেন। তাই নাঈমের মৃত্যুর জন্য এই তিনজনকে দায়ী করা হয়েছে।’

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির চাপায় নিহত নটর ডেম কলেজছাত্র নাঈম হাসান

তবে এ মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার বিষয়ে অবগত নন মামলার বাদী নাঈমের বাবা শাহ আল আলম দেওয়ান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছেলের মৃত্যুর পর পুলিশ কখনো আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি।’ ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে তিনি বলেন, ‘আমার নিষ্পাপ ছেলের মৃত্যুর জন্য যারাই দায়ী, সরকার যেন তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়।’

ঘাতক গাড়ির প্রকৃত চালক ইরান মিয়া এখনো গ্রেপ্তার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন শাহ আল আলম দেওয়ান। দ্রুত তাঁকে গ্রেপ্তার করে শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।

আদালতে স্বীকারোক্তিতে যা বলেছিলেন রাসেল  

পটুয়াখালীর ছেলে রাসেল গত বছরের ২৯ নভেম্বর ঢাকার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। সেখানে তিনি বলেন, ‘আমি ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কোনো কর্মী নই। তবে মাঝেমধ্যে আমি ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের গাড়ি চালাতাম। আমার কোনো ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। সেদিন হারুন আমাকে বলেছিলেন, তাঁর জ্বর। আমি যেন গাড়ি চালিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ নম্বর ওয়ার্ডের ময়লাগুলো নিয়ে আসি। পরে আমি হারুনের গাড়ি নিয়ে সায়েদাবাদ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে রওনা দিই। গুলিস্তানের বঙ্গবন্ধু স্কয়ারের গোলচত্বর থেকে দক্ষিণে যাওয়ার পথে নটর ডেম কলেজের ছাত্র ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কা খান। পরে স্থানীয় লোকজন ও পুলিশ আমাকে ধরে ফেলে।’

কার গাড়ি কে চালান?

ঢাকা দক্ষিণ সিটির পরিচ্ছন্নতাকর্মী হারুন ঢাকার আদালতে স্বীকার করেছিলেন, তিনি একজন কর্মী। ময়লা পরিচ্ছন্নতার কাজের ফাঁকে গাড়ি চালানো শিখছিলেন। তাঁর ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। তবে চালক ইরান মিয়ার কাছ থেকে গাড়ি পেয়ে ২০২০ সালের জুলাই থেকে তিনি দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি চালানো শুরু করেন।

২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর শারীরিকভাবে অসুস্থ বোধ করছিলেন জানিয়ে হারুন বলেন, ‘তখন রাসেলকে আমার গাড়ি চালাতে অনুরোধ করি। তাতে রাসেল রাজি হলে গাড়ির চাবি তাকে বুঝিয়ে দিই। পরে আমি জানতে পারি, রাসেল গুলিস্তানে দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। একজন মারা গেছেন বলে শুনেছি।’

আরও পড়ুন

পুলিশের অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ডিএসসিসির চালক ইরান মিয়া অবৈধ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার জন্য হারুনের কাছে ময়লার গাড়ির চাবি তুলে দিয়েছিলেন। দুর্ঘটনায় নাঈমের মৃত্যুর পেছনে তাঁর ভূমিকা রয়েছে।

কলেজছাত্র নাঈম সিটি করপোরেশনের চালক ইরান মিয়ার দায়িত্বহীনতার বলি হয়েছেন বলে মনে করেন নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)–এর চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইরান মিয়া গাড়ি চালানোর কোনো লাইসেন্স না থাকা সত্ত্বেও হারুনের হাতে চাবি তুলে দিলেন; অথচ ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ খোঁজ রাখল না। এটি কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষের উচিত, নাঈমের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া।’

নাঈমের মৃত্যুর এই মামলা যেন স্বল্প সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করা হয়, সে দাবি জানিয়েছেন ইলিয়াস কাঞ্চন।

আরও পড়ুন