‘বাবাকে ছাড়া কীভাবে বাঁচব, ওরা আবারও মারলে কে বাঁচাতে আসবে’

কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের মারধর থেকে ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে আহত বাবা আজ বুধবার সকালে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেনছবি: সংগৃহীত

‘কিশোর গ্যাং–এর হাত থেকে আমাকে বাঁচাতে গিয়ে বাবা মরে গেলেন। বাবাকে ছাড়া আমি বাঁচব কীভাবে। ওরা আবারও মারলে, কে আমাকে বাঁচাতে আসবে।'

এই প্রশ্ন চট্টগ্রামের একটি মাদ্রাসার ফাজিল শিক্ষার্থী আলী রেজার। কিশোর গ্যাংয়ের হাত থেকে তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে লাইফ সাপোর্টে গিয়েছিলেন চিকিৎসক বাবা। শেষ পর্যন্ত আর বাঁচেননি তিনি। আজ বুধবার সকাল ৬টা ৭ মিনিটে নগরের বেসরকারি একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান বাবা কুরবান আলী (৬০)। সকালে ছেলে আলী রেজার সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর।

একই শঙ্কা আলী রেজার মা পারভীর আক্তারের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বামীকে হারিয়েছি। এখন ছেলেকে বাঁচাব কী করে।’

 গত শুক্রবার বিকেলে আকবর শাহ থানার পশ্চিম ফিরোজ শাহ হাউজিং এলাকার জে লাইন দিয়ে যাচ্ছিলেন আলী রেজা। তখন দুজন স্কুলছাত্র তাঁর সাহায্য চায়। তাদের কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মারধর করছিলেন। তিনি ৯৯৯-এ কল দেন। পুলিশ এসে একজনকে ধরে নিয়ে যায়। পরে ওই দিন সন্ধ্যায় ইফতারি কিনতে বের হন আলী রেজা। তখন তাঁকে পেয়ে মারধর করতে থাকেন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। খবর পেয়ে সেখানে ছুটে আসেন তাঁর বাবা। একপর্যায়ে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের ইটের আঘাতে তাঁর বাবা মাথায় গুরুতর আঘাত পান। প্রথমে তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি হলে নগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

আলী রেজার ভাষ্য, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা সবাই স্থানীয় যুবলীগ নেতা গোলাম রসুল নিশানের অনুসারী। তাঁদের সঙ্গে তাঁর কোনো পূর্বশত্রুতা নেই। আলী রেজা নগরের একটি মাদ্রাসায় ফাজিলে পড়েন।

এ ঘটনায় গত শনিবার আলী রেজা বাদী হয়ে ১২ জনের নাম উল্লেখ করে আকবর শাহ থানায় মামলা করেন। মামলায় আসামি হিসেবে মো. সামির, মো. রিয়াদ, সোহেল ওরফে বগা সোহেল, মো. আকিব, মো. অপূর্ব, মো. নিশান, মো. রাজু, মো. সাগর, মো. বাবু, মো. রাজু, মো. সংগ্রাম ও মো. সাফায়েতের নাম উল্লেখ করেন। এ ছাড়া আরও পাঁচ থেকে ছয়জনকে অজ্ঞাতপরিচয় আসামি হিসেবে রাখা হয়। এলাকায় তাঁরা স্থানীয় যুবলীগ নেতা গোলাম রসুল নিশানের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।

গতকাল মঙ্গলবার পুলিশ এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। তাঁরা পুলিশের রিমান্ডে রয়েছেন।

এ ব্যাপারে আকবর শাহ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) গোলাম রাব্বানী  প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনায় জড়িত তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

পুলিশ জানায়, চট্টগ্রাম নগরে অন্তত ২০০ কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। একেক দলে রয়েছে ৫ থেকে ১৫ জন। পুলিশের হিসাবে, নগরজুড়ে এসব গ্যাংয়ের সদস্যসংখ্যা অন্তত ১ হাজার ৪০০। পুলিশ বলছে, কিশোর গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষকতা বা প্রশ্রয় দিচ্ছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৫ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরসহ ৬৪ জন ‘বড় ভাই’। গত ৬ বছরে ৫৪৮টি অপরাধের ঘটনায় কিশোর গ্যাং জড়িত বলে জানায় পুলিশ। এর মধ্যে খুনের ঘটনা ঘটেছে ৩৪টি।

চলতি বছরের শুরুতে নগর পুলিশের করা এক জরিপে উঠে আসে, নগরে তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নবম-দশম শ্রেণির ছাত্রদের অনেকে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে অভিভাবকদের অগোচরে এলাকাভিত্তিক কিশোর গ্যাংয়ের ‘বড় ভাই’দের প্ররোচনায় জড়াচ্ছে অপরাধে। শুরুতে তাঁরা হিরোইজম (বীরত্ব) দেখানোর জন্য বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন। পরে তা থেকে বের হতে পারেন না।

আরও পড়ুন

নিহত ব্যক্তির মামাতো ভাই সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘জলজ্যান্ত একজন মানুষকে দিনদুপুরে পিটিয়ে মারা হলো। এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার হওয়া উচিত।’

ময়নাতদন্তের জন্য কুরবান আলীর মরদেহ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মর্গে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ময়নাতদন্ত শেষ হওয়ার পর পূর্ব ফিরোজ শাহ এলাকায় প্রথম জানাজা এবং দ্বিতীয় জানাজা গ্রামের বাড়ি সন্দ্বীপে অনুষ্ঠিত হবে। এরপর সেখানে লাশ দাফন করা হবে।