ধর্ষণের মামলায় ডিএনএ নমুনার অর্ধেকই ‘হাফ কেস’, ঝুলে যাচ্ছে মামলা
রাজধানীর বনানী এলাকায় মাস তিনেক আগে ৯ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের ঘটনা বেশ শোরগোল ফেলেছিল। তবে ওই মামলায় এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। এরই মধ্যে দুবার হাতবদল হয়ে মামলার তদন্তভার এখন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) হাতে। পুলিশ বলেছে, ধর্ষণের ঘটনা প্রমাণে আইনি বাধ্যবাধকতা মেনে শিশুটির ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনা জমা দেওয়া হয়েছে। তবে গ্রেপ্তার না হওয়ায় আসামির ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা যায়নি।
অর্থাৎ আলোচিত এ ধর্ষণ মামলার নমুনা এখন ‘হাফ কেস’ হয়ে রয়েছে। ডিএনএ ল্যাবের ভাষায়, যেসব ধর্ষণ মামলায় শুধু ভুক্তভোগী ও ঘটনাস্থলের জিনিসপত্রের ডিএনএ নমুনা জমা দেওয়া হয়, সেগুলো ‘হাফ কেস’ বা অসম্পূর্ণ নমুনা। আর ভুক্তভোগী ও আসামি—দুজনেরই ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার জন্য জমা হলে সেগুলো বলা হয় ‘ফুল কেস’।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের নিউক্লিয়ার মেডিসিন ভবনের ১১ তলায় ঢাকার ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরি (এনএফডিপিএল)। বাকি সাতটি ল্যাবরেটরি সিলেট, বরিশাল, খুলনা, ফরিদপুর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থাপিত। এর মধ্যে শুধু ঢাকায় ডিএনএ প্রোফাইলিং হয়। বাকি ল্যাবগুলো নমুনা সংরক্ষণ করে ও প্রোফাইলিংয়ের জন্য ঢাকায় পাঠায়।
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, আটটি বিভাগীয় স্ক্রিনিং ল্যাবরেটরিতে গত বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে ২ হাজার ১৯১টি ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার জন্য জমা হয়েছে। এর মধ্যে ১ হাজার ৮৬টি ‘হাফ কেস’, আর ‘ফুল কেস’ ১ হাজার ১০৫টি। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেকসংখ্যক নমুনাই ‘হাফ কেস’।
পুলিশের মতে, ‘হাফ কেস’ ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে ধর্ষণের মামলার অভিযোগপত্র দাখিলে বিলম্ব হয়। মামলার কার্যক্রম দীর্ঘায়িত হয়। অনেক ক্ষেত্রে মামলাটি ঝুলে যায়।
সাধারণত সব আসামির ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফল না আসা পর্যন্ত মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয় না। তবে আসামিদের যদি কোনোভাবেই গ্রেপ্তার করা না যায়, সে ক্ষেত্রে ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে অভিযোগপত্র দিয়ে দেওয়া হয়।মাজহারুল ইসলাম, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ওসি
প্রোফাইলিং শুধু ঢাকায়
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রাম (চতুর্থ পর্যায়)’ প্রকল্পের আওতায় সারা দেশে আটটি বিভাগীয় ডিএনএ স্ক্রিনিং ল্যাবরেটরি রয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের নিউক্লিয়ার মেডিসিন ভবনের ১১ তলায় ঢাকার ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরি (এনএফডিপিএল)। বাকি সাতটি সিলেট, বরিশাল, খুলনা, ফরিদপুর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এর মধ্যে শুধু ঢাকায় ডিএনএ প্রোফাইলিং হয়। বাকি সাত ল্যাব নমুনা সংরক্ষণ করে ও প্রোফাইলিংয়ের জন্য ঢাকায় পাঠায়।
এর বাইরে সিআইডির ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরি রয়েছে। তবে সেখানে ‘ফুল কেস’ বা ‘হাফ কেস’ আলাদা করা হয় না। শুধু ভুক্তভোগীর নমুনা এলে সেটা প্রোফাইলিং করে রাখা হয়। পরে আসামি পাওয়া গেলে, আসামির নমুনা নিয়ে তা প্রোফাইলিং হয়। সিআইডির ল্যাবরেটরিতে গত বছর ৫ হাজার ৪২টি মামলার নমুনা এসেছে। এর মধ্যে ৪ হাজার ৮০টিই ধর্ষণের মামলা।
ধর্ষণের মামলার ক্ষেত্রে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য পাঠানো মোট নমুনার মধ্যে ‘হাফ কেস’–এর সংখ্যা প্রায় অর্ধেক। রাজশাহী, রংপুর, খুলনা, বরিশাল ও সিলেটে ‘ফুল কেস’–এর তুলনায় ‘হাফ কেস’–এর সংখ্যা অনেক বেশি। আবার ঢাকা ও চট্টগ্রামে সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বরে ধর্ষণ মামলার নমুনা তুলনামূলক বেশি এসেছে।
ডিএনএ পরীক্ষা বাধ্যতামূলক
২০২০ সালে সিলেট ও নোয়াখালীতে দলবদ্ধ ধর্ষণের দুটি ঘটনায় দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন সরকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০–এর অধীনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড করে এবং ধর্ষণের মামলার আসামি শনাক্ত করতে ডিএনএ পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করে।
বনানীর ধর্ষণের ঘটনায় ভুক্তভোগী শিশুটি নিম্নবিত্ত পরিবারের। ব্যাগ পৌঁছে দিলে টাকা দেওয়া হবে, এ কথা বলে এক ব্যক্তি শিশুটিকে অন্যত্র নিয়ে ধর্ষণ করেন। ধর্ষণে শিশুটির মাসিক ও মলত্যাগের রাস্তা এক হয়ে গেছে। কয়েক দফা অস্ত্রোপচার হয়েছে শিশুটির। চিকিৎসকেরা বলছেন, আরও অস্ত্রোপচার লাগতে পারে। এ ঘটনায় পাশের এক দোকানের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করেছে পুলিশ। সেখানে শিশুটিকে রাস্তা থেকে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখা গেছে। সংগ্রহ করা হয়েছে সন্দেহভাজন আসামির ফুটেজ। তবে তাঁকে শনাক্ত করা যায়নি।
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গত বছরের ৭ সেপ্টেম্বর দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার নারীর (৬৫) মামলাতেও কোনো আসামি এখনো শনাক্ত হননি। মামলাটি শাহবাগ থানা থেকে উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগে স্থানান্তরিত হয়েছে। ওই নারীকে এ বিভাগের সেফ হোমে রাখা হয়েছে। বনানীর ধর্ষণের ঘটনার মতো এ নারীর ক্ষেত্রেও ভুক্তভোগীর ডিএনএ নমুনা ‘হাফ কেস’ হিসেবে জমা রয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ল্যাবরেটরিতে।
পাঁচ ল্যাবরেটরিতে ‘হাফ কেস’ বেশি
দেশের আটটি ল্যাবরেটরির উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ধর্ষণের মামলার ক্ষেত্রে ডিএনএ পরীক্ষার জন্য পাঠানো মোট মামলার নমুনার মধ্যে ‘হাফ কেস’–এর সংখ্যা প্রায় অর্ধেক। রাজশাহী, রংপুর, খুলনা, বরিশাল ও সিলেটে ‘ফুল কেস’–এর তুলনায় ‘হাফ কেস’–এর সংখ্যা অনেক বেশি। আবার ঢাকা ও চট্টগ্রামে সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বরে ধর্ষণের মামলার নমুনা তুলনামূলক বেশি এসেছে।
অপরাধ কমাতে উন্নত দেশগুলোতে সব নাগরিকের ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের মাধ্যমে ডেটাবেজ বা তথ্যভান্ডার করা হয়। আমাদের দেশে এ ধরনের কোনো ডেটাবেজ নেই।অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান ও পুলিশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান
গত বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডিএনএ ল্যাবরেটরিতে ধর্ষণের মামলার মোট ‘কেস’ এসেছে ৭৮৬টি। এর মধ্যে ‘ফুল কেস’ ৫৯৬টি ও ‘হাফ কেস’ ১৯০টি।
একই সময়ে সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ল্যাবরেটরিতে পাঠানো ২৫৯টি মামলার মধ্যে ‘ফুল কেস’ ৬৬টি, ‘হাফ কেস’ ১৯৩টি। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩৫৩টির মধ্যে ‘ফুল কেস’ ২৪৩টি, ‘হাফ কেস’ ১১০টি।
বরিশালের শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩০৪টির মধ্যে ৬১টি ‘ফুল কেস’ ও ২৪৩টি ‘হাফ কেস’। খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১০৫টির মধ্যে ‘ফুল কেস’ ১৬টি, ‘হাফ কেস’ ৮৯টি। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৫৩টির মধ্যে ‘ফুল কেস’ ১৭টি, ‘হাফ কেস’ ৩৬টি।
এ ছাড়া ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ল্যাবরেটরিতে পাঠানো ৭৯টি মামলার মধ্যে ‘ফুল কেস’ ৪১টি, ‘হাফ কেস’ ৩৮টি ও রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৫২টি মামলার মধ্যে ‘ফুল কেস’ ৬৫টি, ‘হাফ কেস’ ১৮৭টি।
ঢাকার ল্যাবরেটরির উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সেপ্টেম্বরে ১০৯টি, অক্টোবরে ১০৫টি ও নভেম্বরে ৭৭টি কেস এসেছে। আর চট্টগ্রামের ল্যাবরেটরিতে সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বরে এসেছে যথাক্রমে ২৪৯, ২৫৯ ও ২৩০টি কেস।
‘হাফ কেস’ পরীক্ষায় যেসব সংকট
ঢাকার কেরানীগঞ্জে গত ৯ আগস্ট রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে দুই তরুণীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ করা হয়। এ ঘটনায় দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় মামলা হয়। ছয় আসামির মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন দুজন।
দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাজহারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সাধারণত সব আসামির ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফল না আসা পর্যন্ত মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয় না। তবে যদি আসামিদের কোনোভাবেই গ্রেপ্তার করা না যায়, সে ক্ষেত্রে ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। এ মামলায় এখনো অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি বলে জানান তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, সাধারণত যেসব ধর্ষণের মামলায় কোনো আসামি গ্রেপ্তার হন না এবং ডিএনএ পরীক্ষাও করা হয় না; সেসব মামলার অভিযোগপত্র ঝুলে যায়।
ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরি (এনএফডিপিএল) প্রধান মো. জাবেদুল আলম খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাফ কেস’–এর ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর পোশাক, ঘটনাস্থলের আলামত দীর্ঘদিন ধরে সংরক্ষণ করতে হয়। অন্তত যত দিন আসামির নমুনা না পাওয়া যায়। অনেক ক্ষেত্রে বেশি দেরি হয়ে গেলে প্রকৃত আসামির সঙ্গে এসব নমুনার ডিএনএ না–ও মিলতে পারে। এ জন্য ল্যাবের আধুনিকীকরণ জরুরি।
দরকার ডিএনএ তথ্যভান্ডার
টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান ও পুলিশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘অপরাধ কমাতে উন্নত দেশগুলোয় সব নাগরিকের ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের মাধ্যমে ডেটাবেজ বা তথ্যভান্ডার করা হয়। আমাদের দেশে এ ধরনের কোনো ডেটাবেজ নেই।’
মুহাম্মদ উমর ফারুক আরও বলেন, ‘যদি আমাদের দেশে ডিএনএ ডেটাবেজ থাকত, তবে ‘হাফ কেস’–এর ঘটনায় ঘটনাস্থলের নমুনা থেকে ডেটাবেজে খোঁজ করে আসামি শনাক্ত করা সম্ভব হতো।’
আঙুলের ছাপ থেকে যেভাবে জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য বের করা হয়, সেভাবে ডিএনএ নমুনায় যা পাওয়া যায়, তা থেকে ডেটাবেজ খুঁজে আসামি শনাক্ত করা যাবে। এতে অপরাধ কমবে। শান্তিপূর্ণ সমাজ নিশ্চিত হবে—যোগ করেন অধ্যাপক উমর ফারুক।
অপরাধবিজ্ঞানের এই শিক্ষক আরও বলেন, অপরাধের তদন্ত ও সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে শনাক্ত করার জন্য ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের কোনো বিকল্প নেই। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে বিভিন্ন আলোচনায় বারবার বলা হয়েছে। রাজধানীতে অন্তত পাইলট আকারে নাগরিকদের ডিএনএ প্রোফাইলিং শুরু করতে সুপারিশ করা হয়েছিল। কাজের কাজ হয়নি।
অপরাধের বিজ্ঞানভিত্তিক তদন্তের গুরুত্বের কথা উল্লেখ করে অধ্যাপক উমর ফারুক বলেন, বিজ্ঞানভিত্তিক তদন্ত না হলে দুর্বল প্রকৃতির দায়সারা অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। এতে ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে যথাযথ বিচার নিশ্চিত করা যায় না। অপরাধীরা অপরাধ করে পার পেয়ে যায়।