১৩ মৃত্যুতেও পুলিশের এমন ‘হেলাফেলা’

চট্টগ্রামে ১০ বছর আগে উড়ালসড়কের গার্ডারধসে ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে
ফাইল ছবি

চট্টগ্রামে ১০ বছর আগে উড়ালসড়কের গার্ডারধসে ১৩ জনের মৃত্যুর ঘটনায় হওয়া মামলায় গুরুত্বপূর্ণ দুই সাক্ষী বাদ পড়েছেন। এই দুজন হলেন লাশের সুরতহাল প্রস্তুতকারী দুই পুলিশ কর্মকর্তা। এমনকি অভিযোগপত্র দেওয়ার আগে সরকারি কৌঁসুলির মতামত নেওয়ার কথা থাকলেও তা করা হয়নি।

আইনজীবীরা বলছেন, পুলিশের এ ধরনের ‘হেলাফেলায়’ আসামিদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ করা কঠিন হবে। এ অবস্থায় ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা।

উড়ালসড়কের গার্ডারধসে নিহত ব্যক্তিদের একজন ছিলেন ২১ বছর বয়সী মো. সাজ্জাদ। তিনি কাঠের ফার্নিচারে নকশার কাজ করতেন। সাজ্জাদের বাবা আবদুস সোবহান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূল আসামিরা আইনের আওতায় আসেনি। যারা আছে, তাদের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীরা সাক্ষ্য না দিলে বিচার কীভাবে হবে?’

মামলা যে পর্যায়ে

বর্তমানে চতুর্থ অতিরিক্ত চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ শরীফুল আলম ভুঁঞার আদালতে মামলাটির সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। পুলিশের গাফিলতির বিষয়টি বিচারকের নজরে এলে ১৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের কাছে চিঠি দেন তিনি। একই সঙ্গে দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে সাক্ষ্য দিতে আদালত সমন জারি করেন। এই দুই পুলিশ কর্মকর্তা হলেন চান্দগাঁও থানার তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) আরিফুর রহমান ও আবদুল হালিম।

চিঠিতে বলা হয়, ‘সম্প্রতি লক্ষ করা যাচ্ছে, বিভিন্ন মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তা অভিযোগপত্রে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের সাক্ষীর কলামে অন্তর্ভুক্ত করছেন না। এতে মামলার বিচারিক কাজে জটিলতাসহ সুষ্ঠু নিষ্পত্তিতে বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে।’

বিষয়টি নিশ্চিত করে চতুর্থ অতিরিক্ত চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি অনুপম চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, গুরুত্বপূর্ণ দুই সাক্ষীকে অভিযোগপত্রে রাখেননি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। অথচ সুরতহাল প্রস্তুতকারী কর্মকর্তাকে অবশ্যই সাক্ষী হিসেবে রাখার বিধান রয়েছে। তদন্ত কর্মকর্তা বাদ দেওয়ায় আদালত উদ্যোগী হয়ে নথি ঘেঁটে সুরতহাল প্রস্তুতকারী কর্মকর্তাদের তলব করছেন। এতে আদালতের বাড়তি সময় নষ্ট হচ্ছে। কোনো কারণে নজরে না এলে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী বাদ পড়ায় আসামিদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণ করা কঠিন হয়ে পড়বে।

আরও পড়ুন

কেন বাদ পড়লেন সাক্ষীরা

আদালত সূত্র জানায়, ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর নগরের চান্দগাঁও থানাধীন বহদ্দারহাটে চট্টগ্রাম উন্নয় কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) নির্মাণাধীন এম এ মান্নান উড়ালসড়কের ১২ ও ১৩ নম্বর গার্ডারধসে ১৩ জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনার দুই দিন পর পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেন। এতে সিডিএর তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুস সালাম ও প্রকল্প পরিচালক এ এম হাবিবুর রহমানকে আসামি করা হয়েছিল।

তদন্ত শেষে পরের বছরের ২৪ অক্টোবর চান্দগাঁও থানার তৎকালীন পরিদর্শক (তদন্ত) শহীদুল ইসলাম আটজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। এতে উড়ালসড়ক নির্মাণের তদারকির সঙ্গে যুক্ত মূল কর্মকর্তাদের কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগ থেকে রেহাই দেয় পুলিশ। রাষ্ট্রপক্ষ এর বিরুদ্ধে নারাজি দেয়। ২০১৪ সালের ১৮ জুন নারাজি আবেদন খারিজ করে আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত।

আরও পড়ুন

তৎকালীন চট্টগ্রাম মহানগর সরকারি কৌঁসুলি মো. ফখরুদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, অভিযোগপত্র দেওয়ার আগে নিয়ম অনুযায়ী সরকারি কৌঁসুলির মতামত নেওয়ার কথা থাকলেও তা করেনি পুলিশ। পরে অধিকতর আবেদন করা হলে তা খারিজ করে দেন আদালত। দায়িত্বে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অবহেলার কারণে এ দুর্ঘটনা। কিন্তু সবাই আইনের আওতায় আসেনি।

আদালত সূত্র জানায়, পুলিশের অভিযোগপত্রে আসামি করা হয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আক্তার অ্যান্ড পারিশা ট্রেড সিস্টেমসের তৎকালীন ব্যবস্থাপক গিয়াস উদ্দিন, একই প্রতিষ্ঠানের মনজুরুল ইসলাম, আবদুল জলিল, আমিনুর রহমান, আবদুল হাই, মোশাররফ হোসেন, শাহজাহান আলী ও রফিকুল ইসলামকে। তাঁরা সবাই জামিনে আছেন।

মামলাটির পরিচালনাকারী সরকারি কৌঁসুলি অনুপম চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, লাশের সুরতহাল প্রস্তুতকারীদের সাক্ষ্য না নিলে অপরাধীরা পরবর্তী সময়ে সুযোগ নেবেন। এ কারণে বিষয়টি আদালতের নজরে এলে মামলার নথি ঘেঁটে সুরতহাল প্রস্তুতকারীদের সাক্ষ্য নিতে আদালত সমন জারি করেন।

চতুর্থ অতিরিক্ত চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের বেঞ্চ সহকারী ওমর ফুয়াদ প্রথম আলোকে জানান, ২২ ফেব্রুয়ারি মামলার পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে। ওই দিন সুরতহাল প্রস্তুতকারী সাক্ষী দুই পুলিশ কর্মকর্তা হাজির হতে সমন পাঠানো হয়েছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম বর্তমানে বান্দরবান সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিসেবে কর্মরত আছেন। জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিষয়টি এখন মনে পড়ছে না।