হাদির ওপর হামলার চরিত্র ভিন্ন, নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা নিয়ে উদ্বেগ

ব্যাটারিচালিত রিকশায় বসা ওসমান হাদিকে গুলি করেন মোটরসাইকেলের পেছনে বসা ব্যক্তি। দ্রুত ঘটনা ঘটিয়ে তাঁরা ওই মোটরসাইকেলে সেখান থেকে চলে যানছবি: সিসি ক্যামেরার ফুটেজ থেকে নেওয়া

জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরদিন রাজধানীতে দিনের বেলায় সম্ভাব্য একজন প্রার্থীকে গুলির ঘটনায় নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, নির্বাচনের সামগ্রিক নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এমন ঘটনা তৈরি করে যাতে কেউ নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে না পারে, সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

রাজনৈতিক দলগুলো মনে করে, ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদিকে যেভাবে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে গুলি করা হয়েছে, তা সাধারণভাবে দেখার সুযোগ নেই। এ ঘটনা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একটি অশনিসংকেত। এটি ভালো নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করবে এবং মানুষের মধ্যে ভীতি তৈরি করবে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক জনসংযোগের সময় চট্টগ্রাম ও পাবনায় গুলির ঘটনা ঘটেছে। তবে ওসমান হাদির ওপর হামলার ঘটনাটির চরিত্র ভিন্ন বলে মনে করা হচ্ছে।

গত ৫ নভেম্বর গণসংযোগ চালানোর সময় চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও-বায়েজিদ) আসনে বিএনপি-মনোনীত প্রার্থী ও দলের মহানগরের আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ গুলিবিদ্ধ হন। এ ঘটনায় একজন নিহত হন। আহত হন আরও দুজন। এরপর ২৭ নভেম্বর পাবনা-৪ (ঈশ্বরদী-আটঘরিয়া) আসনে জামায়াতের প্রার্থী ও দলের জেলা আমির আবু তালেব মণ্ডলের জনসংযোগ ঘিরে হামলা, গুলি ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।

রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, নির্বাচনের সামগ্রিক নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এমন ঘটনা তৈরি করে যাতে কেউ নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে না পারে, সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
রিকশায়  গুলিবিদ্ধ শরিফ ওসমান হাদি। শুক্রবার দুপুরে  শরিফ ওসমান হাদিকে রাজধানীর  বিজয়নগরের বক্স কালভার্ট এলাকায়
ছবি: ফেসবুক থেকে

চট্টগ্রাম ও পাবনার ঘটনা দুটির ক্ষেত্রে স্থানীয় রাজনীতি, অপরাধজগতের বিভেদসহ বিভিন্ন হিসাব-নিকাশের যোগসূত্র থাকতে পারে বলে মনে করে হচ্ছে। তবে ওসমান হাদির ওপর গুলির ঘটনা নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা হতে পারে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে একটি পক্ষ নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না বলে হুমকি দিয়ে আসছিল। তাদের ছাড়া নির্বাচন হলে ভোট প্রতিহত করার ঘোষণাও এসেছে। এরই অংশ হিসেবে এ ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।

আরও পড়ুন

অন্তর্বর্তী সরকারও এ ঘটনাকে নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করার একটা চেষ্টা হিসেবে দেখছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস গতকাল শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে কোনো ধরনের সহিংসতা বরদাশত করা হবে না। জনগণের নিরাপত্তা এবং প্রার্থীদের অবাধ চলাচল নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। দোষীরা যে-ই হোক, আইনের আওতায় আনা হবে।’

আসন্ন নির্বাচন শান্তিপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক ও নিরাপদ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হওয়ার জন্য সব রাজনৈতিক পক্ষ, কর্মী-সমর্থক এবং নাগরিকদের প্রতি শান্তি ও সংযম বজায় রাখার আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে একটি পক্ষ নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না বলে হুমকি দিয়ে আসছিল। তাদের ছাড়া নির্বাচন হলে ভোট প্রতিহত করার ঘোষণাও এসেছে। এরই অংশ হিসেবে এ ঘটনা ঘটে থাকতে পারে।

পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র বলছে, ইতিমধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগসহ (সিআইডি) বিভিন্ন ইউনিট ওসমান হাদির ওপর গুলির ঘটনা তদন্তে মাঠে নেমেছে। র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নও (র‍্যাব) হামলাকারীদের শনাক্ত করতে কাজ শুরু করেছে। তারা ঘটনার নেপথ্যে কারা আছেন, সেটি বিশেষভাবে বিবেচনায় রাখছে।

ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদি
ছবি: ওসমান হাদির ফেসবুক পেজ

ওসমান হাদির ওপর গুলির ঘটনার পর গতকাল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, দেশ অত্যন্ত সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একটি দল, গোষ্ঠী বা কিছু ব্যক্তি এই দেশকে দেশের মানুষের শান্তি, স্থিতিশীলতা বিনষ্টের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। হাদির ওপর এ হামলা ষড়যন্ত্রের অংশ।

অবৈধ অস্ত্র নিয়ে শঙ্কা

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। সেসব ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বড় অংশকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বেশির ভাগ অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। এর বাইরে পুলিশের বিপুল পরিমাণ অস্ত্র লুট হয়েছে। সেগুলো পেশাদার সন্ত্রাসীদের হাতে যেতে পারে, এমন আশঙ্কাও রয়েছে।

রাজধানীর বিজয়নগর এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন ওসমান হাদি। আওয়ামী লীগের শাসনামলে পুরানা পল্টনসহ এর আশপাশের এলাকায় বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটছে। যেমন ২০২২ সালে শাহজাহানপুরে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলামকে (টিপু) গুলি করে হত্যা করা হয়। এসব ঘটনার নেপথ্যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ওই এলাকার অপরাধজগতের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নাম এসেছে। পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের কিছু নেতার নাম উঠে আসে।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর এই এলাকার অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে বড় কোনো সফলতা দেখাতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আওয়ামী লীগের যেসব নেতার ‘আন্ডারওয়ার্ল্ডের’ সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল, তাদের মধ্য থেকেও উল্লেখযোগ্য কেউ গ্রেপ্তার হয়নি।

পুলিশের বিপুল পরিমাণ অস্ত্র লুট হয়েছে। সেগুলো পেশাদার সন্ত্রাসীদের হাতে যেতে পারে, এমন আশঙ্কাও রয়েছে।

হাদিকে গুলি করার ঘটনায় গতকাল জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান নিজের ফেসবুক পেজে এক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ওসমান হাদির গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা প্রমাণ করে, চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের হাতে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র রয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসীদের ধরা নির্বাচন কমিশনের প্রধানতম দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে শিথিলতা দেখালে সুষ্ঠু নির্বাচনের বুলি ফাঁকা প্রমাণিত হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

নতুন নিরাপত্তা পরিকল্পনা

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পুলিশের নিরাপত্তা পরিকল্পনা নতুনভাবে সাজানো হচ্ছে বলে জানা গেছে। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচনবিরোধী পলাতক শক্তি একধরনের আতঙ্ক তৈরির চেষ্টা করবে। এটা বিবেচনায় রেখেই আমরা নিরাপত্তা প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে।’

রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের মধ্যে তৈরি হওয়া উৎকণ্ঠা নিয়ে আইজিপি বলেন, ‘ওসমান হাদির গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। যদি কোনো প্রার্থী অনিরাপদ বোধ করেন, সে ক্ষেত্রে তাঁর ব্যক্তি নিরাপত্তা কীভাবে বাড়ানো যায়, সেটিও আমরা চিন্তা করছি। পাশাপাশি রাতের নিরাপত্তাব্যবস্থার সঙ্গে দিনের নিরাপত্তা পরিকল্পনাও নতুনভাবে সাজানো হচ্ছে।’

জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচনবিরোধী পলাতক শক্তি একধরনের আতঙ্ক তৈরির চেষ্টা করবে। এটা বিবেচনায় রেখেই আমরা নিরাপত্তা প্রস্তুতি গ্রহণ করেছি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম