রিং আইডির এমডি–সিইও এই দম্পতি আসলে কারা

রিং আইডির মালিক শরিফুল ইসলাম ও আইরিন ইসলাম
সংগৃহীত

রিং আইডির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শরিফুল ইসলাম ও তাঁর স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আইরিন ইসলাম বছর পাঁচেক আগে একবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। টেলিযোগাযোগ খাতে ভিশনটেল ও ক্লাউডটেল নামে তাঁদের মালিকানাধীন দুটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সে সময় ২৯৬ কোটি টাকা তছরুপের অভিযোগ এনেছিল বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা (বিটিআরসি)।

প্রায় পাঁচ বছর পর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) আবারও প্রায় ২০০ কোটি টাকা মেরে দেওয়ার অভিযোগে মামলা করল রিং আইডির বিরুদ্ধে।

সিআইডির অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক কামরুল আহসান সাংবাদিকদের বলেন, রিং আইডির শরিফুল ইসলাম ও আইরিন ইসলাম দুজনেই কানাডায়। এর আগেও ২০১৬ সালে তাঁরা একবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। পরে জামিনে মুক্তি পান। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গ্রাহকদের সঙ্গে জালিয়াতির।

আরও পড়ুন

সিআইডি বলছে, গ্রাহকদের তাঁরা সিলভার আইডি, গোল্ড আইডি, প্রবাসী গোল্ড আইডি ও প্রবাসী প্লাটিনাম আইডি খুলতে উদ্বুদ্ধ করতেন। এসব আইডি খুলতে গ্রাহকদের প্রতিষ্ঠানটিতে ১২ থেকে ৫০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করতে হতো। পরিচয়পত্রধারীরা ভিপিএনের মাধ্যমে প্রতিদিন নির্দিষ্টসংখ্যক বিদেশি বিজ্ঞাপন দেখতেন, তার বিনিময়ে লাভ পেতেন। তা ছাড়া অস্বাভাবিক ছাড়ে পণ্যও বিক্রি করছিলেন তাঁরা।

সিআইডির বক্তব্য, বিদেশি যে বিজ্ঞাপনগুলো গ্রাহকেরা দেখাতেন, সেই টাকা আর দেশে ঢোকেনি। লোপাট হয়ে গেছে। দেশের ভেতরেও তাঁরা ২০০ কোটি টাকার বেশি মেরে দিয়েছেন।

সিআইডি সূত্র জানাচ্ছে, শরিফুল ইসলামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক করেছেন। ২০০৫-০৬ সালে স্থায়ী বসবাসের জন্য কানাডায় চলে যান। সেখানে আইরিন ইসলামের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। অর্থনীতি বিষয়ে আইরিন লেখাপড়া করতেন কানাডাতেই। তাঁদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান রিং আইডিতে পরিচালক হিসেবে কাজ করতেন শরিফুল ইসলামের ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম। তিনি চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। রিং আইডির জালিয়াতির মামলায় সিআইডির হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তবে জিজ্ঞাসাবাদে কোনো প্রশ্নেরই ঠিকঠাক জবাব দিতে পারেননি।

রিং আইডির সৃষ্টি কখন, কীভাবে?

লিংকডইনে শরিফুল ইসলাম রিং আইডির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বাইরে আর কোনো ছবি বা তথ্য নেই। কিছু লেখায় আইরিন ইসলামকে নিয়ে রিং আইডি শুরুর কিছু তথ্য পাওয়া যায়।

এসব লেখায় বলা হয়েছে, রিং আইডি প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয় কানাডার মন্ট্রিয়েলে ২০০৫ সালে। ওই বছরের ৩ জুন তাঁরা রিং আইডি ডোমেইন নিবন্ধন করেন। প্রায় এক যুগ পর ২০১৬ সালে রিং আইডি নামে একটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তৈরি করেন। একে ফেসবুকের বিকল্প হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন, এমনও প্রচার ছিল। রিং আইডি ব্যবহার করছেন—এমন ব্যক্তির সংখ্যা দুই কোটি।

রিং আইডির স্বাতন্ত্র্য ছিল এটির ‘সিক্রেট চ্যাট’ অংশ। এতে গোপনে গল্পগুজব করলে বার্তা কতক্ষণ পাওয়া যাবে, তা নির্ধারণ এবং নির্দিষ্ট সময় পর প্রেরকের বার্তা অদৃশ্য হয়ে যেত। এটির মূল প্রতিষ্ঠান কানাডাভিত্তিক রিং ইনকরপোরেশন। আরও জানা যায়, তাঁদের মালিকানাধীন আরেকটি প্রতিষ্ঠানের নাম আইপিভিশন। টেলিযোগাযোগ, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি এবং আইপিভিত্তিক যোগাযোগ সফটওয়্যারের ক্ষেত্রে শরিফুলের ভালো দখল আছে।

প্রথম আলোয় রিং আইডির জালিয়াতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর এর অনেক গ্রাহকই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তবে বিটিআরসি বলছে, এই দম্পতির জাল-জালিয়াতির পুরোনো ইতিহাস আছে। একই রকম তথ্য পাওয়া গেছে রিং আইডিতে কোনো এক সময়ে যাঁরা প্রকৌশলী হিসেবে চাকরি করেছেন, তাঁদের কাছ থেকেও।

বিটিআরসির কর্মকর্তা কাওসার আহমেদ ক্লাউডটেল ও ভিশনটেলের ২৯৬ কোটি টাকা জালিয়াতি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। গত বুধবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘তারা টেলিটকের সিম জাল করত। তারপর ওই সিম ব্যবহার করে অন্য অপারেটরদের ফোন করত। অন্য অপারেটররা খালি বিটিআরসির কাছে পাওনা চায়। পরে খোঁজ নিয়ে দেখা গেল শরিফুল তাঁর আইসিএক্স প্রতিষ্ঠান ক্লাউডটেল থেকে এ কাজ করছেন।’

আরও পড়ুন

এর বাইরেও সরকারকে নির্ধারিত ফি না দেওয়াসহ নানা অভিযোগ ছিল ভিশনটেল ও ক্লাউডটেলের বিরুদ্ধে। তাঁদের বিরুদ্ধে কলাবাগান ও বনানী থানায় দুটো মামলা হয় ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এই দম্পতিকে ২০১৬ সালে রিং আইডির অফিস থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই অফিসি তদন্ত কর্মকর্তার ভাষায়, ‘সেই রকম হাইফাই ছিল।’
বিটিআরসির কর্মকর্তা আরও জানান, সর্বোচ্চ দুই মাস তাঁরা কারাগারে ছিলেন।

গ্রেপ্তারের পর শাহবাগ থানায় নিলে তাঁদের দেখতে ‘ভক্ত-আশেকান’দের ভিড় জমেছিল তখনো। পরে তাঁদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তাঁদের আদালতে হাজির করা হয়। বিটিআরসি ১০ দিনের রিমান্ড চেয়েছিল, আদালত আবেদনে সাড়া না দিয়ে কারাগারে পাঠিয়ে দেন।

হাইকোর্ট থেকে জামিনে মুক্তির পর এই দম্পতি মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করলে বিটিআরসির অনুরোধে তাঁদের আটকে দেওয়া হয়েছিল। পরে অবশ্য তাঁরা ঠিকই মালয়েশিয়ায় যান। এর পর থেকে যাওয়া–আসার মধ্যে ছিলেন। যতদূর জানতে পেরেছেন, ওই মামলার কার্যক্রমের ওপর হাইকোর্টে স্থগিতাদেশ চেয়েছেন শরিফ-আইরিন দম্পতি। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই মামলায় আরও কয়েকজন আসামি ছিলেন। প্রতিষ্ঠানগুলোয় অংশীদার হিসেবে নাম এসেছিল সাবেক দুই মন্ত্রীর পুত্র-কন্যার।

শরিফ-আইরিন দম্পতিকে তাঁদের নিকেতনের অফিস থেকে ২০১৬ সালে গ্রেপ্তারের সময় উপস্থিত ছিলেন প্রকৌশলীরা। তাঁদের একজন প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন। তবে তিনি নাম প্রকাশ করতে চাননি। তিনি নিজেও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র ছিলেন। ওই প্রকৌশলী বলেন, শরিফুল ইসলাম ও আইরিন ইসলাম ২০১৪-১৫ সালে আইপিভিশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান চালু করেন। সেখানে ১৮০ জন প্রথম সারির সফটওয়্যার প্রকৌশলীকে চাকরি দেন তাঁরা। বিদেশি বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান তখন বাংলাদেশে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তাঁরাও আইপিভিশনে যুক্ত হন। নিকেতনে তিনটি ভবন ভাড়া করেছিলেন। একেকটি ভবন ছয় থেকে সাততলা করে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের থাকা-খাওয়া ছিল বিনা মূল্যে।

রিং আইডির শরিফুল ইসলাম ও আইরিন ইসলাম দুজনেই কানাডায়। এর আগেও ২০১৬ সালে তাঁরা একবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। পরে জামিনে মুক্তি পান। তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গ্রাহকদের সঙ্গে জালিয়াতির।

২০১৬ সালের আগস্টের দিকে পুলিশ নিকেতনের ৮ নম্বর সড়কের অফিস থেকে স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। কেন তাঁরা গ্রেপ্তার হলেন, সে সম্পর্কে প্রশাসন ও অন্য কর্মীরা কিছুই জানতেন না। তাঁরা বলেন, আগের অংশীদাররা ষড়যন্ত্র করে ফাঁসিয়ে দিয়েছেন।

ওই প্রকৌশলী বলেন, শরিফুল ইসলাম প্রকৌশলী হিসেবে খুব ভালো ছিলেন না। কিন্তু তাঁর ভাবনা ছিল অনবদ্য। প্রকৌশলীরা ভাবনাটা প্রায় সফল করে আনার পর শরিফুল আর সেটার বাস্তবায়ন করতেন না।

যেমন রিং আইডিতে একটা কল ফিচার তাঁরা তৈরি করেছিলেন। ওই সময় মেসেঞ্জারে ফোন করলেও পরিষ্কার কথা শোনা যেত না, ভেঙে ভেঙে যেত। আইপিভিশনের প্রকৌশলীরা রিং আইডি থেকে ফোন করার ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু সেটি ভোক্তাদের কাছে নিয়ে যাওয়ায় শরিফুল আর আগ্রহী হননি। তাঁরা একটি আইপি টিভি করার কাজ প্রায় চূড়ান্ত করে এনেছিলেন, সেটাও আর মাঠে গড়ায়নি। এমনকি ভার্চ্যুয়াল কারেন্সি করার কাজও করছিলেন। তাতেও আগ্রহ দেখাননি শরিফুল।

আইপিভিশনের সাবেক ওই প্রকৌশলী বলেন, ‘ব্যবসা হয়—এমন কিছুই করতেন না তাঁরা। আমরা কত বলতাম টাইগার আইটি কত কাজ করছে, আমরা তো এই কাজগুলো করতে পারি। শরিফ ভাই বলতেন, এই দুই-চার-পাঁচ কোটি টাকা দিয়ে কী হবে।’

সবশেষ শরিফুল ও আইরিন একটি স্টুডিও বানান। ওই স্টুডিওতে মডেলরা আসতেন, তাঁদের সঙ্গে টাকার বিনিময়ে ভার্চ্যুয়াল আড্ডা দেওয়া যেত।

এই দম্পতির উচ্চমহলে যাতায়াত ছিল বলে জানাচ্ছেন তাঁর প্রতিষ্ঠানের একাধিক কর্মকর্তা। আইরিন ইসলামের খালু অত্যন্ত প্রভাবশালী একজন সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। ওই কর্মকর্তার স্ত্রী আবার প্রতিষ্ঠানের মানবসম্পদ কর্মকর্তা ছিলেন। রিং আইডি নিত্যনতুন সফটওয়্যার বানিয়ে বাজারে না আনলেও তারা এশিয়া কাপ, অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের পৃষ্ঠপোষক বা স্পনসর ছিল।

আইপিভিশনে ২০১৭ সালের মাঝামাঝি থেকে প্রকৌশলীদের বেতন অনিয়মিত হতে থাকে। চার মাসের বেতন বকেয়া রেখে যে প্রকৌশলী প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন, তিনি চলে আসেন। থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থা থাকায় অনেকেই অবশ্য এর পরও রয়ে গিয়েছিলেন। হঠাৎ গত সেপ্টেম্বরে তাঁকে ডেকে এক মাসের বেতন দেয় রিং আইডি।

এসব বিষয়ে জানতে শরিফুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছে প্রথম আলো। হোয়াটসঅ্যাপে গত মঙ্গলবার তাঁকে ফোন করা হলে তিনি এক দিন সময় নেন। অনানুষ্ঠানিকভাবে বেশ কিছু কথা বললেও সেগুলো প্রকাশের অনুমতি দেননি।