হামিদুলের খুনি ‘অ্যারাবিয়ান সোহেল’রা শনাক্ত হলেন যেভাবে

খুনের ঘটনার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেপ্তার হয় ছিনতাইকারী দলটিছবি: প্রথম আলো

মো. হামিদুল ইসলাম যখন ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন, তখন হাইকোর্ট মাজারের সামনে ভাসমান মানুষ ঘরকন্নায় ব্যস্ত। কিছুটা দূর থেকে এক হিজড়া প্রত্যক্ষ করছিলেন ঘটনাটি। একপর্যায়ে এক ব্যক্তিকে ছিনতাইকারী দলটির প্রধানের সঙ্গে কথা বলতে দেখেন তিনি। হামিদুলের খুনিদের শনাক্ত করায় প্রথম সূত্র ছিলেন ওই প্রত্যক্ষদর্শী।

গত শনিবার রাতে জাসদ নেতা ও কেব্‌ল টিভি নেটওয়ার্ক ব্যবসায়ী হামিদুল ইসলাম খুন হন। ঘটনার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই গ্রেপ্তার হয় পেশাদার ছিনতাইকারী দলটি। তাঁরা এর আগেও গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।

উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের ৩০ মার্চ রাজধানীর তেজগাঁওয়ের দক্ষিণ বেগুনবাড়ি দীপিকার মোড়‌ে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয় তরুণ ব্লগার ওয়াশিকুরকে। ঘটনার পর দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যাওয়ার সময় লাবণ্য হিজড়া দুই হাত দিয়ে তাঁদের আটকান। তুলে দেন পুলিশের হাতে।

আজ মঙ্গলবার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, ছিনতাইকারীদের প্রত্যেকের নামে মামলা আছে। ১০টির ওপর মামলা আছে, এমন ছিনতাইকারীও আছেন এই দলে। ওই রাতে হাইকোর্ট মাজারের কাছে হামিদুলের কাছ থেকে ছিনতাইকারীরা যখন টাকাপয়সা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন, তখন তিনি চিৎকার করতে থাকেন। ছিনতাইকারীরা তখন হামিদুলকে ছুরি মেরে চলে যায়। যাওয়ার আগে তাঁর পকেট থেকে মানিব্যাগ আর মুঠোফোন তুলে নেয় তারা। মানিব্যাগে ছিল ৩০০ টাকা। বাড়িভাড়ার ১২ হাজার টাকা থেকে যায় হামিদুলের পকেটেই।

যে রাতে হামিদুল খুন হন, সে রাতেই ছায়া তদন্তে নামে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা রমনা বিভাগ। কীভাবে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ছিনতাইকারীদের সবাইকে ধরা সম্ভব হলো, সে সম্পর্কে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন গোয়েন্দা (রমনা) বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মিশু বিশ্বাস। এ ঘটনায় সিসি ক্যামেরার ফুটেজের সহযোগিতা পাননি তাঁরা। ক্যামেরা ছিল উল্টো দিকে।

ঘটনাস্থলে তাঁদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন প্রত্যক্ষদর্শী। একজন ব্যক্তিকে তিনি ছিনতাইকারী দলের প্রধানের সঙ্গে খোশগল্প করতে দেখেন। তাঁকে তিনি ‘সোহেল ভাই কী করতেছেন’ এমন কথা বলতে শুনেছেন। পরে ছিনতাইকারী বলেন, ‘এই সর! কাজ করতেছি’। তখন সরে আসেন তিনি। প্রত্যক্ষদর্শীকে পুলিশ কয়েকজনের ছবি দেখায়, তিনি সোহেলকে শনাক্ত করেন। পাশাপাশি বলেন, তিনি যাকে সোহেলের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছেন, ওই ব্যক্তিও ভাসমান। হাইকোর্ট মাজারের কাছেই থাকেন।

ছিনতাইকারীদের দলটিকে ব্যাটারিচালিত এই রিকশায় করে আনা –নেওয়া করতেন শাকিল
ছবি: প্রথম আলো

রাতেই পুলিশ ওই ভাসমান ব্যক্তিকে খুঁজে বের করে। তিনিও নানা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। তাঁর কাছ থেকে পুলিশ জানতে পারে, এই সোহেল ছিনতাইকারী মহলে ‘অ্যারাবিয়ান সোহেল’ নামে পরিচিত। ছোটবেলায় সৌদি আরবে কেটেছে সোহেলের, তাই এই নাম। সোহেলদের বাড়ি টেকনাফে। ২০০০ সালের দিকে সপরিবার তাঁরা দেশে ফিরে আসেন।

গোয়েন্দা (রমনা) বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মিশু বিশ্বাস নিরাপত্তার স্বার্থে ওই দুজনের (প্রত্যক্ষদর্শী ও ভাসমান ব্যক্তি) নাম প্রকাশ করতে চাননি। তাঁর সঙ্গে যখন ডিবি কার্যালয়ে কথা হচ্ছে, তখন সামনেই বসা হামিদুল ইসলামের ছেলে নাহিদুল ইসলাম ও অন্য স্বজনেরা। এক ফাঁকেই হামিদুলের মেয়ের জামাই মাকসুদুর মুঠোফোনে শ্বশুরের মৃতদেহের ছবি দেখান। হাত দিয়ে ছিনতাইকারীদের হামলা ঠেকাতে গিয়েছিলেন, হাতে ছুরির গভীর ক্ষত। পায়েও ক্ষত আছে। ছুরিকাহত হয়েও নিজেই ভ্যানগাড়িতে চড়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছান। পরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যান তিনি।

পুলিশ জানায়, সোহেলের পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা দিতে না পারলেও ওই ব্যক্তি পুলিশকে জানান, সোহেলের সাবেক এক প্রেমিকা স্টেডিয়াম এলাকায় থাকেন। রাতেই ওই প্রেমিকার সন্ধান পান গোয়েন্দারা। তার সূত্র ধরে প্রথমে তাঁরা সোহেল ও শুক্কুরকে গ্রেপ্তার করেন। এরপর একে একে গ্রেপ্তার হন জাহিদ হোসেন, শাকিল ওরফে ডুম্বাস ও সোহেল মিয়া। তাঁদের কাছ থেকে উদ্ধার হয় একটি চাকু, একটি মোটরচালিত রিকশা, ছিনতাই হওয়া মুঠোফোন ও মানিব্যাগ। রাজধানীর উত্তর মুগদা ও কামরাঙ্গীরচর এলাকায় থাকতেন এই দলের সদস্যরা।

ছিনতাইকারীদের আনা-নেওয়া করতেন শাকিল
দলটি ছিনতাইয়ের কাজে এই মোটরচালিত রিকশা ব্যবহার করত। চালক শাকিলের কবজি কাটা পড়ে বেশ কয়েক বছর আগে। মূল সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা চালানো নিষেধ হলেও, হাত কাটা বলে শাকিলকে সহানুভূতির চোখে দেখত সবাই। এই সহানুভূতিকে কাজে লাগিয়েই ছিনতাইকারীদের দলটিকে আনা–নেওয়া করতেন শাকিল।

ছিনতাইকারী দলের আশ্রয়দাতা মালা
ছবি: সংগৃহীত

সবাই ‘মালা’র আশ্রিত

ছিনতাইকারীদের এই দলটিকে ধরার পর পুলিশ সন্ধান পায় স্বামী–স্ত্রীর, যারা ঢাকা শহরের বেশ কটি ছিনতাইকারী দলের আশ্রয়দাতা। ছিনতাইকারীদের থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থা ও তাদের ছিনিয়ে নেওয়া পণ্য বিক্রি করে থাকে এরা। পাশাপাশি কেউ গ্রেপ্তার হলে জামিনের জন্য উকিল ধরার কাজটিও বেশ অনেক বছর ধরে করে আসছে তারা।

এ দফাতেও ছিনতাইয়ের পর মালার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন অ্যারাবিয়ান সোহেল। মালার বাড়ি পটুয়াখালীর গলাচিপায়। ছোটবেলায় কারওয়ান বাজারে সবজি কুড়ানোর কাজ করতেন। প্রথম স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। এখন তৃতীয় স্বামীর সংসার করছেন। বড় দাঁও মারার পর তাঁর বাসাতেই ইয়াবার আসর জমায় ছিনতাইকারীরা।

মালাকে গ্রেপ্তার এখন সময়ের ব্যাপার বলে জানাচ্ছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।

ছিনতাই কি বাড়ছে?


ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, প্রতিদিন ছিনতাই হচ্ছে। ছিনতাই কি বাড়ছে?

বাদিকদের এমন প্রশ্নের সরাসরি জবাব তিনি এড়িয়ে গেছেন। তিনি বলেন, দুই কোটি মানুষের শহর। শীতকাল ও করোনা অনেক অপরাধের সুযোগ করে দেয়।

হাফিজ আক্তার বলেন, ১৬ জানুয়ারি থেকে ছিনতাই দমনে শহরে বিশেষ অভিযান শুরু হয়েছে। ২৪ ঘণ্টা কাজ চলছে। যেখানে টহল দল থাকছে না, সেখানে ছিনতাইকারীরা সুযোগ নিচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের অপরাধের কারণে বাড়িওয়ালা–ভাড়াটেদের হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

ছিনতাই হলে থানা মামলা নেয় না—সাংবাদিকদের এমন কথার জবাবে হাফিজ আক্তার নাগরিকদের উদ্দেশে ছিনতাইয়ের মামলা করার অনুরোধ করেছেন। কোনো থানা মামলা নিতে না চাইলে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানোরও আহ্বান জানান তিনি। পাশাপাশি এ–ও বলেন, অনেকেরই মামলা করায় অনীহা আছে।

আরও পড়ুন