চট্টগ্রামে তবু বন্ধ হয়নি পাহাড় কাটা

এলাকাটিতে ৩৫টির মতো পাহাড় ছিল। এর মধ্যে ২০টির অস্তিত্ব নেই। ১৫টি পাহাড় আংশিক কিংবা অর্ধকাটা অবস্থায় রয়েছে।

চট্টগ্রাম নগরের উত্তর পাহাড়তলীর বিজয়নগরে পাহাড় কেটে গড়ে ওঠা স্থাপনা। ১৫ জানুয়ারিছবি: সংগৃহীত

দুই মন্ত্রীর কড়া হুঁশিয়ারি, মেয়রের কঠোর অবস্থান, পরিবেশ অধিদপ্তরের মামলা—কোনো কিছুতেই বন্ধ হয়নি চট্টগ্রাম নগরের উত্তর পাহাড়তলী এলাকার পাহাড় কাটা। বরং নতুন করে কাটা হচ্ছে আরও পাহাড়। ১৫ জানুয়ারি পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি দল পরিদর্শনে গিয়ে দেখতে পায় ওয়ার্ডের বিজয়নগরে নতুন একটি পাহাড় কেটে চারটি টিনের স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। এ জন্য মামলা করতে যাচ্ছে সংস্থাটি।

পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও স্থানীয় পরিবেশবাদীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাহাড় কাটা চলে মূলত সাময়িক বহিষ্কৃত উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ড কাউন্সিলর জহুরুল আলম ওরফে জসিমের নেতৃত্বে। তিনি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক। পরিবেশ অধিদপ্তরের করা তিনটি মামলায়ও তাঁকে আসামি করা হয়েছে।

নগরের সবচেয়ে বেশি পাহাড় কাটা হচ্ছে এই ওয়ার্ডের আকবরশাহ এলাকায়। পরিবেশ আদালতে পরিবেশ অধিদপ্তর গত দুই বছরে পাহাড় কাটার অভিযোগে ৩২টি মামলা করেছে। এর মধ্যে ২০টি মামলা হয়েছে আকবরশাহ ও সংলগ্ন মাঝেরঘোনা এলাকায় পাহাড় কাটার কারণে।

নতুন করে পাহাড় কেটে স্থাপনা করা হয়েছে। শুনেছি এসব লোক কাউন্সিলর জহুরুল আলমের অনুসারী। আমরা এই পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে মামলা করব।
পরিবেশ অধিদপ্তরের রসায়নবিদ মোহাম্মদ রুবাইয়াত

সম্প্রতি বিজয়নগর এলাকায় রেলওয়ের পাহাড় কেটে ঘর করার অভিযোগ পেয়ে পরিদর্শন করে পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি দল। ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর পাহাড় কাটার প্রমাণ পেয়ে চারজনকে নোটিশ দেয়। দলটির নেতৃত্ব দেন অধিদপ্তরের রসায়নবিদ মোহাম্মদ রুবাইয়াত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নতুন করে পাহাড় কেটে স্থাপনা করা হয়েছে। শুনেছি এসব লোক কাউন্সিলর জহুরুল আলমের অনুসারী। আমরা এই পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে মামলা করব।’

চট্টগ্রাম নগরের পাহাড়তলীর লেকভিউ এলাকার ভেতর দিয়ে যেতে হয় বিজয়নগর। পাহাড় কাটার অভিযোগ পেয়ে এই প্রতিবেদক গত মঙ্গলবার দুপুরে ওই এলাকায় গেলে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। সেখানে স্থানীয়ভাবে পাহারা বসিয়ে রাখা হয়েছে। তিন থেকে চারজন ব্যক্তি ঢোকার মুখে পাহারায় ছিলেন।

আরও পড়ুন

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাহারাদারেরা মূলত কাউন্সিলর জহুরুলের লোক। পুলিশ কিংবা প্রশাসনের লোকজন ছাড়া কাউকে তাঁরা ঢুকতে দেন না।

জানতে চাইলে আকবরশাহ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আল মামুন বলেন, ‘আমরা খবর পেলে অভিযান চালাই। পাহারা দেওয়ার বিষয়টা এখনো জানি না।’

পরিবেশ সংগঠনের হিসাবে, উত্তর পাহাড়তলী মৌজায় ৩৫টির মতো পাহাড় ছিল। ২০টির অস্তিত্ব নেই। বর্তমানে ১৫টি পাহাড় আংশিক কিংবা অর্ধকাটা অবস্থায় রয়েছে বলে স্থানীয় সূত্র জানায়। এসব পাহাড় কেটে প্লট, ঘরবাড়ি তৈরি করা হয়েছে।

মন্ত্রী-মেয়রের হুঁশিয়ারির পরও পাহাড় কাটা

গত বছরের ১৯ অক্টোবর চট্টগ্রামে একটি সেমিনারে তৎকালীন ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী পাহাড় কাটা রোধে কঠোর হুঁশিয়ারি দেন। এর আগে ২০২০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন আকবর শাহ ও বায়েজিদের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে পাহাড় কাটা রোধে কঠোর হওয়ার ঘোষণা দেন। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের সাধারণ সভা থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময় মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীও পাহাড় কাটা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা উল্লেখ করেছিলেন। তাঁরা প্রশাসনকে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি।

সিটি মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাহাড় কাটা রোধের মূল দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের এবং পুলিশের। এর পরও আমরা যখন খবর পাই, তখনই ব্যবস্থা নিচ্ছি।’

আমরা খবর পেলে অভিযান চালাই। পাহারা দেওয়ার বিষয়টা এখনো জানি না।
আকবরশাহ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আল মামুন

জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক হিল্লোল বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, পাহাড় কাটার ঘটনায় নিয়মিত মামলা করা হচ্ছে। আকবরশাহ এলাকায় পাহাড় কাটার অপরাধে বেশি মামলা হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, আকবরশাহ থানা এলাকায় অবস্থিত বিভিন্ন সরকারি পাহাড়ের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে কাউন্সিলর জহুরুল আলম ও তাঁর অনুসারীদের কাছে। পাহাড় কেটে নিম্ন আয়ের লোকজনকে সেখানে ঘরভাড়া থেকে শুরু করে দখল পর্যন্ত টাকার বিনিময়ে হস্তান্তরের অভিযোগ রয়েছে তাঁদের বিরুদ্ধে।

আরও পড়ুন

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে কাউন্সিলর জহুরুল আলমকে ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। তবে বিভিন্ন সময় জহুরুল আলম বলেছিলেন, কারা পাহাড় কাটছে তা তিনি জানেন না। তাঁর ওয়ার্ডের অর্ধেক লোক থাকে পাহাড়ে। পাহাড় কেটে তাঁরা হয়তো বাড়িঘর করেন।

এই ওয়ার্ডেই সবচেয়ে বেশি লোক পাহাড়ের ঝুঁকিতে বসবাস করেন। এখানে ১, ২ ও ৩ নম্বর ঝিল, বিজয়নগর, জিয়ানগর এবং বেলতলীঘোনা এলাকায় অন্তত ৪০ হাজার লোক অবৈধভাবে পাহাড়ে বসবাস করেন বলে জানায় জেলা প্রশাসন।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) আকবর শাহ থানার উত্তর পাহাড়তলী মৌজার ১০ দশমিক ৫১ একর জায়গাজুড়ে থাকা পাহাড় কাটা বন্ধের নির্দেশনা চেয়ে ২০১৫ সালে রিট করে। এরপর হাইকোর্ট ওই পাহাড় কাটার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেন। নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও স্থানীয় কাউন্সিলর পাহাড় কাটা অব্যাহত রাখেন। এরপর গত বছরের বেলার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯ জুন ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জহুরুল আলমের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল দেন হাইকোর্ট।

এর আগে ২০২৩ সালের ২৬ জানুয়ারি বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান আকবরশাহ এলাকায় পাহাড় কাটা পরিদর্শনে গেলে তাঁকে লক্ষ্য করে ঢিল ছোড়া হয়। এ ঘটনায়ও জহুরুলকে প্রধান আসামি করে মামলা হয়েছিল। সেই মামলায় আদালত অভিযোগপত্র গ্রহণ করেছেন। এরপর গত বুধবার জহুরুলকে সাময়িক বরখাস্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।

পরিবেশ সংগঠনের হিসাবে, উত্তর পাহাড়তলী মৌজায় ৩৫টির মতো পাহাড় ছিল। ২০টির অস্তিত্ব নেই। বর্তমানে ১৫টি পাহাড় আংশিক কিংবা অর্ধকাটা অবস্থায় রয়েছে বলে স্থানীয় সূত্র জানায়। এসব পাহাড় কেটে প্লট, ঘরবাড়ি তৈরি করা হয়েছে।

এই ওয়ার্ডেই সবচেয়ে বেশি লোক পাহাড়ের ঝুঁকিতে বসবাস করেন। এখানে ১, ২ ও ৩ নম্বর ঝিল, বিজয়নগর, জিয়ানগর এবং বেলতলীঘোনা এলাকায় অন্তত ৪০ হাজার লোক অবৈধভাবে পাহাড়ে বসবাস করেন বলে জানায় জেলা প্রশাসন।

সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও জেলা প্রশাসন কঠোর না হলে পাহাড় কাটা রোধ করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক অলক পাল। তিনি বলেন, অনেক জনপ্রতিনিধি এই পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িত। এখনই ব্যবস্থা নেওয়া না গেলে পাহাড় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।