ঘুমের মধ্যে আঁতকে উঠছে শিশুরা, ঘর থেকে বেরোতে ভয়

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী ইউনিয়নে অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণ। শনিবার বিকেলে উপজেলার কদমরসুল এলাকায়ছবি: সংগৃহীত

‘ছেলেমেয়ে দুজন কিছুতেই একা থাকতে চায় না। রাতে ঘুমাতে গেলেও ভয় পায়। ঘুমের ঘোরে চিৎকার করে জেগে ওঠে। এরপর বিছানায় কান্নাকাটি করে।’ নিজের দুই সন্তানকে নিয়ে এমনই তথ্য দিলেন অক্সিজেন কারখানা বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের কেশবপুর গ্রামের গৃহবধূ কোহিনুর বেগম।

কোহিনুর বেগমের ছেলে সিফাত হোসেনের বয়স ৫ বছর। মেয়ে সানজিদা আক্তার ১০ বছরের। গত শনিবার সীতাকুণ্ডের যে কারখানাটিতে বিস্ফোরণ হয়েছে, সেটি থেকে ১০০ মিটার দূরে চারতলা ভবনের চতুর্থ তলায় কোহিনুর বেগমের বসবাস। বিস্ফোরণের পর থেকেই তাঁর সন্তানেরা ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন বলে জানান কোহিনুর বেগম। তাঁর স্বামী নুরুল আলম পাশের একটি কারখানার শ্রমিক। এই চার সন্তান ও স্বামী, স্ত্রী মিলে ছয়জনের সংসার। বড় দুই সন্তানের (১৬ ও ১৮ বছরের) তেমন কোনো সমস্যা হয়নি।

আরও পড়ুন

কোহিনুর বেগম প্রথম আলোকে বলেন, বিস্ফোরণের সময় তাঁদের ভবনটি প্রবলভাবে কেঁপে ওঠে। ঘরের ভেতরে থাকা সন্তানেরা আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে। পরে বাইরে গিয়ে বীভৎস সব দৃশ্য দেখতে হয়েছে তাদের।

কোহিনুর বেগমের দুই সন্তানের মতো একই অবস্থা নুরজাহান বেগম নামের অপর এক নারীর দুই সন্তানেরও। কারখানাটি থেকে প্রায় ১৫০ মিটার দূরত্বে কাঁচা ঘরে বসবাস তাঁর। তিনি বলেন, দুর্ঘটনার সময় কারখানার কাছাকাছি একটি মাঠে খেলা করছিল তাঁর ১১ বছরের মেয়ে ও ৭ বছরের ছেলে। বিকট শব্দে বিস্ফোরণের পর হইচই শুরু হয়। তিনি দৌড়ে গিয়ে মাঠ থেকে ছেলেমেয়েদের বাড়িতে নিয়ে আসেন। তাঁর সন্তান দুজন এর পর থেকে সব সময় আতঙ্কগ্রস্ত থাকে। রাতে ঘুম ভেঙে যায় তাদের। আতঙ্কে মাঠে খেলতে যাচ্ছে না। বিদ্যালয়েও যায়নি দুদিন।

এলাকার বেশির ভাগ শিশু–কিশোরের এখন এই অবস্থা। শিশুরা ঘর থেকে বের হতেও ভয় পাচ্ছে। গত মঙ্গলবার বিকেলে কেশবপুর গ্রামের গেলে দেখা যায় এ চিত্র। সোনাইছড়ির ইউনিয়নের এই গ্রামটির উত্তর দিকে বিএম কনটেইনার ডিপো, দক্ষিণ দিকে অবস্থিত সীমা অক্সিজেন কারখানা। এ ছাড়া আরও অন্তত ১০টি শিল্পকারখানা রয়েছে গ্রামটির আশপাশে।

আরও পড়ুন

গত শনিবার বিকেলে সীতাকুণ্ড উপজেলার কদমরসুল বাজারের পাশে সীমা অক্সিজেন কারখানায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত সাতজন মারা গেছেন। গুরুতর আহত হন ২৪ জন। বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে কারখানার আশপাশের অন্তত এক বর্গকিলোমিটার এলাকা। বিচ্ছিন্ন লোহার টুকরা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। বিস্ফোরণস্থল থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূর পর্যন্ত উড়ে যায় লোহার পাত। গত বছরের ৪ জুন বিএম কনটেইনার ডিপোর বিস্ফোরণেও এই গ্রামটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে কদমরসুল বাজারের পূর্ব দিকে কেশবপুর গ্রাম। কাঁচা, আধা পাকা ও পাকা বাড়ি রয়েছে গ্রামে। গ্রামের বাসিন্দাদের মধ্যে বেশির ভাগই নিম্ন আয়ের। দরজা-জানালা ভেঙে গেছে অধিকাংশ ঘরে। কয়েকটি ঘরের দেয়ালেও দেখা দিয়েছে ফাটল।

আরও পড়ুন

কথা হয় এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলামের সঙ্গে। দুর্ঘটনাস্থল থেকে ২৫০ মিটার উত্তরে তাঁর দোতলা পাকা বাড়ি। রফিকুল ইসলাম বলেন, ঘরের সব জানালার কাচ ভেঙে পড়ে। কারখানা থেকে একটি লোহার পাত উড়ে এসে তাঁর উঠানে পড়ে। লোহার পাতের আঘাতে তিনটি সুপারিগাছ ভেঙে গেলেও উঠানে খেলতে থাকা শিশুরা রক্ষা পায়। সেদিনের ভয়ের কথা বাড়ির শিশুরা ভুলতে পারছে না।

সোনাইছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনির আহম্মদ জানান, কেশবপুর গ্রামে ১ হাজার ২০০ পরিবারের বসতি। বিএম কনটেইনার ডিপো ও সীমা অক্সিজেনের মাঝামাঝি এলাকায় রয়েছে ছয় শতধিক পরিবার। এর মধ্যে অক্সিজেন কারখানায় বিস্ফোরণে অন্তত ৩০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব পরিবারের ১০ বছরের কম বয়সের অন্তত ১ হাজার শিশু রয়েছে। প্রত্যেকে কমবেশি ভয় পেয়েছে। কারও কারও শ্রবণেও সমস্যা হচ্ছে।

সীতাকুণ্ড উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্র জানায়, শিশুদের পাশাপাশি বয়স্ক অনেকেই ট্রমায় ভুগতে পারেন। শ্রবণেও সমস্যা হবে। ট্রমাসহ দুর্ঘটনাকবলিত এলাকার সার্বিক খোঁজখবর নিতে শিগগিরই একটি চিকিৎসক দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করবে।

বিস্ফোরণের মতো এ ধরনের ঘটনা শিশু মনে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে উল্লেখ করে শিশুবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক প্রণব কুমার চৌধুরী বলেন, ভয় বা আতঙ্কের শিকার হলে তাৎক্ষণিকভাবে মনের ওপর প্রভাব পড়ে। এ ছাড়া ভবিষ্যতে তাকে দুঃস্বপ্ন তাড়া করে বেড়াবে। আতঙ্ক না কাটলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, উচ্চ শব্দের কারণে শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ক্ষেত্রেও কান পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া দরকার।

ক্ষতিপূরণের দাবি

গত মঙ্গলবার দেখা যায়, কেশবপুরের আবদুল মালেক সেরাং জামে মসজিদের সামনে গিয়ে চোখে পড়ে মসজিদের কাচ লাগানোর কাজ করছেন কয়েকজন শ্রমিক। তাঁরা জানান, সীমা অক্সিজেন কারখানায় বিস্ফোরণের সময় মসজিদের সব কটি কাচের জানালা ভেঙে গেছে। তাই নতুন করে কাচ লাগানোর কাজ করছেন তাঁরা। এর আগে বিএম ডিপোর দুর্ঘটনার সময়ও মসজিদটি একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

সীমা অক্সিজেন কারখানার বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাবাসী ক্ষতিপূরণের দাবি তুলেছেন। কেশবপুরের বাসিন্দারা জানান, এলাকার কারখানাগুলোয় দুর্ঘটনায় জনবসতির ক্ষতি হলেও যথাযথ ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায় না। বিএম ডিপোর দুর্ঘটনার পর ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি। ক্ষতিপূরণ কম হওয়ায় অনেক বাসিন্দা তা না নিয়ে ফেরত দিয়েছেন।

ইসমাইল হোসেন নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা প্রথম আলোকে বলেন, ডিপো বিস্ফোরণে তাঁর ক্ষতি হয়েছিল ১৫ হাজার টাকার মতো। তাঁকে এক হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে চাওয়ায় তিনি তা নেননি। এবার যথাযথ ক্ষতিপূরণ না পেলে এলাকাবাসী বিক্ষুব্ধ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সীমা অক্সিজেন কারখানায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের তালিকা ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তৈরি করা হচ্ছে বলে জানান সোনাইছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ইয়াকুব আলী।