আমরা নদীশাসন করতে চেয়েছি, কিন্তু পরিচর্যা করতে চাইনি

তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক শফিয়ার রহমান
ছবি: প্রথম আলো

উজান থেকে আসা ঢলে তিস্তা নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়ে বন্যা দেখা দিয়েছে রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলায়। কার্তিক মাসে হঠাৎ এ বন্যায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছে নদীপারের মানুষ। দেখা দিয়েছে ফসলহানির আশঙ্কা। রংপুর অঞ্চলের বন্যা, নদীভাঙন ও নদী আন্দোলন নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন শফিয়ার রহমান। দীর্ঘদিন নদী সুরক্ষার দাবিতে কাজ করছেন তিনি। সাবেক স্কুলশিক্ষক শফিয়ার বর্তমানে তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন প্রথম আলোর রংপুরের নিজস্ব প্রতিবেদক আরিফুল হক।

প্রশ্ন :

প্রতিবছর রংপুর অঞ্চলে বন্যা দেখা দেয় কেন?

শফিয়ার রহমান: বন্যা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এটা একেবারেই বন্ধ হবে, এমন আশা করা যায় না। তবে রংপুর অঞ্চলে যে বন্যা হয়, তার কারণ অনেকটাই মানুষের তৈরি করা। আমরা নদীশাসন করতে চেয়েছি, কিন্তু নদীর পরিচর্যা একেবারেই করতে চাইনি। যেমন তিস্তা নদীর কথাই ধরা যাক। অনেক স্থানে এই নদীর দুই পাড়ে নদী রক্ষা বাঁধ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রতিবছর যে পলি বয়ে আসে, তা সরানোর কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি। ফলে নদীর তলদেশ ভরাট হয়েছে। অনেক স্থানে নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকার চেয়েও নদীর তলদেশ উঁচু। সেই সব এলাকায় সামান্য পানিতেই বন্যা হয়। নদী থাকলে সেই নদী পার্শ্ববর্তী এলাকার পানি টেনে নেয়। তিস্তা নদীর ক্ষেত্রে অনেক স্থানে তার উল্টো দৃশ্য দেখা যায়। তিস্তার পানিতেই বন্যা হয়। এ বছর তিস্তার পারে যতবার বন্যা হয়েছে, তা মূলত তিস্তা নদীর পরিচর্যা না হওয়ার কারণে। প্রতিবছর পানি উন্নয়ন বোর্ড নদী সুরক্ষায় যে টাকা খরচ করে, তা পানিতেই ভেসে যায়। আমরা মনে করি, নদীর বিজ্ঞানসম্মত পরিচর্যা হলেই বন্যা ও ভাঙন কমবে।

প্রশ্ন :

এ বছর কার্তিক মাসে যে বন্যা হলো, তার কারণ কী?

শফিয়ার রহমান: কার্তিক মাসে বন্যা হওয়াটা অস্বাভাবিক। এ বন্যার দায় মূলত বাংলাদেশ ও ভারত উভয় রাষ্ট্রের। সেই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনও একটি কারণ। বাংলাদেশে কার্তিক মাসে যে বন্যা হলো, তার কারণ ভারতের গজলডোবায় ব্যারাজের সব গেট একসঙ্গে খুলে দেওয়া। যদি গেটগুলো আগে থেকে খোলা থাকত, তাহলে পানি ধীরে ধীরে আসত। এতে বন্যা ও ভাঙন অনেকটাই এড়ানো যেত। একসঙ্গে সব গেট খুলে দেওয়ায় যে পারিমাণ পানি একসঙ্গে ঢুকেছে, তাতে করে বন্যা রোধ করার আর কোনো উপায় ছিল না। এটা হলো ভারতের দায়। বাংলাদেশের দায় হলো তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনায় কোনো কাজ করেনি। তিস্তা নদীর পানি ধারণক্ষমতা খুবই কম। সরকার এ নদীর পরিচর্যা করলে নদীর ধারণক্ষমতা বাড়ত। তখন কার্তিকে বন্যার ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া যেত।

বন্যায় তলিয়ে গেছে ধানখেত। গতকাল বৃহস্পতিবার রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার শংকরদহ গ্রামে
ছবি: মঈনুল ইসলাম

প্রশ্ন :

বন্যা ও ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পওয়ার উপায় কী?

শফিয়ার রহমান: বিশ্বজুড়ে এখন নদী ব্যবস্থাপনা অনেক উন্নত। আমাদের দেশের নদীগুলো সুরক্ষায় মনোযোগ দিলে অবশ্যই নদীর ভাঙন এবং বন্যা রোধ করা সম্ভব। যেমন তিস্তা নদীর কথাই যদি বলি, এ নদীর তলদেশ ভরাট। পাড় সুরক্ষায় বিজ্ঞানসম্মত কোনো ব্যবস্থা নেই। শাখা নদীগুলো খনন করা দরকার। বর্তমান সরকার তিস্তা মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করছে। এখন পর্যন্ত বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নেই। বিজ্ঞানসম্মতভাবে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে তিস্তা নদীর সুরক্ষা সম্ভব হবে। সেই ক্ষেত্রে বন্যা ও ভাঙন দুটিই রোধ হবে। একই কাজ দেশের অপরাপর নদীগুলোতেও করা সম্ভব।

আরও পড়ুন

প্রশ্ন :

আপনারা তিস্তা নদী নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন। এই অঞ্চলের নদী আন্দোলন নিয়ে কিছু বলুন।

শফিয়ার রহমান: আমরা ছয় দফা দাবিতে তিস্তা সুরক্ষার আন্দোলন করছি। এর মধ্যে বিজ্ঞাসম্মতভাবে তিস্তার পরচির্যা, তিস্তাপারের মানুষের ক্ষতিপূরণসহ নদী ও নদীর তীরবর্তী জনপদের কল্যাণের জন্য আমাদের আন্দোলন। বর্তমানে তিস্তা নদীর দুই পারে কয়েক লাখ মানুষ এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত। আমরা নদীর দুই পাড়ে প্রায় ২৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ মানববন্ধন করেছি, শত শত সমাবেশ করেছি, স্তব্ধ কর্মসূচি পালন করেছি, রংপুরে মহাসমাবেশ করেছি। আগামী ১৫ নভেম্বর ২০২১ তিস্তা রেল সেতুসংলগ্ন এলাকায় ছয় দফা বাস্তবায়নের দাবিতে লংমার্চ ও সমাবেশের ডাক দিয়েছি। আমরা আশা করি, সরকার আমাদের দাবিগুলো আমলে নেবে, তিস্তা সুরক্ষায় কাজ করবে। সবশেষে সরকারের কাছে আমার দাবি, নিজস্ব অর্থায়নে যেভাবে পদ্মা সেতু হচ্ছে, সে রকম নিজস্ব অর্থায়নে তিস্তা রক্ষার কাজ করা হোক। সারা দেশে অনেকগুলো মেগা প্রকল্প থাকলেও রংপুরে কোনো মেগা প্রকল্প নেই। তিস্তায় মেগা প্রকল্প নেওয়া সম্ভব হলে সারা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লাভজনক হবে এই মেগাপ্রকল্প।

প্রথম আলো: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
শফিয়ার রহমান: প্রথম আলোকেও ধন্যবাদ।

আরও পড়ুন