তমালের ঘন ছায়ায় মন জুড়িয়ে যায়
‘না পোড়াইও রাধা অঙ্গ/ না ভাসাইও জলে/ মরিলে বাঁধিয়ে রেখো/ তমালের ডালে...।’ এ আকুলতাই বলে দেয় তমাল শুধু একটা গাছ নয়; এই গাছের সঙ্গে আরও একজন জড়িয়ে আছেন, রাধার অন্তরজুড়ে যাঁর ঠাঁই। তাঁর বিরহে রাধা একা, শূন্য। তমালের ডালে বসেই কৃষ্ণ যে বাঁশি বাজিয়েছেন! এ সুর রাধার মনকে উদ্বেল করেছে।
রাধার কথা ভেবেই হয়তো জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘ওরে তরু তমাল শাখা/ আছে পল্লবে তোর মোর বল্লভ কৃষ্ণ কান্তি মাখা/ আমি তাইতো তমাল কুঞ্জে আসি/ তাইতো তমাল ভালোবাসি/ তোর পথছায়ায় আছে যে তার চরণচিহ্ন আঁকা।’
রাধা-কৃষ্ণের সুবাদে সাহিত্যের নানা শাখায় আছে তমালের কথা। তমাল আছে লোকগীতি, বৈষ্ণব কবিতা ও সংস্কৃত কাব্যেও। এটি একটি দীর্ঘজীবী চিরসবুজ গাছ। মাঝারি আকৃতির গাছটির কাণ্ড খাটো, অমসৃণ, আঁকাবাঁকা। বসন্তে ফুটে ছোট সাদা ফুল। ফল দেখতে ছোট গাবের মতো গোল, হলুদ রঙের। এর আদি নিবাস মিয়ানমার, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের উষ্ণ অঞ্চলে। তমালের উদ্ভিদজাত নাম Diospyros cordifolia. তমাল নিয়ে এত কথা থাকলেও গাছটি সচরাচর দেখা যায় না।
গাছটি দুর্লভ, তবে একেবারে হারিয়ে যায়নি। মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার মাধবকুণ্ড জলপ্রপাত পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় একটি স্থান। এই জলপ্রপাতের কাছে যাওয়ার পথেই দু–তিনটি তমালগাছ আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন গাছটির বয়স আনুমানিক শত বছর।
বন বিভাগের বড়লেখা রেঞ্জ কর্মকর্তা শেখর রঞ্জন দাস জানান, তমাল খুব ধীরে ধীরে বাড়ে। অনেক দিন লাগে বড় হতে। দুর্লভ গাছ হিসেবে মাধবকুণ্ড ইকোপার্ক এবং প্রাকৃতিক বনে তমালগাছ লাগানো হচ্ছে। বড়লেখা পৌরসভার লালপুর এলাকাতে আরও একটি বড় তমালগাছ আছে।
সম্প্রতি মাধবকুণ্ডে দেখা গেছে, জলপ্রপাতের কাছে যাওয়ার আগে পথের বাঁ পাশে মহাদেবের মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তমালগাছ। তার ঘন ছায়া পড়েছে নিচে। আঁকাবাঁকা শাখা-প্রশাখা গাছের এদিক-ওদিকে দোল খাচ্ছে। ডালে ডালে গোলাকার গাবের মতো ছোট ছোট ফল। কিছু পাখি তমালের ডালে বসছে, আবার উড়ে যাচ্ছে। পাতার ফাঁক গলে চলছে রোদের নাচানাচি।
শ্রীশ্রী মাধবকুণ্ড উন্নয়ন ও পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক অনুকূল চন্দ্র দেব (৬৫) বলেন, ‘হিন্দুধর্মীয় সংস্কৃতিতে, পদাবলিতে তমাল-কদম্বের কথা আছে। তমালের সঙ্গে রাধা-কৃষ্ণের ভাব-ভক্তি আছে। অনেক শক্ত গাছ এটি। বিভিন্ন সময় ডাল কাটা হয়। কিন্তু গাছটি মরেনি। পাখি বসে। পর্যটক, তীর্থযাত্রীরা এই তমালের ছায়ায় বসেন। মন্দিরের সৌন্দর্যও বাড়িয়েছে এই তমালগাছ। পুরোনো গাছটির বয়স আনুমানিক ১০০ বছর।’ জানান, তিনি মাধবকুণ্ডের কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত প্রায় ৪৫ বছর ধরে। সেই ছোটবেলা থেকেই তমালগাছটিকে দেখে আসছেন। একসময় এই স্থানে বিশাল আকৃতির কড়ইসহ প্রচুর গাছপালা ছিল। তবে বেশির ভাগ গাছ কেটে উজাড় করা হয়েছে।