রাতের বৃষ্টিতে বেড়েছে পানি, হাকালুকিপারের বন্যার্তদের নির্ঘুম রাত

হাকালুকি হাওরের পানি বাড়ায় তলিয়ে যাওয়া কাননগো বাজার। বুধবার দুপুরে মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার তালিমপুর ইউনিয়নেছবি: প্রথম আলো

হাকালুকি হাওরের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় গত শনিবার মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার সুজানগর, তালিমপুর, বর্নি ও দাসেরবাজার ইউনিয়নে বন্যা দেখা দেয়। ওই সময় থেকে এসব গ্রামের বেশ কিছু পরিবার নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে শুরু করে। আর কিছু পরিবার রয়ে যায় তাদের বাড়িতে। গতকাল মঙ্গলবার রাতের বৃষ্টিতে পানি আরও বাড়তে শুরু করলে যারা বাড়িতে রয়ে গিয়েছিল, তারা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। পানি আরও বাড়লে ঘর ছাড়ার আশঙ্কায় নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে তারা।

এখন তাদের যোগাযোগে একমাত্র ভরসা নৌকা। কিন্তু কয়েকটি জেলে পরিবার ছাড়া নৌকা নেই বললেই চলে। অন্যদিকে ঘরে পানি ওঠায় এরই মধ্যে মাটির চুলাও তলিয়ে গেছে। অনেক পরিবারে রান্না করার উপায় নেই। গবাদিপশু, গৃহপালিত হাঁস-মুরগি নিয়েও বিপাকে লোকজন। পানিতে তলিয়ে যাওয়া কাঁচা ঘরের বাসিন্দারা আছেন ঢেউয়ের ভয়ে।

প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও পানিবন্দী মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এর মধ্যে হাওরসংলগ্ন তালিমপুর ইউনিয়নের প্রায় ৯৫ শতাংশ বাড়িঘরে পানি উঠেছে। পানিবন্দী মানুষজন প্রতিবেশীর ঘরে, আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে কিংবা আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। অনেকে ঝুঁকি নিয়ে ঘরের মধ্যে বাঁশের মাচা বেঁধে, খাট-পালঙ্কের পায়ার নিচে ইট দিয়ে উচ্চতা বাড়িয়ে বসবাস করছেন। এদিকে গতকাল রাতে বৃষ্টি হওয়ায় প্রায় এক ফুট পানি বেড়েছে। এতে করে এসব ঘরের বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। রাতের বেলা পরিবারের লোকজন নিয়ে কোথায় যাবেন, ভেবে পাচ্ছিলেন না।

তালিমপুর ইউনিয়নের বেশিরভাগ মানুষ অস্বচ্ছল জানিয়ে সেখানকার সাবেক চেয়ারম্যান বিদ্যুৎ কান্তি দাস আজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০০৪ সালে এ রকম বন্যা হয়েছিল। কিন্তু ওই বছরের তুলনায় এবার অন্তত দেড় ফুট পানি বেশি হয়েছে। আমার বাড়ির সব কক্ষে এক-দেড় ফুট পানি। তালিমপুরে ৯৫ শতাংশ ঘরেই পানি উঠেছে। কাল (মঙ্গলবার) রাতের বৃষ্টিতে পানি বাড়তে থাকে। আতঙ্কে মানুষজন রাতে ঘুমায়নি।’

বন্যায় তলিয়ে যাওয়া মুর্শিবাদকুরা গ্রামের একটি বাড়ি। বুধবার দুপুরে উপজেলার তালিমপুর ইউনিয়নে
ছবি: প্রথম আলো

উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ঘরে পানি ওঠায় গত কয়েকদিনে পাশের বিভিন্ন গ্রামের প্রায় ৬০টি পরিবার তালিমপুর ইউনিয়নের হাকালুকি উচ্চবিদ্যালয় ও হাকালুকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে। অনেকে কানুনগো বাজারের খালি ঘরেও উঠেছেন। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে বড়লেখা উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শুকনা খাবার ও খিচুড়ি বিতরণ করা হয়েছে। এখানে আশ্রয় নেওয়া লোকজনের বেশিরভাগই দিনমজুর। রুজি বন্ধ থাকায় চাহিদামতো খাবার পাচ্ছেন না তাঁরা। খাদ্যসংকট আছে গ্রামের ভেতর আটকে থাকা পরিবারগুলোতেও।

হাকালুকি উচ্চবিদ্যালয়ে আশ্রয় নেওয়া মুর্শিবাদকুরা গ্রামের অটোরিকশাচালক সেলিম উদ্দিন আজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরার বাড়িটা বেশি নিচে। বাঁশ-বেতের ঘর। ঘরের মধ্যে কোমরপানি। উন্দাল (রান্নাঘর) পড়ি গেছে। তুফান দিলে ঘরটাও পড়ি যাইবো। ১০/১১ দিন আগে এইখানে আইছি (আসছি)। এই কয়দিন ধরি রুজি-রোজগার বন্ধ। থোরা (অল্প) চিড়া, মুড়ি, খিচুড়ি পাইছি।’

আশ্রয়কেন্দ্রে কেউ ভালো নেই জানিয়েছেন বড় ময়দান গ্রামের বেলাল মিয়াও। তিনি বলেন, ‘এখানো (এখানে) রিকশা, ঠেলা, অটোর ড্রাইভার, মাছ ধউররা (মৎস্যজীবী) মানুষ উঠছি। চিড়া, মুড়ি, খিচুড়ি খাইয়া আছে সবাই।’

তালিমপুর ইউনিয়নের বড় ময়দান, মুর্শিবাদকুরা, হাল্লা, কুটাউড়া, আহমদপুর, শ্রীরামপুর, পাবিজুরি, বাড্ডা, দশঘরি গ্রামের প্রায় সব বাড়িঘরে পানি উঠেছে বলে জানিয়েছেন মুর্শিবাদকুরা গ্রামের শিক্ষার্থী মিথুন বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘হাওরপারে প্রায় সব পাকা বাড়িই একতলা। আশ্রয় নেওয়ার জায়গা কম।’

বন্যাকবলিত ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র। বুধবার দুপুরে তালিমপুরে
ছবি: প্রথম আলো

স্থানীয় হোমিও চিকিৎসক মিন্টু বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, হাওরে সাধারণত ধীরে ধীরে এক-দুই ইঞ্চি করে পানি বাড়ে। এবার তিন দিনে (শনি থেকে সোমবার) দ্রুত পানি বেড়ে গেছে। হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল রাখার জায়গা নেই। এসব প্রাণী যে অন্য জায়গায় নেবে—নৌকাও নেই। গুটিকয় মৎস্যজীবীর নৌকা আছে। এদিকে নৌকা ছাড়া বের হওয়ার উপায় নেই। মানুষ এখন আতঙ্কে। একটু বাতাস দিলে কাঁচা ঘর ভেঙে পড়বে।

প্রশাসন থেকে ও ব্যক্তিগতভাবে ত্রাণ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন তালিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য এনামুল হক। তিনি বলেন, প্রায় শতভাগ মানুষ পানিবন্দী। কিছু মানুষ স্কুলে আসছে। অনেকেই মাচা বেঁধে ঘরে আছে। রান্নায় খুব অসুবিধা। শৌচাগারও পানির নিচে।

দাসেরবাজার ইউনিয়নের উত্তর বাগীরপাড় গ্রামের শিক্ষক বকুল চন্দ্র নাথ বলেন, ‘বাড়িঘরে পানি। রাস্তায় কোমর পানি। পুরাই জলবন্দী আমরা।’

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

গত কয়েক দিনে ৪০টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ১০ হাজার মানুষ উঠেছেন বলে জানিয়েছেন বড়লেখা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) খন্দকার মুদাচ্ছির বিন আলী।

আজ বুধবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যথেষ্ট ত্রাণ আছে। শুকনা খাবার, খিচুড়ি ও চাল দেওয়া হচ্ছে। কমিটি করে দেওয়া হয়েছে। ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছানো হচ্ছে। প্রবাসীসহ ব্যক্তিগতভাবেও অনেকে ত্রাণ দিচ্ছেন। এরপরও কেউ কেউ ত্রাণ না–ও পেতে পারেন।

ইউপি চেয়ারম্যানদের খোঁজ নেওয়ার জন্য বলে দিয়েছেন জানিয়ে ইউএনও খন্দকার মুদাচ্ছির বিন আলী বলেন, আমি গতকাল নিজে গ্রামের ভেতর গিয়ে ত্রাণ বিতরণ করেছি। আজকেও খোঁজ নিচ্ছি।’