হুমকির মুখে থাকা বন্য প্রাণীদের নিয়ে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে হবে

বন্য প্রাণী গবেষক এম এ আজিজ

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম এ আজিজ। তিনি যুক্তরাজ্যের কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সুন্দরবনের বাঘ বিষয়ে পিএইচডি করেছেন। ২০১৯ সালে প্রকাশিত সর্বশেষ বাঘ জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ ও ফলাফল তৈরিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। গুরুত্বপূর্ণ জলজ প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনার জন্য সংরক্ষিত এলাকা সম্প্রসারণ (ইপিএএসআইএই) নামের এ প্রকল্পের মাধ্যমে সুন্দরবনের ডলফিনের জন্য সংরক্ষিত এলাকা রক্ষার প্রকল্পেও বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। আজ ৩ মার্চ বিশ্ব বন্য প্রাণী দিবস উপলক্ষে দেশের বন্য প্রাণীদের সংরক্ষণ ব্যবস্থা, বিলুপ্তি ও করণীয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন বন্য প্রাণী গবেষক এম এ আজিজ।

প্রশ্ন :

দেশে বন্য প্রাণীদের অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ আছে। বলা হচ্ছে অর্ধেক প্রাণী বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে। এসব প্রাণী রক্ষায় করণীয় কী?

এম এ আজিজ: উদ্বেগ আছে, এটি অস্বীকার করা যাবে না। উভচর, সরীসৃপ, পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণীর ওপর আইইউসিএন ও বন অধিদপ্তর যে লাল তালিকা করেছে, তাতে ১৬১টি প্রজাতি হুমকির মুখে। এরা মহাবিপন্ন, বিপন্ন কিংবা সংকটাপন্ন। আর এই চার দলের প্রাণীর মধ্যে তুলনামূলকভাবে স্তন্যপায়ীর অবস্থা সবচেয়ে নাজুক। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ স্তন্যপায়ী বিলুপ্তির হুমকির মধ্যে রয়েছে। মূলত আবাসের চাহিদা ও আকারে বড় হওয়ায় এরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। এ ছাড়া বেশ কিছু প্রজাতির পাখি ও সরীসৃপও রয়েছে এ তালিকায়।

যেমন মিঠাপানির নদীর শুশুক লাল তালিকায় বিপন্ন প্রজাতি। এর অর্থ হলো এটি নিকট ভবিষ্যতে বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। এটিকে টিকিয়ে রাখতে হলে নদী রক্ষা করতে হবে। বন অধিদপ্তর ইতিমধ্যে বাঘ, হাতি ও নদীর শুশুকের ওপর জাতীয় কর্মপরিকল্পনা (অ্যাকশন প্ল্যান) তৈরি করেছে। অন্য যেসব গুরুত্বপূর্ণ বন্য প্রাণী হুমকির মুখে রয়েছে, সেগুলো নিয়েও কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। তবে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো এ কর্মপরিকল্পনা তৈরি করে বাস্তবায়নের জন্য তড়িৎ ও কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

প্রশ্ন :

বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশে বন্য প্রাণীর আবাসস্থলের অবস্থা কেমন, সংরক্ষণে কী করা উচিত?

এম এ আজিজ: দেশের এক বিরাট জনগোষ্ঠী প্রাকৃতিক পরিবেশের নানা উপাদানের ওপর দারুণভাবে নির্ভরশীল। নদ-নদীর মাছ কিংবা বনাঞ্চলের গাছ, যা-ই হোক না কেন। ক্রমবর্ধমান অতিরিক্ত জনসংখ্যার ফলে দিন দিন মানুষ অধিক হারে প্রাকৃতিক উপাদান আহরণ করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। ফলে এসব প্রাকৃতিক পরিবেশে টিকে থাকা প্রাণীরা খাদ্যের সংকটে পড়ছে, যা ভবিষ্যতে আরও বৃদ্ধি পাবে। আবাসের অবক্ষয় হবে। একটি বন্য প্রাণীর প্রধান চাহিদা উপযুক্ত বাসস্থান ও পর্যাপ্ত খাদ্য। তারা অনেকে বাসস্থান হারিয়েছে, কারও সংকুচিত হয়েছে, অনেকের বাসস্থান কোনো রকমে টিকে থাকলেও অবক্ষয় হয়েছে মারাত্মকভাবে। ফলে বাস্তুহারা হয়েছে নানা প্রাণী, খাদ্যের জোগান হ্রাস পেয়েছে কারও কারও। স্বাভাবিকভাবেই উদ্বাস্তু প্রাণীরা মানুষের ঘরবাড়িতে হানা দিচ্ছে। পরিবেশের উন্নয়ন ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়নকে টেকসই করা সম্ভব নয়। বন্য প্রাণীর জন্য তাদের বাসস্থান ছেড়ে দিলে প্রকৃতিও ভালো থাকবে, আমরাও ভালো থাকতে পারব।

আরও পড়ুন

প্রশ্ন :

বনভূমি উজাড়ের পাশাপাশি উপকূলীয় অঞ্চলে এখন অধিক উচ্চতার জোয়ারেও বন্য প্রাণীরা হুমকিতে। এ ক্ষেত্রে কী উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে?

এম এ আজিজ: বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা নানা প্রজাতির বন্য প্রাণীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ বাসস্থান। কাদাপানির চর ছাড়াও ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল গড়ে উঠেছে উপকূলীয় এলাকায়। সুন্দরবন এ ক্ষেত্রে সামনের কাতারে। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি সংরক্ষিত এলাকাও রয়েছে। এর মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে এ অঞ্চলে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মাত্রা ও প্রবণতা দুটিই এখন ক্রমবর্ধমান। ফলে উপকূলীয় এলাকা যেমন ভাঙনের মুখে পড়েছে, তেমনি তীব্র জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে। ফলে বন্য প্রাণীরা বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের সময় তীব্র জোয়ার সৃষ্টি হলে অনেক বন্য প্রাণী মৃত্যুবরণ করে, অনেকে সমুদ্রে ভেসে যায়, কেউ কেউ লোকালয়ে এসে বাঁচার চেষ্টা করে। এ রকম পরিস্থিতিতে বন্য প্রাণী রক্ষা করা অত্যন্ত কঠিন। সুন্দরবনে কিছু আপৎকালীন ব্যবস্থা রয়েছে। যেমন বনের নানা জায়গায় পুকুর খনন করা হয়েছে। এসব পুকুরে মিঠাপানি ও আপৎকালে প্রাণীরা পারে আশ্রয় নিতে পারে। এগুলো আরও বাড়াতে হবে।

প্রশ্ন :

বন্য প্রাণী রক্ষায় বিশেষজ্ঞ মহলে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, আলোচনা থাকলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে এর গুরুত্ব খুব কম। এ ক্ষেত্রে করণীয় কী?

এম এ আজিজ: সাধারণ মানুষের মধ্যে বন্য প্রাণী নিয়ে কৌতূহল লক্ষ করা যায়। কিন্তু প্রকৃতিতে বন্য প্রাণীর গুরুত্ব বা অবদান সম্পর্কে তাদের জ্ঞান একেবারেই সীমিত। ফলে কারণে-অকারণে নানা ধরনের প্রাণী মানুষের হাতে প্রতিনিয়ত মারা পড়ছে। প্রাণী-প্রকৃতিবান্ধব নতুন প্রজন্ম তৈরি করতে হবে আমাদের। প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করে সব পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তকে প্রাণ-প্রকৃতি, বন্য প্রাণীর গুরুত্ব ও প্রাণীর প্রতি সদয় হওয়ার নানা দিক সংযোজন করতে হবে। গণমাধ্যমে বন্য প্রাণীর বিষয়কে গুরুত্বসহ তুলে ধরতে হবে।

প্রশ্ন :

জীববৈচিত্র্য, বন ও বন্য প্রাণী সংরক্ষণ এবং নিরাপত্তা বিধানকল্পে ২০১২ সালে বন্য প্রাণী আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এ আইনের প্রয়োগ যথাযথভাবে হচ্ছে কি?

এম এ আজিজ: আমাদের মতো দেশে শুধু আইন প্রয়োগ করে অপরাধ ঠেকানো মুশকিল। তবে সঠিক প্রয়োগ হলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখা অসম্ভব নয়। দেশের বন্য প্রাণী রক্ষায় বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) ২০১২ আইনটি একটি ভালো রক্ষাকবচ। তবে যেকোনো আইনের সুফল তখনই পাওয়া যাবে, যখন আইনটির সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করা যাবে। মাঠপর্যায়ে এ আইনের প্রয়োগ বর্তমানে একেবারে মন্দ নয়, মূলত নানা বন্য প্রাণী শিকার ও অবৈধ ব্যবসার ক্ষেত্রে। তবে বন্য প্রাণীর আবাসস্থল রক্ষায় আইনটির প্রয়োগ বাড়াতে হবে।