ইলিশ ধরে জ্বালানি খরচও তুলতে পারছেন না কক্সবাজার উপকূলের জেলেরা
কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলে চলতি মৌসুমে পর্যাপ্ত ইলিশের দেখা পাননি জেলেরা। এ জন্য তীব্র দাবদাহ আর অপর্যাপ্ত বৃষ্টিকে দায়ী করেছেন মৎস্য বিভাগ, ট্রলার মালিক ও জেলেরা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গভীর সাগর থেকে উপকূলে ইলিশ আনতে ভারী বর্ষণের দরকার। কিন্তু গত তিন মাসে কক্সবাজারে টিপটিপ বৃষ্টি হয়েছে। এ বৃষ্টিতে ইলিশের সাড়া মেলে না।
৭ অক্টোবর থেকে শুরু হচ্ছে মা ইলিশ আহরণ বন্ধে ২২ দিনের সরকারি নিষেধাজ্ঞা। ফলে হতাশ হয়ে বাড়িতে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছেন উপকূলের লক্ষাধিক জেলে ও মৎস্যজীবী।
আজ বুধবার সকালে কক্সবাজার শহরের বাঁকখালী নদীর নুনিয়াছটা ফিশারিঘাটে গিয়ে দেখা গেছে, গভীর সাগর থেকে ৩০টির বেশি ট্রলার ফিশারিঘাটের মৎস্য অবতরণকেন্দ্রে ভিড়েছে। বেশির ভাগ ট্রলারে ইলিশ ধরা পড়েছে ৫০ থেকে ৫০০টি। কয়েকটিতে ১ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০টি দেখা গেল। ইলিশগুলো ৩৫০ থেকে ৭০০ গ্রাম ওজনের। ইলিশের পাশাপাশি গুইজ্যা, মাইট্যা, চাপা, রাঙাচকি, কামিলা, পোপা মাছও ধরা পড়েছে।
‘এফবি মায়ের দোয়া’ নামের একটি ট্রলারের জালে ধরা পড়েছে ২ হাজার ২০০টি ইলিশ। ওজন ৩৫০-৫০০ গ্রাম। পাইকারিতে প্রতিটা ইলিশ বিক্রি হয়েছে ৮০ টাকায়। ট্রলারের জেলে আবুল কালাম (৪৫) বলেন, গভীর সাগরে গিয়ে ১২ দিন অবস্থান করে এই ইলিশ ধরা পড়েছে। ওজন কম বলে দামও পাওয়া যায়নি। ৭ অক্টোবর থেকে নিষেধাজ্ঞা শুরু হচ্ছে। সংসার চালাবেন কী দিয়ে, ভেবে পাচ্ছেন না।
কক্সবাজার উপকূলে কয়েক মাস ধরে আবহাওয়া পরিস্থিতি খুবই খারাপ যাচ্ছে। প্রচণ্ড দাবদাহের কারণে গভীর সমুদ্র থেকে নদীতে আসার সুযোগ পাচ্ছে না ইলিশ।
এফবি সোহেল নামের আরেকটি ট্রলারে ধরা পড়েছে ৭৪টি ইলিশ। ওজন ৪০০-৭০০ গ্রাম। প্রতিটি ইলিশ বিক্রি হয়েছে ৯০-১১০ টাকায়। ২০ জন ট্রলারটি নিয়ে সাগরে নেমেছিল আট দিন আগে। তাতে জ্বালানিসহ আনুষঙ্গিক খাতে খরচ হয়েছে তিন লাখ টাকা। ট্রলারের জেলে নবী হোসেন বলেন, ইলিশসহ অন্যান্য মাছ বিক্রি করে পাওয়া গেছে মাত্র ৯০ হাজার টাকা। এ টাকায় জ্বালানি খরচও ওঠেনি।
ফিশারিঘাট ঘুরে দেখা গেল, ঢাকায় ইলিশ সরবরাহের জন্য কার্টন ভর্তি করা হচ্ছে। প্রতিটি কার্টনে ২০ কেজি ইলিশ।
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ইলিশ সরবরাহ করেন ফিশারিঘাট মৎস্য ঐক্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির ৩০-৪০ সদস্য। সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মো. জয়নাল আবেদীন প্রথম আলোকে বলেন, আজ বুধবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত ৩টি ট্রাকে প্রায় ১৫ মেট্রিক টন ইলিশ ঢাকায় সরবরাহ করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার সরবরাহ করা হয়েছে ৩টি ট্রাকে ১৬ টন ইলিশ। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ ইলিশের ওজন ৪০০-৬০০ গ্রাম। আগের বছরগুলোতে এ সময়ে দৈনিক ১৫ ট্রাক ইলিশও সরবরাহ হয়েছিল।
বেশি তাপমাত্রা ও কম বৃষ্টির কারণে সাগরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণের ইলিশ ধরা পড়ছে না উল্লেখ করে জয়নাল আবেদীন বলেন, এমন অবস্থায় ৭ অক্টোবর থেকে মা ইলিশ ধরা বন্ধে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হচ্ছে। ইতিমধ্যে গভীর সাগর থেকে ইলিশ ছাড়াই ট্রলারগুলো উপকূলে ফিরে আসতে শুরু করেছে।
বুধবার ফিশারিঘাটে ৩৫০-৫০০ গ্রাম ওজনের প্রতি কেজি ইলিশ পাইকারিতে বিক্রি হয়েছে ৩৫০-৪০০ টাকায়। ৫০০-৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৬৫০-৭০০ টাকা, ৭০০-৮০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৮৫০-৮৭০ টাকা, ৮০০- ৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৯৫০-১০০০ টাকা এবং ১ কেজির বেশি ওজনের ইলিশ বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ১০০-১ হাজার ৭০০ টাকায়।
শহরের নুনিয়াছটার ট্রলারমালিক গিয়াস উদ্দিন বলেন, গত বছর জুন-জুলাই দুই মাস ভারী বর্ষণ হয়েছিল। ধরা পড়েছিল বড় বড় ইলিশ। এবার জুন, জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বরে তেমন বৃষ্টি হয়নি। চলছে গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহ পরিস্থিতি। ইলিশও তেমন ধরা পড়ছে না।
গভীর সাগর থেকে উপকূলের নদীর মোহনায় ইলিশ আনতে হলে টানা ভারীবর্ষণ দরকার বলে জানালেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. বদরুজ্জামান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কক্সবাজার উপকূলে কয়েক মাস ধরে আবহাওয়া পরিস্থিতি খুবই খারাপ যাচ্ছে। প্রচণ্ড দাবদাহের কারণে গভীর সমুদ্র থেকে নদীতে আসার সুযোগ পাচ্ছে না ইলিশ। বৃষ্টিও খুব কম হয়েছে। টিপটিপ বৃষ্টিতে ইলিশ আসে না।
জেলা মৎস্য বিভাগের তথ্যমতে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) জেলায় ১ হাজার ৯৩৮ মেট্রিক টন ওজনের ১৯ লাখ ৫ হাজার ৬৯৬টি ইলিশ ধরা পড়েছে। এর মধ্যে জুলাই মাসে ২৬৮ মেট্রিক টন, আগস্টে ৭৪৮ মেট্রিক টন ও সেপ্টেম্বরে ৯২২ মেট্রিক টন ইলিশ ধরা পড়ে। ৮০ শতাংশ ওজনের ওজন ছিল ৫০০-৭০০ গ্রাম। নুনিয়াছড়া ফিশারিঘাটে এবার সর্বোচ্চ আড়াই কেজি ওজনের ইলিশও পাওয়া গেছে।
মৎস্য বিভাগের তথ্যমতে, গত অর্থবছরে জেলায় ইলিশ আহরণ হয়েছিল ৪০ হাজার ৪২৮ মেট্রিক টন। চলতি অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫০ হাজার মেট্রিক টন। জেলায় মৎস্য বিভাগের নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ৬৩ হাজার ১৯৩। ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞায় ৪০ হাজারের বেশি জেলে পরিবারে ত্রাণসহায়তা দেওয়া হবে।
কক্সবাজার ফিশিংবোট মালিক সমিতির সভাপতি মুজিবুর রহমান বলেন, গত ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত টানা ৬৫ দিনের সরকারি নিষেধাজ্ঞা শেষ করে জেলার পাঁচ হাজারের বেশি ট্রলার ইলিশ ধরতে সাগরে নেমেছিল। প্রচণ্ড দাবদাহের পাশাপাশি অন্তত পাঁচ দফা নিম্নচাপ-লঘুচাপ সৃষ্টির প্রভাবে প্রায় দেড় মাস জেলেরা সাগরে ইলিশ ধরতে পারেননি। এখন শুরু হচ্ছে ২২ দিনের সরকারি নিষেধাজ্ঞা। এতে জেলার টেকনাফ, কক্সবাজার সদর, মহেশখালী, কুতুবদিয়াসহ জেলার অন্তত এক লাখের বেশি জেলে পরিবার অর্থসংকটে পড়বে। ট্রলারমালিকেরাও লোকসানের মুখে।