দ্বন্দ্বের বিষে স্বপ্নভঙ্গের ১৪ বছরে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর এক যুগের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও এখনো পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ পায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দ্বন্দ্বে প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রমে অস্থিতিশীলতা তৈরি হচ্ছে। বাড়ছে সেশনজট, প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা। ব্যাহত হচ্ছে অবকাঠামোসহ নানা উন্নয়নকাজ।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ১৪ বছরে যাঁরা উপাচার্য হয়েছেন, তাঁরা সবাই বিভিন্ন কারণে আন্দোলনের মুখে পড়েছেন। শিক্ষক-কর্মকর্তাদের দ্বন্দ্বে শুরু হওয়া আন্দোলনে শিক্ষার্থীদেরও উসকে দেওয়া হয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে মনোযোগ দিতে পারেননি উপাচার্যরা। বেশির ভাগ সময় অস্থিরতা সামলাতে ব্যয় হয়েছে তাঁদের।
সর্বশেষ উপাচার্য শুচিতা শরমিনের পদত্যাগ দাবি করে দুই দফায় তাঁর কার্যালয় ও বাসভবনে তালা দেওয়ার পাশাপাশি বাসভবনের মূল ফটক ভাঙচুর করা হয়েছে।
সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম নিয়ে উপাচার্য ও সহ–উপাচার্যের মধ্যে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। সব বিভাগের একাডেমিক অগ্রগতি জানতে চেয়ারম্যানদের সঙ্গে একটি সভা ডেকেছিলেন সহ–উপাচার্য। সহ-উপাচার্যের পক্ষে ৭ ফেব্রুয়ারি নোটিশও দেওয়া হয়। কিন্তু উপাচার্য সহ–উপাচার্যের নোটিশকে ‘বিধিবহির্ভূত’ উল্লেখ করে সব বিভাগের চেয়ারম্যানকে এ ব্যাপারে সাড়া না দিতে আহ্বান জানান।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন সচেতন নাগরিক কমিটির বরিশালের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক শাহ সাজেদা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আন্দোলন করে একটি বিশ্ববিদ্যালয় পেয়েছি ঠিকই; কিন্তু ১৪ বছরে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি। আমাদের প্রত্যাশা ছিল, শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করবে, নানা গবেষণা করবে, নতুন নতুন বিষয় উদ্ভাবন করবে। কিন্তু শিক্ষকদের দলাদলি, বারবার আন্দোলন ও বিশ্ববিদ্যালয় অচল করে দেওয়ার মতো উদ্বেগজনক ঘটনা প্রায়ই দেখছি। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎকর্ষতা লাভে বড় প্রতিবন্ধকতা।’
নানা সংকটে শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত
প্রতিষ্ঠার পর নানা সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থীরা বলছেন, প্রায় ১০ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে ৪টি হলে মাত্র দেড় হাজার জনের আবাসনসুবিধা আছে। ২৫টি বিভাগের শিক্ষার্থীদের পাঠদানের জন্য ৭৫টি কক্ষ প্রয়োজন। আছে মাত্র ৩৬টি। শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষক–সংকটে অধিকাংশ বিভাগে সেশনজট বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা ন্যূনতম ছয় মাস থেকে দেড় বছর সেশনজটে আটকে থাকছেন। এতে মানসিক অস্থিরতা ও হতাশা বাড়ছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক চূড়ান্ত পর্বের শিক্ষার্থী নাবিলা জান্নাত প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বিভাগে ৫টি ব্যাচে ৪৫০ জন শিক্ষার্থী। কিন্তু শ্রেণিকক্ষ মাত্র একটি। অন্য আরেক বিভাগের সঙ্গে ভাগাভাগি করে আরেকটি কক্ষে ক্লাস করেন। কক্ষসংকটে ক্লাস কম হওয়ায় সিলেবাস এগোয় না। ইতিমধ্যে তাঁরা এক বছরের সেশনজটে পড়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক সমস্যা থাকলেও সমাধানে উদ্যোগ খুব কম। বারবার বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আন্দোলন হয়, কিন্তু ফল আসে না।
আন্দোলনের ফাঁদে উপাচার্যরা
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠার পর বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় এখন পর্যন্ত পাঁচজন উপাচার্য এসেছেন। সবাই আন্দোলনের মুখোমুখি হয়েছেন। প্রথম উপাচার্য হারুন অর রশিদের চার বছরের মেয়াদে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের দ্বন্দ্বে দুই দফায় আন্দোলন হয়েছিল। দ্বিতীয় উপাচার্য এস এম ইনামুল হক সবচেয়ে বেশি প্রতিরোধের মুখে পড়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে দুই দফায় একবার ১৫ দিন ও পরে টানা ৪৪ দিনের আন্দোলনে গোটা বিশ্ববিদ্যালয় অচল হয়ে যায়। শিক্ষক-কর্মকর্তাদের দলাদলিতে শুরু হওয়া আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের উসকে দেওয়া হয়েছিল। আন্দোলনের জেরে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বাধ্য হয়ে ইনামুল হককে তিন মাসের ছুটিতে পাঠায়। ছুটিতে থাকতেই তাঁর মেয়াদ পূর্ণ হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান মো. ছাদেকুল আরেফিন। তাঁর সময়েও শিক্ষক-কর্মকর্তাদের প্রভাব বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্বে চার থেকে পাঁচ দফা আন্দোলন হয়। আন্দোলন শেষ পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে গিয়েছিল। এরপর উপাচার্য হন মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া। ছয় মাসের মাথায় জুলাই অভ্যুত্থানের পর ২০ আগস্ট শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে তিনি পদত্যাগ করেন। এরপর গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক শুচিতা শরমিন। তিনি যোগদানের পর প্রথম বিক্ষোভের মুখোমুখি হন গত বছরের ২৬ নভেম্বর। ওই দিন আবু হেনা মোস্তফা কামাল খানকে কোষাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দিলে শিক্ষকদের একটি অংশ তাঁকে আওয়ামী লীগের দোসর আখ্যা দিয়ে নিয়োগ বাতিলের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। এতে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ যোগ দেয়।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ২৮ নভেম্বর দুপুরে উপাচার্য কার্যালয়ে কলাপসিবল গেটে তালা দিয়ে তাঁর নামফলক খুলে ফেলেন একদল শিক্ষার্থী। ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত সেই আন্দোলন অব্যাহত ছিল। দ্বিতীয় দফার গত বৃহস্পতিবার বিকেলে হঠাৎ আন্দোলনে নামেন একদল শিক্ষার্থী। ৬ ফেব্রুয়ারি উপাচার্য একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় দুই শিক্ষককে সিন্ডিকেট থেকে বাদ দেওয়ার প্রতিবাদে তাঁরা বিক্ষোভ করে উপাচার্যের বাসভবনে তালা দেন। এরপর শুক্রবার উপাচার্যের বাসভবনের ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনকারীরা।
উপাচার্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেপথ্যে
উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন নিয়ে অন্তত সাতজন শিক্ষক বলেন, শুচিতা শরমিন উপাচার্য হওয়ার পরই শিক্ষকদের একটি অংশ নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে আসছিলেন। ২৬ নভেম্বরে আবু হেনাকে কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ দেওয়ার পর সেটির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। শিক্ষকদের ওই অংশ আন্দোলন শুরু করলে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ যোগ দেয়। পরে দাবির মুখে আবু হেনার নিয়োগ বাতিল করে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মামুন অর রশিদকে কোষাধ্যক্ষ নিয়োগ দেয় মন্ত্রণালয়।
সূত্র জানায়, শুচিতা শরমিন উপাচার্য নিয়োগ পাওয়ার শুরু থেকেই শিক্ষকদের একটি পক্ষ তাঁর বিপক্ষে ছিল। এরপর গত ৩০ অক্টোবর সহ–উপাচার্য হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক গোলাম রাব্বানি নিয়োগ পান। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম নিয়ে উপাচার্য ও সহ–উপাচার্যের মধ্যে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। সব বিভাগের একাডেমিক অগ্রগতি জানতে চেয়ারম্যানদের সঙ্গে একটি সভা ডেকেছিলেন সহ–উপাচার্য। সহ-উপাচার্যের পক্ষে ৭ ফেব্রুয়ারি নোটিশও দেওয়া হয়। কিন্তু উপাচার্য সহ–উপাচার্যের নোটিশকে ‘বিধিবহির্ভূত’ উল্লেখ করে সব বিভাগের চেয়ারম্যানকে এ ব্যাপারে সাড়া না দিতে আহ্বান জানান। বর্তমানে সহ–উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষকে ঘিরে নতুন করে উপাচার্যবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছে।
আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী শহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দুই মাস আগে ২২ দফা দাবি দিয়েছিলাম। উপাচার্য সময় নিয়ে বাস্তবায়নের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু এখনো তার প্রতিফলন দেখছি না। এরপর তিনি যত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সবই স্বেচ্ছাচারিতামূলক। এতে একাডেমিক কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ফটক ভাঙার বিষয়ে বলেন, ‘আমরা তাঁর বাসভবনের সামনে দুই ঘণ্টা অবস্থান করে প্রতিনিধি পাঠিয়ে কথা বলতে দুবার যোগাযোগ করেছিলাম, কিন্তু তিনি রাজি হননি। এ জন্য ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা এটা করেছে। আমরা রোববার নতুন কর্মসূচি দেব।’
তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বরিশাল মহানগরের আহ্বায়ক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘এই আন্দোলন আকস্মিক। জুলাই আন্দোলনে যাঁরা নেতৃত্বে ছিলেন, তাঁদের কেউই এতে ছিলেন না। শুরুর দিন আমরা বুঝতেই পারছিলাম না কেন এই আন্দোলন। শুক্রবার ১০ দফা দেওয়ার পর বুঝতে পারি।’ তিনি বলেন, দুই মাস আগে ২২ দফার আন্দোলনে তাঁরা ছিলেন। দাবির প্রতি তাঁরাও একমত। তবে ফটক ভাঙা, তালা দেওয়া সমর্থনযোগ্য নয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তাঁরা সভা ডেকেছেন। সবার সঙ্গে আলোচনা করে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেবেন।
জানতে চাইলে উপাচার্য শুচিতা শরমিন প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষার্থীদের ২২ দফা বাস্তবায়নে তাঁরা কাজ করে যাচ্ছেন। তারপরও একের পর এক ইস্যু বানিয়ে এভাবে আন্দোলন করাটা কাম্য নয়। এতে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে। প্রশাসনিক নানা জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও বিঘ্ন ঘটছে। তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনে আবার বসব। যতবার লাগে ততবার বসব। বিশ্ববিদ্যালয়ের সুষ্ঠু পরিবেশ যাতে বিঘ্নিত না হয়, সে ব্যাপারে শিক্ষার্থীরা যেন সচেতন থাকে।’
বারবার আন্দোলনে পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত
বারবার আন্দোলনের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। করোনা মহামারি, জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী অস্থিরতায় এমনিতেই দীর্ঘ মেয়াদে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ ছিল। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ দলাদলিতে অস্থিরতা বিরাজ করায় শিক্ষার্থীরা অসহায় হয়ে পড়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় অন্তত ১১ জন শিক্ষার্থী উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যত আন্দোলন হয়েছে, বেশির ভাগের নেপথ্যে ছিল শিক্ষক-কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ ও দ্বন্দ্ব। যেখানে নানা কৌশলে শিক্ষার্থীদের উসকে দেওয়া হয়েছে। কিছু দাবিদাওয়া জুড়ে আন্দোলনকে শিক্ষার্থীদের স্বার্থের মোড়ক দেওয়ার কৌশল নেওয়া হয়। কিন্তু আদতে শিক্ষার্থীদের কোনো লাভ হয়নি; বরং ক্ষতি হয়েছে।