রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রচার শেষ, অপেক্ষা ভোটের

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) ভবনছবি: প্রথম আলো

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু), হল সংসদ ও সিনেট ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনের প্রচার উৎসবমুখর পরিবেশে শেষ হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার রাত ১২টা পর্যন্ত এই প্রচার চলে। এই নির্বাচন ঘিরে ক্যাম্পাস ও আশপাশের নিরাপত্তাও জোরদার করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনও তাদের সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ করেছে।

গতকাল প্রচারের শেষ দিনে সকালেই প্রার্থীরা ছুটে গেছেন ভোটারদের কাছে। এ সময় তাঁদের অনেক সমর্থকও প্রচারে অংশ নেন। প্রার্থীরা উৎসবের আমেজের মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন নিয়ে আশাবাদী বলে জানিয়েছেন। কয়েক দফায় তারিখ বদলের পর অবশেষে নির্বাচন হতে যাওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যেও রয়েছে উচ্ছ্বাস।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক এফ নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রার্থী ও ভোটারদের মধ্যে যে উচ্ছ্বাস তৈরি হয়েছে, এ জন্য আমরা খুবই আনন্দিত। নির্বাচনের সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। এখন আমরা শুভক্ষণের (আগামীকাল বৃহস্পতিবার) জন্য অপেক্ষা করছি।’

প্রচারণার ফাঁকে কুশল বিনিময় করেন ছাত্রশিবির মনোনীত ভিপি প্রার্থী ও ছাত্রদল মনোনীত ভিপি প্রার্থী। গতকাল পরিবহন মার্কেট এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

শেষ দিনের প্রচার ছিল যেমন

গতকাল সকাল থেকেই ক্যাম্পাসে প্রার্থীদের আনাগোনা ছিল বেশি। এদিন ক্যাম্পাসে উপস্থিত ছিলেন শত শত গণমামাধ্যমকর্মী। প্রার্থীরা ছুটেছেন ভোটারের পেছনে; আর সাংবাদিকেরা ছুটেছেন প্রার্থীদের পেছনে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন মার্কেটের আমতলা হয়ে উঠেছিল প্রচারের জমজমাট মঞ্চ। এখানে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির-সমর্থিত প্যানেলসহ বিভিন্ন প্যানেলের ভিপি প্রার্থী এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের অনেককেই দেখা গেছে।

সকাল পৌনে ৯টায় প্রচার শুরু করেন ‘আধিপত্যবিরোধী ঐক্য’ প্যানেলের জিএস প্রার্থী সালাহউদ্দিন আম্মার। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী ভবনের সামনে তিনি প্রচার চালান। অনেকেই নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন উল্লেখ করে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি সব ভোটারের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছেন। সবকিছু ছাপিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে, এমনটাই তাঁর প্রত্যাশা।

 বিকেলে আমতলায় প্রচারপত্র বিলিয়ে প্রচার করতে দেখা যায় বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর সমর্থিত প্যানেল ‘গণতান্ত্রিক শিক্ষার্থী পর্ষদ’-এর ভিপি প্রার্থী ফুয়াদ রাতুলকে। তিনি বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে নির্বাচনের প্রচার চললেও শিক্ষার্থীরা বিরক্ত হচ্ছেন না। আশা করা যাচ্ছে, উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট হবে।

গতকাল সন্ধ্যার পরও গান ভেসে আসছিল, ‘বন্ধু তোর লাইগা রে...।’ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের পেছনে গিয়ে দেখা গেল এক প্রার্থী তাঁর সমর্থক নিয়ে গান গাচ্ছেন। তিনি ছাত্রদল-সমর্থিত ‘ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম’ প্যানেল থেকে সহসাংস্কৃতিক সম্পাদক পদপ্রার্থী শাহরিয়ার আলম। তিনি বললেন, ‘গানে গানেই প্রচার শেষ হোক। আমার পদই সাংস্কৃতিকবিষয়ক।’

রাকসু নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে কথা বলছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনেরসহ নির্বাচন কমিশনারেরা। আজ সিনেট ভবনে
ছবি: প্রথম আলো

প্রচারে সমর্থকেরাও

শেষ সময়ের প্রচারে বিভিন্ন প্যানেলের সক্রিয় সমর্থকেরাও অংশ নিয়েছেন। তাঁদের ক্যাম্পাসের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে প্রচারপত্র বিলি করতে দেখা গেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাডেমিক ভবনের পাশে বেলা ১১টায় পাঁচজন সমর্থককে প্রচারপত্র বিতরণ করতে দেখা গেছে। সেখানে প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ইশতিয়াক আহমেদ ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেলের হয়ে পাণ্ডা ও প্রজাপতির আদলে তৈরি প্রচারপত্র বিলি করেন।

রাকসু নির্বাচনে স্বতন্ত্র কার্যনির্বাহী সদস্য পদপ্রার্থী ইয়াসিন আরাফাতের (আরমান) হয়ে প্রচারপত্র বিতরণ করেন আইন বিভাগের শিক্ষার্থী জিহাবুর ইসলাম। তিনি বলেন, ক্যাম্পাসে ভোটের আমেজ তৈরি হয়েছে। প্রার্থীদের পাশাপাশি তাঁরা সমর্থকেরাও জোর প্রচার চালাচ্ছেন।

‘রাকসু ফর রেডিক্যাল চেঞ্জ’ প্যানেলের এজিএস প্রার্থী আল শাহরিয়া শুভর পক্ষে ক্যাম্পাসে ঘুরে ঘুরে প্রচারপত্র বিতরণ করেন একদল শিক্ষার্থী। বেলা সোয়া ১১টার দিকে টুকিটাকি চত্বরের সামনে তাঁর সমর্থক জিসান হোসেন বলেন, সবাই যার যার অবস্থান থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

ছাত্রশিবির-সমর্থিত প্যানেল ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’-এর সমর্থনেও ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের নির্বাচনী প্রচার চালাতে দেখা গেছে।

আরও পড়ুন

শিবির ও ছাত্রদলের আশা-শঙ্কা

আচরণবিধি লঙ্ঘন এবং নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে অভিযোগ তুলেছে ছাত্রশিবির-সমর্থিত প্যানেল ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকার ওপর আস্থা রাখার কথা বললেও শেষ পর্যন্ত তা কতটা বজায় থাকবে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেল ‘ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম’। গতকাল বেলা সোয়া ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন মার্কেটে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন উভয় প্যানেলের ভিপি প্রার্থীরা।

প্রচারের ক্ষেত্রে তাঁরা বাধার শিকার হয়েছেন জানিয়ে সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোটের ভিপি প্রার্থী মোস্তাকুর রহমান বলেন, ‘সোমবার বেগম খালেদা জিয়া হলে আমাদের একটি প্রজেকশন মিটিং ছিল; কিন্তু আমাদের খাবার, চেয়ার এমনকি প্রজেক্টরও হলে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। নির্বাচন কমিশনের সার্বিক কার্যক্রমে সন্তুষ্ট হলেও কয়েকজন কমিশনার এবং হল প্রাধ্যক্ষের আচরণে পক্ষপাতিত্বের ছাপ দেখা গেছে।’

শিবির-সমর্থিত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ‘ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম’ থেকে ভিপি প্রার্থী নূর উদ্দীন আবীর বলেন, তাঁরা বিভিন্ন হলে খাবার ও উপঢৌকন বিতরণ করছেন, যা হাতেনাতে ধরা পড়েছে। নির্বাচন কমিশনের ভূমিকার ওপর শেষ পর্যন্ত কতটা আস্থা বজায় থাকবে, তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।

আরও পড়ুন

বিধিনিষেধ জারি

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ক্যাম্পাসে যানবাহন চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। নির্বাচনের দিন ক্যাম্পাসে মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে গণমাধ্যমকর্মীসহ বিশেষ স্টিকারযুক্ত যানবাহনের ক্ষেত্রে এই বিধিনিষেধ প্রযোজ্য নয়। গতকাল দুপুরে প্রক্টর অধ্যাপক মাহবুবর রহমানের সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে এই নির্দেশনা জারি করা হয়। তবে শারীরিক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য এসব নিয়ম শিথিল।

গতকাল রাত ১২টা থেকে নির্বাচনের পরদিন রাত ১২টা পর্যন্ত তিন দিন ক্যাম্পাসে মিছিল, মিটিং, বিক্ষোভ, সমাবেশ এবং সব ধরনের অস্ত্রশস্ত্র প্রদর্শন ও বহন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ সময়ে কোনো ধরনের মাইকিং, আতশবাজি বা পটকা ফোটানোও যাবে না। ক্যাম্পাসের বাইরে চারপাশে ২০০ গজের মধ্যেও এ বিধিনিষেধ বলবৎ থাকবে। গতকাল বিকেলে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরএমপি) কমিশনার মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানানো হয়।

এ নির্বাচনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে দুই হাজার পুলিশের পাশাপাশি ৬ প্লাটুন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং ১২ প্লাটুন র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) নিয়োজিত থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মাহবুবর রহমান বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ক্যাম্পাসে ইতিমধ্যে পুলিশ সদস্যরা এসেছেন। কেউ যেন অস্থিতিশীল পরিবেশ ক্যাম্পাসের ভেতরে ও বাইরে না করতে পারে, তার জন্য তাঁরা তৎপর রয়েছেন।

রাকসুর ২৩ পদে ২৪৭, সিনেট ছাত্রপ্রতিনিধি নির্বাচনে ৫টি পদে ৫৮ জন প্রার্থী রয়েছেন। এ ছাড়া ১৭টি হলে হল সংসদে ১৫টি করে পদে মোট প্রার্থী ৫৯৭ জন। নির্বাচনে মোট ভোটার শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৮ হাজার ৯০১।

আরও পড়ুন