পুলিশের বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ, এসপি-ওসির প্রত্যাহার চান বিশিষ্টজনেরা

ভোলা জেলার মানচিত্র

ভোলার চরফ্যাশনে গৃহবধূ বকুলি বেগম (৩৫) হত্যার ঘটনায় পুলিশ পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে বলে অভিযোগ করেছেন বিশিষ্টজনেরা। আজ বৃহস্পতিবার এক যৌথ বিবৃতিতে তাঁরা বলেছেন, হত্যায় জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার না করে পুলিশ ভূমিহীনদের পক্ষের লোকজনকে গ্রেপ্তারের হুমকি দিচ্ছে। এমন ভূমিকার কারণে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) তদন্তপ্রক্রিয়া থেকে প্রত্যাহার এবং পুলিশ সুপারকে (এসপি) ভোলা থেকে অবিলম্বে অপসারণের দাবি তাঁদের।

গত ২৯ নভেম্বর রাতে ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার মুজিবনগর ইউনিয়নের দুর্গম চর শিকদারের চরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। দুর্বৃত্তরা গভীর রাতে ঘরে ঢুকে বকুলি বেগমকে কুপিয়ে হত্যা করে। হামলায় বকুলির বড় বোন মুকুলি বেগম (৪০) গুরুতর আহত হন।

হত্যার ঘটনার তদন্ত নিয়ে আজ বিবৃতি দিয়েছেন ৩৪ জন বিশিষ্ট নাগরিক। তাঁদের মধ্যে আছেন মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের সভাপতি ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সভাপতি জেড আই খান পান্না, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী তবারক হোসেইন ও সুব্রত চৌধুরী, পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, ব্লাস্টের অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক মো. নূর খান, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য মেসবাহ কামাল, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, লেখক রেহনুমা আহমেদ প্রমুখ।

জানতে চাইলে পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, পুলিশ নিরপেক্ষ তদন্ত করছে। পুলিশ প্রকৃত আসামিদের শনাক্ত করে আটক করেছে, যাঁদের মধ্যে দুজন স্বেচ্ছায় আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। যাঁরা প্রকৃত আসামি, তাঁদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

আরও পড়ুন

একটি অপরাধী চক্র স্থানীয় একশ্রেণির পুলিশ সদস্যের সহায়তায় ভূমিহীনদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, ঘটনার দিন ১৪ থেকে ১৫ জন সন্ত্রাসী ভূমিহীননেতা আলম বাচ্চুর বাড়িতে ধারালো অস্ত্রশস্ত্রসহ আক্রমণ চালিয়ে তাঁর স্ত্রী বকুলিকে হত্যা করে। আলম বাচ্চু সে সময় বাড়িতে ছিলেন না। বকুলি মুত্যুর আগে তাঁর বোন মুকুলিকে খুনিদের যে কয়জনকে শনাক্ত করতে পেরেছিলেন, তাঁদের নাম বলে গিয়েছেন, যা মৃত্যুকালীন ঘোষণার সমতুল্য।

বিবৃতিতে অভিযোগ করা হয়, এ ঘটনায় আলম বাচ্চু অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নাম উল্লেখ করে মামলা করতে গেলে পুলিশ জানায়, অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে। এই সময় তজুমদ্দিন সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মাসুম বিল্লাহ দুলারহাট থানায় উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে পুলিশ অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করে ওই এলাকার অলিল চৌকিদারকে বাদী করে একটি হত্যা মামলা করেছে, যাতে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করা যায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আলম বাচ্চু বাদী হয়ে ভোলা আদালতে একটি পিটিশন কেস করেছেন। আদালত ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে দুলারহাট থানাকে সংশ্লিষ্ট নথি আদালতে সোপর্দ করার আদেশ দেন।

বিশিষ্টজনেরা বলছেন, এ ঘটনার পর থেকে যাঁদের নামে অভিযোগ রয়েছে, তাঁরা চরে বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করেনি। সর্বশেষ ২২ ডিসেম্বর আলম বাচ্চুর সঙ্গে ভূমিহীনদের আন্দোলনের সহযোগী ইউপি সদস্য মো. আবদুল মালেক ও ভূমিহীনকর্মী মান্নানকে পুলিশ তুলে নিয়ে যায়। এর পর থেকে তাঁদের সঙ্গে আত্মীয়স্বজন বা এলাকার কাউকে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। পুলিশ নির্যাতন করে আবদুল মালেকের স্বীকারোক্তি আদায় করেছে বলে অভিযোগ করেছেন তাঁর ছেলে মো. সোহাগ। ২৪ ডিসেম্বর পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, আবদুল মালেক চরের জমি দখলের জন্য বকুলি বেগমকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছেন এবং তিনি এর স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।

পুলিশের এ ধরনের বক্তব্য ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ উল্লেখ করে প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার প্রচেষ্টার তীব্র নিন্দা জানান বিশিষ্টজনেরা। বিবৃতিতে তাঁরা এএসপি মাসুম বিল্লাহ ও দুলারহাট থানার ওসি আনোয়ারুল হককে তদন্তপ্রক্রিয়া থেকে অবিলম্বে প্রত্যাহার করার দাবি জানান। একই সঙ্গে সাধারণ ভূমিহীন ও নিরীহ মানুষকে হয়রানির জন্য পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলামকে ভোলা থেকে অবিলম্বে অপসারণের দাবি জানান। পাশাপাশি চর মুজিবনগরে এই হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেপ্তার এবং দ্রুত সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানান তাঁরা।

দুলারহাট থানার ওসি আনোয়ারুল হক বলেন, এ ঘটনায় ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. আ. মালেক, আবদুল হান্নান ও মো. আসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁরা জিজ্ঞাসাবাদে হত্যার দায় স্বীকার করেছেন। আদালতে মামলার বিষয়টি শুনলেও কাগজ হাতে পাননি বলে জানান তিনি।