বরিশাল ও খুলনার নেতাদের বহিষ্কারে বিএনপির চিঠির ভাষা নিয়ে ক্ষোভ

রোববার সন্ধ্যায় বরিশাল নগরের গড়িয়ার পাড় এলাকায় গণসংযোগ করেন সাবেক ছাত্রদল নেতা ও বরিশাল সিটি নির্বাচনে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী কামরুল আহসান। তিনি বিএনপির কোনো পদে না থাকলেও তাঁকেও বহিষ্কারের চিঠি দিয়েছে দলটি
ছবি: প্রথম আলো

খুলনা ও বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে অংশ নেওয়ায় বিএনপির নেতাদের বহিষ্কার করে কেন্দ্র থেকে যে চিঠি দেওয়া হয়েছে, এর ভাষা আপত্তিকর ও রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত বলে মনে করছেন দলটির অনেক নেতা–কর্মী। এ চিঠির ভাষা ব্যবহারে শোভন হওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।

খুলনায় ৯ জন ও বরিশালে ১৯ জনকে দল থেকে আজীবন বহিষ্কারের চিঠি দিয়েছে কেন্দ্রীয় বিএনপি। বরিশালে শুক্রবার রাতে ও খুলনায় শনিবার রাতে পাঠানো এ চিঠিতে দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর স্বাক্ষর রয়েছে। এসব চিঠির ভাষা এক।

চিঠির শেষে লেখা হয়েছে, ‘দলীয় গঠনতন্ত্রের বিধান অনুযায়ী দলের প্রাথমিক সদস্য পদসহ সব পর্যায়ের পদ থেকে নির্দেশক্রমে আপনাকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হলো। গণতন্ত্র উদ্ধারের ইতিহাসে আপনার নাম একজন বেইমান, বিশ্বাসঘাতক ও মীরজাফর হিসেবে উচ্চারিত হবে।’

আরও পড়ুন

চিঠির এ ভাষাকে বেদনাদায়ক ও অপমানজনক মনে করছেন খুলনায় চিঠি পাওয়া বিএনপির নেতাদের কেউ কেউ। আবার দলটির নেতাদের অনেকে মনে করছেন, চলমান আন্দোলনকে বিএনপি কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে, তা বোঝাতেই এমন ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে।

বিএনপির সাবেক কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও খুলনা নগর বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম ওরফে মঞ্জু প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন, তাঁরা দলের পরীক্ষিত কর্মী। কোনো না কোনো কারণে তাঁরা নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। এ জন্য দল শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে চিঠির ভাষাটা রূঢ় হয়েছে, কঠিন হয়েছে। এটা না হলেও হতো।

রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, বিএনপি এ সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ দলের একজন সদস্য হয়ে ব্যক্তিস্বার্থ চিন্তা করে এ সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করেছেন ওই সব নেতা। ১ জুন কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়ার পর নির্দিষ্ট সময় অতিবাহিত হলেও নোটিশের জবাব দেননি তাঁরা, যা গুরুতর অসদাচরণ।

চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, প্রার্থিতা প্রত্যাহার না করে ১৫ বছর ধরে চলমান গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা যাঁরা গুম, খুন ও পৈশাচিক নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, তাঁদের পরিবারসহ দেশের গণতন্ত্রকামী বিপুল জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষার প্রতি ওই সব নেতা বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। এমন অবজ্ঞা ও ঔদ্ধত্যের জন্য বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলের প্রাথমিক সদস্য পদসহ দলের সব পদ থেকে তাঁদের আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে।

চিঠির এ ভাষাকে কোনো রাজনৈতিক ভাষা মনে হয়নি মন্তব্য করে খুলনা সিটির ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী সাজ্জাদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘৩৮ বছর ধরে তৃণমূলের রাজনীতি করছি। মাথার ওপর ১২টি রাজনৈতিক মামলা ঝুলছে। দল যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা মেনে নিতে হবে। তবে আজীবন বহিষ্কারের চিঠির ভাষা অত্যন্ত দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক।’

খুলনা নগর বিএনপির সাবেক যুগ্ম সম্পাদক ও ২২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী মাহবুব কায়সার প্রথম আলোকে বলেন, যে ভাষায় চিঠি লেখা হয়েছে, তা খুবই অশোভন ও শিষ্টাচারবহির্ভূত। এ ধরনের ভাষা ব্যবহার করে আমাদের অপমানিত করা হয়েছে।’

আরও পড়ুন

অবশ্য চিঠির ভাষা নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করে খুলনা নগর বিএনপির সাবেক জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সম্পাদক তরিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, দলীয় সিদ্ধান্ত ও শৃঙ্খলা যে কত গুরুত্বপূর্ণ, সেটি বোঝাতেই চিঠিতে এত কঠিন ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। চিঠির মাধ্যমে এই বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যে বিএনপি এবারের আন্দোলনের বিষয়ে খুবই কঠোর।

চিঠির এ ভাষাকে পরিচ্ছন্ন মনে করেন না সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) খুলনার সভাপতি আইনজীবী কুদরত-ই-খুদাও। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করা ব্যক্তিদের বহিষ্কার করা একটা স্বাভাবিক বিষয়। তবে চিঠির যে ভাষা তা একটা রাজনৈতিক দলের জন্য কোনো গণতান্ত্রিক ভাষা নয়। ভাষাটা আরও পরিশীলিত, মার্জিত ও গণতান্ত্রিক  মূল্যবোধের পরিচায়ক হওয়া উচিত।

এদিকে চিঠি পাওয়া চারজন নেতাসহ বরিশাল বিএনপির মোট সাতজন নেতার সঙ্গে এ বিষয়ে প্রথম আলোর কথা হয়। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেন, চিঠিতে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, তা রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত। এই চিঠিকে তাঁরা অপরিণত চিন্তার বহিঃপ্রকাশ বলেও মন্তব্য করেছেন।

বহিষ্কারের চিঠি পাওয়া নেতারা বলেন, বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক দল। এমন একটি দলের ভাষা ব্যবহার অত্যন্ত মার্জিত হবে, এটাই সবাই কামনা করে। নির্বাচনমুখী দল হিসেবে বিএনপির নেতা-কর্মীরা কোথাও কোথাও দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করতে বাধ্য হয়েছেন। এটা অন্যায় হতে পারে। কিন্তু যাঁকে দল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কারের ঘোষণা দেওয়া হবে, তাঁকে ন্যূনতম সম্মানটুকু জানানোর মতো উদারতা থাকবে না, এটা দুঃখজনক এবং শিষ্টাচারের খেলাপ।

সদ্য বহিষ্কৃত বরিশাল মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক শাহ আমিনুল ইসলাম আক্ষেপ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বহিষ্কৃত হয়েছি তাতে কোনো আক্ষেপ নেই। কিন্তু চিঠিটা পড়ে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেছে। যে দলের পেছনে ৪০ বছর শ্রম দিয়েছি, সেই দল আমাকে যে ভাষায় চিঠি দিয়েছে, তা বেদনার। বিদায় দেওয়ার সময় অন্তত এতটুকু কৃতজ্ঞতা দলের মধ্যে থাকা উচিত। একটা গণতান্ত্রিক দলের প্রধান শর্ত হচ্ছে উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও মানবিক ব্যবহার। কিন্তু সেটার কোনো প্রমাণ এই চিঠিতে নেই।’

বিএনপির দেওয়া এই চিঠির বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) বরিশাল নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক রফিকুল আলম রোববার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি গণতান্ত্রিক দলের প্রধান শর্ত হচ্ছে মানুষের মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করা। কিন্তু এই চিঠিতে তার প্রতিফলন নেই। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত ভাষা ব্যবহারে আরও সাবধান ও যত্নশীল হওয়া। দলের একজন নেতা বা সদস্যকে যখন আপনি বহিষ্কার করবেন, তখন সেটাই তাঁর বড় শাস্তি। এ শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে এমন শব্দ ব্যবহার করে তিরস্কার করাটা ধৃষ্টতা।’