জোনাকিকে গলা টিপে হত্যার পর লাশ ডোবায় ফেলে দেন, আদালতে সৎমায়ের স্বীকারোক্তি

নিহত শিশু মর্জিনা আক্তার জোনাকি
ছবি: সংগৃহীত

যশোরে ৯ বছরের শিশু মর্জিনা আক্তার জোনাকিকে হত্যার কথা স্বীকার করেছেন তার সৎমা নার্গিস বেগম (৩৫)। লাশ উদ্ধারের ২৭ ঘণ্টা পর আজ বুধবার বেলা দুইটার দিকে যশোরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ইমরান আহমেদের আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন তিনি। সৎমেয়ে জোনাকিকে তিনি গলা টিপে হত্যার পর লাশ ডোবায় ফেলে দিয়েছিলেন।

পুলিশ জানায়, গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে যশোর শহরের রেলগেট পশ্চিমপাড়া মডেল মসজিদের পাশে একটি পুকুর থেকে জোনাকির লাশ উদ্ধার করা হয়। লাশের মুখ, হাত, পা ও গলায় আঘাতের চিহ্ন ছিল। এ ঘটনায় শিশুটির সৎমা নার্গিসকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশের হেফাজতে নেওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে হত্যার কথা স্বীকার করেন নার্গিস বেগম। এরপর গতকাল রাত ১০টার দিকে নার্গিস বেগমকে ঘটনাস্থল তাঁর বাসার পাশে নেওয়া হয়। এরপর তিনি হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দেন। এ সময় জোনাকির কাপড় ও জুতা উদ্ধার করা হয়। এরপর আজ নার্গিস বেগমকে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেওয়ার জন্য তোলা হয়।

আরও পড়ুন

জোনাকি যশোরের বেনাপোল এলাকার শাহিনুর তরফদারের মেয়ে। বেনাপোলে নানাবাড়িতে থেকে স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় তৃতীয় শ্রেণিতে লেখাপড়া করত সে। জোনাকির বাবার সঙ্গে মা কহিনুরের বিচ্ছেদ হয়েছে। মা বিদেশে চলে গেছেন। অটোরিকশাচালক বাবা শাহিনুর রেলগেট এলাকার নার্গিস বেগমকে বিয়ে করেন। সপ্তাহখানেক আগে জোনাকি যশোর শহরের রেলগেট এলাকায় বাবা ও সৎমায়ের ভাড়া বাসায় বেড়াতে আসে।

ঈদে প্রসাধনসামগ্রী কিনতেই জোনাকি যশোর শহরে বাবার কাছে এসেছিল।

আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে নার্গিস বেগম বলেন, যশোরের বেনাপোল সীমান্তে পোড়াবাড়ী গ্রামের শাহিন তরফদারের সঙ্গে ২০২১ সালে তাঁর বিয়ে হয়। শাহিনের আগে দুই স্ত্রী ছিলেন। একজন মারা যান, অন্যজনের সঙ্গে তালাক হয়ে যায়। আগের স্ত্রীদের চারটি সন্তান রয়েছে। নার্গিস বেগমের আগে একজনের সঙ্গে বিয়ে হয়। পরে তালাকও হয়ে যায়। সেই ঘরে একটি ছেলেসন্তান রয়েছে। শাহিনের সঙ্গে তিন বছরের সংসারজীবনে তিনি দুবার অন্তঃসত্ত্বা হন। কিন্তু তাঁর গর্ভের ভ্রূণ নষ্ট করতে বাধ্য করেন স্বামী শাহিন। সন্তান নিতে চাইলে শাহিন বলেন, তাঁর আগের দুই স্ত্রীর চার সন্তান রয়েছে। নতুন করে আর কোনো সন্তান নেওয়ার দরকার নেই। এতে এই সংসারে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছিলেন না নার্গিস।

এর মধ্যে গত ২৬ মার্চ স্বামীর সঙ্গে তাঁর গ্রামের বাড়ি বেনাপোলে বেড়াতে যান নার্গিস বেগম। স্বামীর আগের স্ত্রী কহিনুরের মেয়ে জোনাকিকে সঙ্গে করে তাঁরা যশোর শহরের ভাড়ার বাড়িতে ফেরেন। নার্গিস বলেন, ‘গত সোমবার সকালে আমার স্বামী ইজিবাইক চালাতে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় আমরা তিনজন একসঙ্গেই বের হই। এরপর জোনাকি খেলাধুলা করে বাসায় ফিরলে তাকে গোসল করতে যেতে বলি। কিন্তু সে তার বাবা না এলে গোসলে যাবে না বলে জানায়। এতে আমার মাথায় রক্ত উঠে যায়। এ ছাড়া আগে থেকে সন্তান নিতে না দেওয়ায় জোনাকির ওপরে ক্ষোভ ছিল। তাই রাগে ক্ষোভে জোনাকির গলা টিপে ধরি। এতে সে মারা যায়। পরে আমি নিজে আমার স্বামীকে মুঠোফোনে জানাই, জোনাকি নিখোঁজ হয়েছে। পরে সুবিধামতো লাশটি বাড়ির পাশের ডোবায় ফেলে দিই।’

জোনাকির লাশ উদ্ধারের পর নানা সুরুজ মিয়ার আহাজারি। গতকাল মঙ্গলবার যশোর জেনারেল হাসপাতালের মর্গের সামনে
ছবি: প্রথম আলো

ঈদে প্রসাধনসামগ্রী কিনতেই জোনাকি যশোর শহরে বাবার কাছে এসেছিল। সোমবার সকালে বাড়ির পাশে খেলতে গিয়ে জোনাকির নিখোঁজের ঘটনায় থানায় ওই দিন রাতে কোতোয়ালি থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তার বাবা শাহিন তরফদার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও শিশুটির নিখোঁজ হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে। নিখোঁজের ২৪ ঘণ্টা পরে গতকাল সকালে তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এরপর ময়নাতদন্তের জন্য লাশটি যশোর জেনারেল হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়।

এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গতকাল সন্ধ্যার পর নিহত জোনাকির বাবা শাহিন তরফদার বাদী হয়ে কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় একমাত্র আসামি করা হয় তাঁর স্ত্রী নার্গিস বেগমকে (৩৫)।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মফিজুল ইসলাম বলেন, জোনাকি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্‌ঘাটিত হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন সৎমা নার্গিস বেগম। জবানবন্দি দেওয়ার পর নার্গিস বেগমকে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়েছে।