ওএমএসের চালের জন্য আখিরন-কৃষ্ণারা ঘুরে ফেরেন দোকানে দোকানে
সোমবার সকাল সাড়ে নয়টা। খুলনা নগরের পূর্ব বানিয়াখামার এলাকা। বিকে মেইন রোডের পাশের একটি বন্ধ দোকানের সামনে জনা তিরিশেক নারী দাঁড়িয়ে আছেন। খোলাবাজারে বিক্রির (ওএমএস) চাল কেনার জন্য ব্যাগ হাতে তাঁদের অপেক্ষা। তবে তাঁরা জানেন না, সেখানে আজ চাল বিক্রি হবে কি না।
লিভানা এন্টারপ্রাইজ নামের ওই দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নারীদের একজন আখিরন বিবি। চার মেয়েকে নিয়ে আখিরনের সংসার। বিভিন্ন বাসায় কাজ করে কোনোমতে সংসার চলে তাঁর। আখিরন বলছিলেন, ‘সবাই প্যাটের জ্বালায় এই চাল নিতি আসে। অনেকে অন্ধকার থাকতি সারা পাড়া ঘোরে—কোনখানে চাল দ্যাবে। আমার কামাই করার লোক নিই। এই চাল ছাড়া উপায়ও নিই। প্রায় সোমবারে এইখিনে চাল দেয়, তাই দাঁড়ায় আছি। আজ দ্যাবে কি না, জানি নে। ডেইলি খোঁজ রাখি।’
আখিরন জানালেন, সকাল থেকে লাইনে দাঁড়াতে হয়। কখনো বেলা দেড়টা বেজে যায়। কেউ পান, কেউ পান না। এখন আগের চেয়ে লাইন অনেক বড় হয়। তাই যত আগে লাইনে সিরিয়াল দেওয়া যায়, তত ভালো।
আখিরনের সঙ্গে কথা বলার সময় পেয়ারা বেগম নামের মধ্যবয়সী এক নারী এসে জানালেন, আজ চাল দেবে না। এরপর অনেকে হতাশ হয়ে ফিরে যান। কয়েকজন তবু অপেক্ষা করতে থাকেন।
আগের চেয়ে অনেক লোক বাড়ছে। বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। শহরের বাইরের বটিয়াঘাটা, সাচিবুনিয়া, গল্লামারী, রূপসা এসব এলাকার লোক প্রচুর আসেন। তাঁদের জন্য এলাকার লোক চাল পান না।
নগরের ইকবালনগর এলাকার ওএমএসের দোকানে গিয়েও লম্বা লাইন দেখা গেল। জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নিয়ে চাল দেওয়া হচ্ছে সেখানে। রিনা বেগম নিজের এনআইডি না আনায় চাল নিতে পারছেন না। দাঁড়িয়ে ছিলেন লাইনের বাইরে। কিছুক্ষণ পরপর দোকানে গিয়ে তিনি চালের জন্য ধরনা দিচ্ছিলেন। না পেয়ে আবার ফিরে আসছিলেন।
কথায়–কথায় রিনা বেগম জানালেন, তাঁদের পাঁচজনের সংসার। স্বামী মশিউর রহমানের দরজির দোকান ছিল। করোনার সময় বন্ধ হয়ে গেছে। এখন অন্যের দোকানে কাজ করছেন। ভীষণ টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে সংসার চালিয়ে নিতে হচ্ছে।
রিনা বেগম বলেন, ‘ভোরবেলায় আসছি। আজ আবার আইডি কার্ড নিচ্ছে। আমার আইডি কার্ড হারিয়ে গেছে। মেয়ের আইডি কার্ড নিয়ে আসছি, তাঁরা “হবে না” বলছে। দাঁড়িয়ে থাকি, দেখি শেষ পর্যন্ত পাই কি না।’
খুলনায় ওএমএসের চাল কিনতে মানুষের ভিড় বাড়ছে। খাদ্য বিভাগের হিসাবে, নগরে প্রতিদিনই প্রায় সাড়ে ১২ হাজার মানুষ চাল পাচ্ছেন। তারপরও দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে অনেককে খালি হাতে ফেরত যেতে হয়। এর মধ্যে নগরের ১, ১৫ ও ৩১ নম্বর ওয়ার্ড, সোনাডাঙ্গা সবুজবাগের মতো শ্রমঘন ও নিম্ন আয়ের মানুষের এলাকায় সবচেয়ে বেশি মানুষ খালি হাতে ফেরত যান।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় সূত্র জানায়, নগরে বর্তমানে ৩১টি ওয়ার্ডে ওএমএসের পরিবেশক বা ডিলার রয়েছেন ৯২ জন। এক দিন জোড় ওয়ার্ডে অন্য দিন বিজোড় ওয়ার্ডে চাল-আটা বিক্রি হয়। মাসে একজন পরিবেশক চার থেকে পাঁচবার চাল ও আটা বিক্রির সুযোগ পান। প্রতিদিন খুলনা নগরে ট্রাকে ও দোকানে ৬২ মেট্রিক টন চাল ও ২৪ মেট্রিক টন আটা বিক্রি হচ্ছে। শুক্র ও শনিবার ছাড়া সপ্তাহে ৫ দিন ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ১৩টি ট্রাকে করে চলে চাল বিক্রি। এ ছাড়া ভিন্ন ভিন্ন ২৪টি ডিলারের দোকানেও প্রতিদিন চাল ও আটা বিক্রির ব্যবস্থা রয়েছে। ট্রাকে দুই মেট্রিক টন ও দোকানে দেড় মেট্রিক টন করে চাল বিক্রি হয়। এ ছাড়া দোকানে এক মেট্রিক টন করে আটা বিক্রি হয়। একজন ক্রেতা ৩০ টাকা দরে ৫ কেজি চাল ও ২৪ টাকা কেজি দরে সমপরিমাণ আটা কিনতে পারেন।
কিছুদিন আগে লাইনে লোক কম ছিল। চালের দাম একটু বাড়ায় লোক একটু বেশি হচ্ছে। আবার অনেকে ভিন্ন পয়েন্ট থেকে একাধিকবার চাল নিচ্ছেন বলে মনে করছেন খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা।
নগরের ফরাজীপাড়া এলাকার একজন পরিবেশকের দোকানের সামনে দীর্ঘ সারি। সামনে থাকা নিয়ে রীতিমতো মারামারি অবস্থা। পরিবেশক বলাকা রায় ও দোকানের কর্মীরা শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য নানা চেষ্টা করছেন। লাইনের প্রথম দিকে কোলে ছোট্ট শিশুকে নিয়ে বসে ছিলেন সীমা বেগম। সকাল সাড়ে ছয়টার সময় তিনি লাইনে জায়গা নিয়েছেন। সীমা জানান, সব সময় খোঁজখবর রাখেন, কখন চাল দিচ্ছে। যাঁরা আগে আসেন, তাঁরা পুরো পাঁচ কেজি পান। পরের দিকে অনেকে কম পরিমাণ চাল পান। আবার অনেকে ফিরে যান।
কৃষ্ণা দাস ও দীপালি পাল সচরাচর ওই পয়েন্ট থেকে চাল কেনেন না। আজ সকালে বেশ কয়েকটা পয়েন্ট ঘুরে তাঁরা ফরাজীপাড়ায় এসেছেন। কৃষ্ণা দাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক জায়গায় ঘুরে দেখছি। কোথাও দিচ্ছে না। তাই এখানে আসলাম। দেখেন সামনে যাওয়ার জন্য যুদ্ধ চলছে। সামনের লোক ঠিকমতো পায়, পিছনের লোক পায় না; পেলেও অনেকে কম পায়।’
পাশ থেকে রেশমা খাতুন বলেন, এলাকার বাইরের লোকজনের চাপ বেশি। আবার এর মধ্যে স্বজনপ্রীতি আছে। অনেকে ২০ কেজিও নিয়ে যাবেন। আর তাঁরা অনেক সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন দিয়েও পাবেন না।
ওই পয়েন্টের তদারকি কর্মকর্তা মো. রাইয়্যানুজ্জামান বলেন, এই ভিড় কমার নয়। একজন একবার মুখ খুলে, আবার আরেকবার মুখ ঢেকে আসেন। আবার অনেকে এখান থেকে নিয়ে আবার অন্য জায়গায় যাবেন। সবাই চিল্লাচ্ছেন না। যাঁরা এই বেশি চিল্লাচ্ছেন, তাঁদের অন্য জায়গায় যাওয়ার তাড়া আছে।
বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি তুলে পরিবেশক বলাকা রায় বলেন, লাইনে আগের চেয়ে অনেক লোক বাড়ছে। বরাদ্দ বাড়ানো উচিত। শহরের বাইরের বটিয়াঘাটা, সাচিবুনিয়া, গল্লামারী, রূপসা এসব এলাকার লোক প্রচুর আসেন। তাঁদের জন্য এলাকার লোক চাল পান না। সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের লোকজনই ওয়ার্ডের পরিবেশকদের কাছ থেকে চাল পাবেন, এ রকম ব্যবস্থা থাকা উচিত।
অবশ্য খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, খোলাবাজারে যে আসবেন, সেই পাবেন—এটাই নীতি। কে কোন জায়গার বাসিন্দা, এটা বিবেচ্য বিষয় নয়। ওয়ার্ড ভাগ করলে কোনো কোনো ওয়ার্ডে গ্রাহকের পরিমাণ অনেক কম হবে। কোথাও আবার অনেক বেশি হবে। ভিড় বাড়ার বিষয়ে খাদ্য কর্মকর্তারা বলছেন, কিছুদিন আগে লাইনে লোক কম ছিল। চালের দাম একটু বাড়ায় লোক একটু বেশি হচ্ছে। আবার অনেকে ভিন্ন পয়েন্ট থেকে একাধিকবার চাল নিচ্ছেন। টিসিবির মতো কার্ডের ব্যবস্থা ছাড়া এটা ঠেকানোর উপায় তাঁদের কাছে নেই।
বরাদ্দ বাড়ানোর মতো পরিস্থিতি এখনো তৈরি হয়নি বলে মনে করছেন খুলনা নগর এলাকার খাদ্য পরিদর্শক মো. আশরাফুজ্জামান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মাঠপর্যায়ের পর্যবেক্ষণ বলে, চাল না পেয়ে একেবারে ফিরে যাওয়া লোকের সংখ্যা কম। যদিও শ্রমঘন কিছু এলাকায় চাপ বেশি। শেষের দিকে পরিবেশকেরা কমবেশি দিয়ে ব্যবস্থা করে নেন।